Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Coronary Artery Bypass

বাইপাস না অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি?

করোনারি হার্ট ব্লকের চিকিৎসায় বাইপাস সার্জারি এবং অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দু’টি ক্ষেত্রেই কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২১ ০৪:৪৭
Share: Save:

হার্ট অ্যাটাক, স্টেন্ট, অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি... শব্দগুলির সঙ্গে এখন কম-বেশি সকলেরই পরিচয় আছে। কারণ করোনারি হার্ট ব্লকের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িয়ে আধুনিক জীবনযাপন জনিত নানা রোগ। তবে হার্ট ব্লকের কারণ শুধুমাত্র করোনারি নয়। হার্ট ব্লক হতে পারে দু’ধরনের—ইলেকট্রিক্যাল এবং করোনারি। প্রথমটির চিকিৎসায় আসে পেসমেকার, দ্বিতীয়টির
জন্য অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি, বাইপাস অথবা মেডিক্যাল ম্যানেজমেন্ট বা ওষুধের প্রয়োগ।

ইলেকট্রিক্যাল হার্ট ব্লক

ফিজ়িশিয়ান ও কার্ডিয়োলজিস্ট কৌশিক চাকী বললেন, ‘‘সহজ ভাষায়, বাড়ির ইলেকট্রিক লাইনের একটি ফিউজ় উড়ে গেলে, সেই পরিষেবা ব্যাহত হবে। আবার জলের পাইপে ময়লা জমলে জল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। হার্ট ব্লকের ক্ষেত্রেও এই দু’টি ভাগ রয়েছে।’’ হার্টের ইলেকট্রিক্যাল লাইনে যদি ইলেকট্রিক-প্রবাহ ব্যাহত হয়, তবে সেটি ইলেকট্রিক্যাল ব্লক।

উপসর্গ: হৃদ্স্পন্দন কমে যায়, রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন।

পরীক্ষানিরীক্ষা: ইসিজির মাধ্যমে সাধারণত এই ব্লক বোঝা যায়। হার্টের ইলেকট্রিক্যাল লাইনকে বলা হয় কনডাকশন সিস্টেম। এই সিস্টেম ভাগ হয়ে ডান দিকের বান্ডল এবং বাঁ দিকের বান্ডল তৈরি করে। বাঁ দিকের বান্ডল দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে অ্যান্টিরিয়র ফেসিকল এবং পস্টিরিয়র ফেসিকল তৈরি করে।

এই ধরনের ব্লক হওয়া মানেই যে পেসমেকার লাগবে, তা নয়। উপসর্গহীন বাইফেসিকুলার ব্লক নিয়ে রোগী দিব্যি জীবনযাপন করতে পারেন। কিন্তু ব্লক থাকার পরে যদি উপসর্গ বাড়তে থাকে, তখন পেসমেকারের দরকার হয়। রোগীর অজ্ঞান হওয়ার পিছনে এই ধরনের ব্লকই আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে হল্টার মনিটরিং করা হয়। সাধারণত পঞ্চাশ বা তার বেশি বয়সিদের ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়। মস্তিষ্কের রোগের কারণেও রোগী অজ্ঞান হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে নিউরোলজিক্যাল কারণ খতিয়ে দেখা হয়। যদি সেখানে কোনও সমস্যা না থাকে, তখন বুঝতে হবে ইলেকট্রিক্যাল ব্লকের জন্যই রোগী অজ্ঞান হচ্ছেন। তখন পেসমেকার বসানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।

করোনারি রিস্ক ফ্যাক্টর

করোনারি হার্ট ব্লকের সম্ভাবনা বাড়ে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলিতে। যেমন, হাইপার টেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, ডায়াবিটিস, ওবেসিটি, উচ্চ কোলেস্টেরল বা লিপিড, সেডেন্টারি লাইফস্টাইল। এগুলির কোনওটি না থাকলে যে হার্ট ব্লক হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

জেনেটিক ফ্যাক্টর: বংশগত সূত্রে হার্ট ব্লক হওয়ার সমস্যা হতে পারে। যাঁদের বংশে এমন রোগের প্রকোপ থাকবে, তাঁদের ক্ষেত্রে কম বয়সেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

করোনারি হার্ট ব্লকের উপসর্গ

বুকে ব্যথা: এই ব্যথা কাজ করার সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ রোগী যদি চুপচাপ বসে থাকেন, তখন ব্যথা কম অনুভূত হবে। রোগী যদি হাঁটাচলা করেন, তখন ব্যথার তীব্রতা বাড়বে। বেশি জোরে হাঁটলে তা আরও বাড়বে। ধীরে ধীরে সেই ব্যথা ক্রমশ বাঁ হাতের দিকে বা চোয়ালের দিকে ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্রাম নিলে ব্যথা কমতে থাকে। করোনারি হার্ট ব্লকের এটি ক্লাসিক উপসর্গ।

খাওয়ার পরে ব্যথা: এই ধরনের রোগীদের খাওয়ার পরে ব্যথা বাড়ে। কারণ খাওয়ার পরে মেটাবলিজ়মের জন্য অন্ত্রে রক্তের চাহিদা বাড়ে। হার্টের কাজও বেড়ে যায়। এটিকে বলা হল পোস্টপ্র্যানডিয়াল অ্যাঞ্জিনা।

শ্বাসকষ্ট: করোনারি হার্ট ব্লকের আরও একটি উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। একটু বেশি হাঁটাচলা করলে বা সিঁড়ি দিয়ে উঠলে ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। আগে যতটা সিঁড়ি ভাঙলে শ্বাসকষ্ট হত, নতুন উপসর্গে কি তার চেয়ে কম সিঁড়ি ভাঙতেও সমস্যা হচ্ছে?

ঘাম দেওয়া এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া: বুকে ব্যথার সঙ্গে ঘাম হতে পারে। আবার কখনও ব্যথা ছাড়াই এত বেশি ঘাম হতে থাকে, যা স্বাভাবিক নয়। করোনারি হার্ট ব্লকের কারণে হঠাৎ বুকে ব্যথা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

পরীক্ষানিরীক্ষা: করোনারি হার্ট ব্লক সাধারণত ইসিজিতে ধরা পড়ে না। যদি কখনও হার্ট অ্যাটাক হয়, তার একটি চিহ্ন ইসিজিতে থাকে।

কিন্তু ‘সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক’ বা উপসর্গহীন হার্ট অ্যাটাক বা হার্টের অন্য কোনও সমস্যার কারণে ইসিজিতে পরিবর্তন এসেছে কি না, তা নিশ্চিত করতে করা হয় ইকো-কার্ডিয়োগ্রাফি। ওই পরীক্ষাতেই ধরা পড়ে, হার্টের মাসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না, হার্টের পাম্পিং ফাংশন কমেছে কি না।

এর পরে হার্টের কোন আর্টারিতে ক’টি ব্লক এবং ব্লকের পরিমাণ কতখানি, তার জন্য করা হয় অ্যাঞ্জিয়োগ্রাফি। কারণ হার্ট ব্লক থাকা সত্ত্বেও ইসিজি রিপোর্ট স্বাভাবিক, এমন দৃষ্টান্ত অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়।

করোনারি হার্ট ব্লক কী?

শরীরের যে কোনও পেশির পুষ্টির প্রয়োজন হয়। মাসলে পুষ্টি পৌঁছে দেয় রক্ত। তেমনই হার্টের কোনও আর্টারিতে ব্লক হলে, সেই আর্টারি যে মাসলে রক্ত পৌঁছে দেয়, সেখানে রক্ত চলাচল ব্যাহত হবে। তখন হার্টের পেশিতে রক্তের অভাব হবে এবং শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিতে থাকবে। এই রক্তের অভাব যদি বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, তখন মাঝে মাঝেই বুকে ব্যথা হয়। হঠাৎ করে করোনারি আর্টারি ব্লক হয়ে গেলে, সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। এটিকে বলা হয় করোনারি থ্রম্বোসিস বা অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন।

এ ছাড়া রয়েছে ক্রনিক হার্ট ব্লক। অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে হার্টের আর্টারিতে কোলেস্টেরল জমতে জমতে করোনারি আর্টারিতে ব্লক তৈরি হয়। এবং রক্ত সঞ্চালন কমতে থাকে। ব্লকের পরিমাণ যত বাড়বে, তত রক্ত সঞ্চালনের হার কমবে। তখন হাঁটাচলাতেই বুকে ব্যথা হবে।

অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি

করোনারি হার্ট ব্লকের চিকিৎসায় আসে অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি এবং বাইপাস সার্জারি। অনেকেরই সার্জারিতে ভয় থাকে। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে সার্জারির বিকল্প নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি সমস্যার সমাধান করতে পারে।

কার্ডিয়োলজিস্ট সুনীলবরণ রায় এই বিষয়টি সম্পর্কে বিশদে বুঝিয়ে দিলেন...

যখন কোনও রোগী হার্ট অ্যাটাক বা অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন নিয়ে আসেন, তখন তাঁর প্রাণ বাঁচানোর প্রশ্ন সর্বাগ্রে গণ্য। হার্ট অ্যাটাকের পরে ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এর (প্রথম তিন ঘণ্টা) মধ্যে যদি রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তখন অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করা হয়। একে বলা হয় প্রাইমারি অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি। অর্থাৎ স্টেন্ট বসিয়ে ব্লকটিকে খুলে দেওয়া। তবে অ্যাটাকের প্রথম ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করা হয়।

কিন্তু অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করানোর জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো চাই, চাই বিশেষজ্ঞ। গ্রাম বা মফস্্সলে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সব সময়ে সেই সুবিধে পান না। তখন তাঁদের ক্ষেত্রে ওষুধ দিয়ে ব্লক খুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় থ্রম্বোলাইসিস। তবে হার্ট অ্যাটাকের পরে যত দেরি হবে, তত ওষুধের কাজ করার ক্ষমতা কমবে। তাই প্রথম তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে এই চিকিৎসা করা হলে তার সুফল পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রেও প্রথম বারো ঘণ্টা পর্যন্ত থ্রম্বোলাইসিস করা হয়।

ওষুধ দিয়ে ব্লক খুলে দেওয়া হলেও, সেটাই কিন্তু শেষ নয়। এর পরে রোগীর অ্যাঞ্জিয়োগ্রাফি করে হার্টের করোনারি আর্টারিতে ব্লকের পরিমাণ দেখা হয়। যদি ৭০ শতাংশের বেশি হার্ট ব্লক হয়, তখন অবশ্যই অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করাতে হবে।

বাইপাস সার্জারি

হার্টের তিনটি প্রধান আর্টারি বা ধমনী থাকে। বাঁ দিকের আর্টারি দু’টি ভাগে বিভক্ত, সামনের ভাগটিকে বলে লেফ্ট অ্যান্টিরিয়র ডিসেন্ডিং (এলএডি) এবং পাশের ভাগটি সারকামফ্লেক্স। যেখানে আর্টারি দু’ ভাগে ভাগ হচ্ছে তাকে বলে লেফ্ট মেন বাইফারকেশন।

ব্লকের পরিমাণ ৭০ শতাংশের বেশি হলেই তা চিন্তার কারণ। সিঙ্গল, ডাবল বা ট্রিপল ভেসেল-এ (আর্টারি) ৭০ শতাংশ ব্লক এবং ব্লকের দৈর্ঘ্য যদি ৩০ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়, তবে সে সব ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করা হয়।

ব্লকের দৈর্ঘ্য এবং সংখ্যার উপরে নির্ভর করে বাইপাস সার্জারি করা হবে কি না, তা ঠিক করা হয়। ডা. রায়ের কথায়, ‘‘ডায়াবেটিক রোগীর ডাবল ভেসেলে (এলএডি এবং অন্য একটি আর্টারি) ব্লকের দৈর্ঘ্য ৪০ মিলিমিটারের বেশি হলে সার্জারি করাতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীর লেফ্ট মেন বাইফারকেশনে ব্লক হলে সার্জারিই উপায়। তিনটি ভেসেলেই ব্লক এবং তাদের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৪০-৫০ মিলিমিটার হলে সার্জারি ছাড়া উপায় নেই।’’ ডায়াবিটিস নেই এমন রোগীর তিনটি ভেসেলে দীর্ঘ ব্লক এবং লেফ্ট মেন বাইফারকেশনে ব্লক হলেও সার্জারি করাতে হবে।

বাইপাস বা অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টির পরে সতর্কতা

এই দু’টি ক্ষেত্রেই শরীরে একটি কৃত্রিম ব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়। তাই সার্জারি হোক বা অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি, এই চিকিৎসার পরে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। ডা. চাকী ও ডা. রায়ের মতে, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ডায়াবিটিস এমন অসুখ থাকলে সেগুলোকে কঠিন নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে মুশকিল। নিয়মিত ফলো-আপ করাতে হবে চিকিৎসকের কাছে।

অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি এবং বাইপাসের সাফল্য নির্ভর করে ব্যক্তির অন্যান্য শারীরিক অবস্থা এবং তিনি কতটা কঠিন অনুশাসনের মধ্যে থাকছেন তার উপরে। এই দু’টি চিকিৎসা কিন্তু রোগ নির্মূল করে না। বরং লড়ার জন্য শরীরে একটি ব্যবস্থা তৈরি করে দেয়। তাই স্টেন্টেও ময়লা জমতে পারে। গ্রাফ্টিংয়েও সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিয়মিত পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীকে তাঁর হার্ট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronary Artery Bypass
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy