নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করে রোগীদের কষ্ট কমানোর পাশাপাশি মৃত্যুহার কম করতেও সফল হয়েছেন। ফাইল ছবি।
রোজই বেড়ে চলেছে নভেল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। তবে আশার কথা, এই কয়েক মাসে দেশ জুড়ে বাড়ানো হয়েছে কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসার পরিকাঠামো। কোভিড-১৯ ভাইরাসের নতুন নতুন বৈশিষ্ট জানতে পারছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সার্স কোভ ২ ভাইরাসের চরিত্র ও মানুষের শরীরে তার সংক্রমণের ধরন বিশ্লেষণ করছেন।
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে যখন করোনার সংক্রমণে রোগীরা কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছিলেন, তখন বিশ্বের তাবড় তাবড় চিকিৎসক মারাত্মক শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য রোগীকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা করছিলেন। ছিল না কোনও ওষুধ। এখন তাঁরা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করে রোগীদের কষ্ট কমানোর পাশাপাশি মৃত্যুহার কম করতেও সফল হয়েছেন। টেক্সাস মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যাপারে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা জানিয়েছেন। কলকাতা সমেত পশ্চিমবঙ্গেও করোনার চিকিৎসার ব্যাপারে এই বিষয়গুলি মাথায় রাখা হয়।
১. মার্চ-এপ্রিলে কোভিড-১৯ ভাইরাসে রোগীর মারাত্মক শ্বাসকষ্ট ও কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছিল শ্বাসনালী-সহফুসফুসের জটিল সংক্রমণকে। ওই সময় রোগীদের কষ্ট কমাতে ও প্রাণ বাঁচাতে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে শ্বাসনালী ও ফুসফুসে
সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের সূক্ষ্ম রক্তনালীতে রক্তের জমাট অংশ বা ডেলা তৈরি করে। এর ফলে শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত চলাচল করতে পারে না।
আরও পড়ুন: লকডাউনে একটুও রোদ লাগেনি গায়ে? ভয়াবহ এ সব সমস্যা হতে পারে ভিটামিন ডি-র অভাবে
২. শরীরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়, শ্বাসকষ্ট বাড়ে। এই কারণে কোভিড রোগীর শ্বাসকষ্ট কমাতে রক্ত পাতলা করার ওষুধ অ্যাসপিরিন ও হেপারিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী জানান, কোভিড আক্রান্ত রোগীদের মাইক্রোভাস্কুলার ব্লাড ক্লট হচ্ছে। অর্থাৎ খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রক্তনালীতে রক্তের ডেলা আটকে যাওয়ায় রোগীদের মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয়। ব্যাপারটাকে হার্টের ইস্কিমিয়ার সঙ্গে তুলনা করা চলে। রক্ত জমাট বাঁধা আটকাতে ব্লাড থিনার জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানালেন সুবর্ণবাবু।
৩. কোভিড-১৯ আক্রান্তদের প্রধান সমস্যা শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া। এই ভাইরাস শরীরে গেলেই যে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট শুরু হবে তা নয়, বললেন মেডিসিনের চিকিৎসক দীপঙ্কর সরকার। তবে হাইপারটেনশন, ফুসফুসের
ক্রনিক অসুখ, ডায়াবিটিস বা হার্টের অসুখের মতো অসুখ থাকলে রোগীদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ ৯০ শতাংশের থেকে কমে গেলে শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। তাই করোনা আক্রান্তের বিশেষ কোনও শারীরিক উপসর্গ না থাকলে রোগীকে বাড়িতে আলাদা রেখে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। তবে রোগীর অন্যান্য শারীরিক উপসর্গের উপর খেয়াল রাখতে হবে। পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মাপতে হবে। যদি অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩% বা তার থেকে কম হয় তা হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে ব্লাড থিনার ও দরকার হলে অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে বলে অভিমত দুই চিকিৎসকের।
আরও পড়ুন: এই মশলায় হরেক গুণ, এতেই জব্দ করোনা?
৪. ওষুধ প্রসঙ্গে দীপঙ্কর সরকার জানালেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাস ঘটিত অসুখে ওষুধের ব্যবহার সীমিত। কেননা ডেঙ্গি বা অন্যান্য ভাইরাস ঘটিত অসুখ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেলফ লিমিটিং। কিন্তু কোভিড-১৯ যে শুধু চট করে সারে না তা নয়, মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই ওষুধ নিয়ে সবাই চিন্তিত। কিছু কিছু ওষুধ যা ভাইরাস ঘটিত অসুখের জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেগুলোই করোনা রোগীদের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে এগুলো যে করোনার জন্যই আবিষ্কার করা হয়েছে তা কিন্তু নয়। র্যামডেসিভির ওষুধটি ইবোলার জন্য বানানো হয়েছিল আর ফ্ল্যাভিপিরাভির মূলত ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ। করোনার চিকিৎসায় এই দু’টি ওষুধ ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে, জানান সুবর্ণ গোস্বামী।
৫. করোনা আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর কারণ শুধুই যে কোভিড-১৯ ভাইরাস তা কিন্তু নয়। অনেক সময় রোগীর শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাইটোকাইন স্ট্রম তৈরি করায় রোগী মারা যান। এ ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়, বললেন দীপঙ্কর সরকার।
৬. কোভিড-১৯ আক্রান্তের শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া হলে ভেন্টিলেশন দেওয়ার সময় প্রন পোজিশন, অর্থাৎ রোগীকে উল্টো করে শুইয়ে চিকিৎসা করা হলে রোগী দ্রুত আরাম পান, বললেন সুবর্ণবাবু। তাই করোনার রোগীদের প্রন পোজিশনে ভেন্টিলেশন দেওয়া উচিত। ‘‘স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের ফুসফুসের কিছু অংশ কম কাজ করে, আমরা বলি ডিপেন্ডেন্ট পার্ট অব লাংস’’, বললেন দীপঙ্করবাবু। যখন দাঁড়িয়ে থাকি, তখন ফুসফুসের নীচের অংশ এবং যখন সোজা হয়ে শুয়ে থাকি তখন ফুসফুসের পিঠের দিকের অংশে অপ্রয়োজনীয় জিনিস থিতিয়ে পড়ায় কর্মক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে কম থাকে। সোজা হয়ে শুইয়ে ভেন্টিলেশন দিলে অক্সিজেন ও ওষুধ ফুসফুসের পেছনের অংশে পৌঁছয় না। উল্টো দিক করে শুইয়ে, অর্থাৎ রোগীর ‘পশ্চার’ বদলে ভেন্টিলেশন দিলে রোগীর ফুসফুসের পেছনের অংশে ওষুধ ও অক্সিজেন পৌঁছে যায়। ফলে কষ্ট কমে ও রোগী দ্রুত সুস্থ হওয়ার দিকে এগিয়ে যান।
তবে কোভিড-১৯ প্রতিরোধের দিকে বেশি জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা। এই জন্য মানুষে মানুষে অন্তত ৬ ফুট দূরত্ব রক্ষা করার পাশাপাশি হাত সাবান দিয়ে ধোওয়া, নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা, ভিড়ের জায়গা এড়িয়ে চলা ও অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যাওয়ার নিয়ম কঠোর ভাবে মেনে চলতে পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy