ছোটবেলায় দেখেছি, শীতের দুপুরে রোদে পিঠ দিয়ে পায়ের উপরে ছড়িয়ে কাঁথা সেলাই করতেন ঠাকুমা। সে কাঁথায় ফুটে উঠত নৌকা, হাতি, পাখি... কত নকশা। কখনও তাদের পাশেই সেপাই, চাষি, গোলন্দাজ... সে যেন এক-একটা গল্প। যুগ কেটে যায়, তার মাঝে থেকে যায় ‘দিগন্তজোড়া নকশি কাঁথার মাঠ...’ কিন্তু দিনে দিনে কাঁথা করার শিল্পী কমতে চলেছে।
অভিনেত্রী জয়া আহসান অবশ্য অন্য কথা বললেন, ‘‘বাংলাদেশের সব বাড়িতেই মোটামুটি পুরনো কাঁথাগুলি পাওয়া যায়। অতিথি এলে তা ঘর সাজাতে ব্যবহারও হয়। বেশির ভাগ কাঁথাই যশোর, কুষ্টিয়া বা রংপুর থেকে সেলাই হয়ে আসে। এক বার যশোর থেকে শাড়িতে কাঁথা কাজ করিয়ে এনেছিলেন আমার দাদু। তা এখনও আছে। এমনকি আমার বাড়ির বিছানার চাদরেও কাঁথার কাজ। অনেক দোকানেও কাঁথা বিক্রি হয় সারা বছর।’’
রকমফের
কাঁথা বোনার কায়দাও অনেক রকম। নতুন কাপড় নয়, পুরনো কাপড় বা ধুতি চার ভাঁজ করেই বোনা হত নকশিকাঁথা। ‘‘কাঁথা বোনার সুতো বার করা হত পাড়ের রংবেরঙের সুতো থেকে।’’ বললেন জয়া। তার উপরে ফুটে ওঠে পদ্মফুল, কলমিলতা, ময়ূর, মাছ, ধানের শিষ, প্রদীপ, ঐরাবত... আরও কত কী! প্রত্যেকটি মোটিফের অর্থও আছে। যেমন মাছ উর্বরতার প্রতীক। তাই মাছের নকশা করা ছোট কাঁথা নববধূকে বরণ করার সময়ে দেওয়ার রীতি ছিল। পাড়ও বসত ভিন্ন ভিন্ন— লহর, খেজুর কাটা, হীরকদানা, পদ্মপাড়, গাছ, মাকু, বুনট, চোখপাড়... আরও কত কী! কখনও সুতোর এক ফোঁড়ে, কখনও দুই ফোঁড়ে। কাপড়ের পাড় জড়ো করে তা পরপর বুনেও কাঁথা বানানো হয়। তবে নকশিকাঁথার আবেদন চিরকালীন।
মেলবন্ধন
এখনও হয়তো কেউ কোথাও গল্প লিখে চলেছে সুচের ফোঁড়ে। তবে কাঁথার ব্যবহার বদলেছে... কামিজ়, কোট, ড্রেস, জ্যাকেট, স্টোল, চাদর, বেল্ট এমনকি গয়নাতেও আজ কাঁথার আবেদন। ফ্যাশন ডিজ়াইনার শর্বরী দত্তের কথায়, ‘‘ককটেল ড্রেস, ট্রেঞ্চ কোটে কাঁথার কাজ করছি। এতে বিশ্বের দরবারে এর আবেদন বাড়বে। ব্লেজ়ার ও টেলকোটে কাঁথার কাজ বেশ ভাল লাগে।’’ শর্ট ড্রেস বা স্কার্টে কাঁথার প্যাচওয়র্ক বদলে দিয়েছে ফ্যাশনের সমীকরণ। তবে চিরাচরিত নকশিকাঁথাই জয়ার প্রিয়। তাঁর কথায়, ‘‘নকশিকাঁথার কাজ খুব ভাল লাগে। শাড়ি বা শালের উপরেও কাঁথার কাজ আমার খুব প্রিয়। কাঁথা যেন একটা সম্পূর্ণ আর্টওয়র্ক। তার মধ্যে একটা গল্প রয়েছে। যেমন শিল্পী রং-তুলিতে ছবি আঁকেন, তেমনই সুতোয় গল্প বোনা হয় কাঁথায়। এই গল্পের বুননই সবচেয়ে ভাল লাগে।’’
ফ্যাব্রিক যেমনই হোক, তার উপরে কাঁথা যেন অন্য মাত্রা যোগ করে। মসলিনেও জাদু ছড়ায় নকশিকাঁথা। তাঁতের জমিতে কাঁথার রকমারি বুনন যেন শিল্প। তেমনই শিবোরি প্রিন্টের উপরে কাঁথাও খুব আকর্ষক। হ্যান্ডলুমের কাপড়েও এক ফোঁড়ের কাঁথার বৈচিত্র চোখে পড়ার মতো। জ্যামিতিক, বিমূর্ত মোটিফ কাঁথার বুননে চমৎকার। ডিজ়াইনার শান্তনু গুহঠাকুরতার কথায়, ‘‘চিরাচরিত কাঁথার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বিভিন্ন প্রদেশের সনাতন শৈলী। যেমন, অন্ধ্রপ্রদেশের কলমকারির জমি সুন্দর হয়ে ওঠে কাঁথার পাড় ও আঁচলে।’’
রিসাইকল
পুরনো কাঁথাকেই নতুন করে ব্যবহার করা যায়। নরম সুতো দিয়ে কাঁথা তৈরি হওয়ায় দীর্ঘ দিনের ব্যবহারে সুতো আলগা হতে শুরু করে, হারায় জৌলুসও। নতুন শাড়ির জমিতে পুরনো কাঁথার পাড় ও আঁচল জুড়ে অথবা শাড়ির কিছু অংশে প্যাচওয়র্ক হিসেবেও পুরনো কাঁথার ব্যবহার হতে পারে। আবার কয়েকটি পুরনো কাঁথা জুড়ে নতুন পোশাকও বোনা যায়। কাঁথা পাড়ের মাঝে স্টোন বসিয়েও তৈরি করা যায় স্টেটমেন্ট নেকপিস।
কাঁথার যত্ন
সিল্কের কাঁথাস্টিচ বাড়িতে কাচা নয়, ভাল দোকানে ড্রাই ওয়াশ করাবেন। n প্লাস্টিকের প্যাকেটে সিল্কের কাঁথা রাখবেন না। কাজ ভারী হলে তা হ্যাঙ্গারে না ঝুলিয়ে আলগা ভাঁজ করে বাক্সে ভরে রাখুন। ন্যাপথালিনের পরিবর্তে দারুচিনি বা লবঙ্গ ব্যবহার করুন। বছরে কম করে দু’বার শাড়ির ভাঁজ বদলে নতুন করে ভাঁজ করে রাখুন। হ্যান্ডলুম বা সুতির হলে কাঁথা ভাঁজ করে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলেই ভাল। মসলিনের কাঁথার যত্নের দরকার সবচেয়ে বেশি। এক ভাঁজে বহু দিন পর্যন্ত রাখলে ভাঁজ থেকে শাড়ি কেটে বা ছিঁড়ে যায়। রোলারের সঙ্গে পেঁচিয়ে রাখলে বহু বছর ভাল থাকবে।
ছবি: দেবর্ষি সরকার; মেকআপ: অভিজিৎ চন্দ; পোশাক: শর্বরী দত্ত (পার্পল শাড়ি ও ব্ল্যাক ড্রেস),
শান্তনু গুহঠাকুরতা (ওড়না),
সায়ন্তী ঘোষ ডিজ়াইনার স্টুডিয়ো (ব্লাউজ়), ফ্যাব ইন্ডিয়া (মেরুন কুর্তা ও
পিঙ্ক শাড়ি); গয়না: প্রিটিয়োস
স্টাইলিস্ট: সৃজনী চক্রবর্তী
লোকেশন: দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy