Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Slow Living

এই রোকো... পৃথিবীর গাড়িটা

একটু থেমে, ভেবে দেখার সময় হয়েছে। ইঁদুরদৌড়ের জীবন ছেড়ে সচেতন জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখায় স্লো লিভিং। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে এর বিকল্প নেই।

An image of a family

আপনি জীবনে কী চান, কোন কাজে সুখী হন, সেই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়াই স্লো লিভিংয়ের মূল লক্ষ্য। ছবি: জয়দীপ দাস।

নবনীতা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৩ ০৮:২৬
Share: Save:

একটা অদৃশ্য ট্র্যাকে আমরা দৌড়ে চলেছি দিবারাত্র, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা। সেই ট্র্যাকের কোনও শেষ নেই, দৌড়ের শেষে কেউ দাঁড়িয়ে নেই ট্রোফি নিয়ে, কেউ বলেওনি আমাদের দৌড়তে। কিন্তু সারা সপ্তাহ আমরা দৌড়চ্ছি। সপ্তাহান্তে এক দিনেই যাবতীয় সুখ কিনে নেব কোনও শপিংমলে বা পাঁচতারা হোটেলে। বিকেলের ছাদ নেই, সন্ধের রকে আড্ডা নেই, গাছগাছালির ছায়া নেই। আছে শুধু দৌড়, রাতদুপুরে বাড়ি ফেরা, ক্লান্ত শরীরে কালি-চোখে ফোন-স্ক্রলে কিছু সুখী ছবি দেখা। আর যথাসম্ভব আরাম-বিলাসের আয়োজন, তা সে প্রকৃতি ধ্বংস করে হলেও।

কিন্তু আমরা কি আদৌ সুখী হচ্ছি? তৃপ্ত বোধ করছি এই যাপনে? তার চেয়ে একটু ধীরেসুস্থে জীবনের প্রত্যেক পর্যায়কে স্পর্শ করে, তার স্বাদ-গন্ধ নিয়ে এগোনো কি ভাল নয়? ঠিক এই ধারণা থেকেই জন্ম হয়েছে স্লো লিভিং মুভমেন্ট। শুরুটা ইটালিতে, ১৯৮০। রোম-শহরের ঠিক মাঝখানে একটি ফাস্ট ফুড স্টল খোলা হল। প্রতিবাদে সরব হতে জড়ো হলেন সমাজকর্মীরা। ফাস্ট নয়, বরং স্থানীয় উৎপাদিত খাবারের প্রচারই ছিল লক্ষ্য। ফাস্ট ফুডের বদলে সেই স্লো ফুড কনসেপ্ট থেকেই স্লো লিভিং ধারণার জন্ম।

স্লো লিভিং কী ভাবে সম্ভব?

আপনি জীবনে কী চান, কোন কাজে সুখী হন, সেই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়াই স্লো লিভিংয়ের মূল লক্ষ্য। দিনের সিংহভাগ ইঁদুরদৌড়ে ব্যস্ত থেকে, জীবনের সব আনন্দ বিসর্জন দেওয়ার পরিপন্থী এই ধারণা। জীবনের গতি একটু কমাতে হবে, চারপাশের পৃথিবীটাকে দেখে-বুঝে এগোতে হবে। তবে মনে রাখা দরকার যে, স্লো লিভিং মানে খুব ধীরগতিতে সব কিছু করা নয়। আলস্যও নয়। ‘স্লো’ ইংরেজি শব্দটাকে ভাঙলে চারটি শব্দ পাওয়া যায়। এস মানে সাসটেনেবল, এল মানে লোকাল, ও মানে অরগ্যানিক ও ডব্লিউ মানে হোল। যে জীবনধারা দীর্ঘস্থায়ী, পরিবেশ-প্রকৃতিকে ধরে রাখে, স্থানীয় উৎপাদিত দ্রব্য ব্যবহারে উৎসাহ দেয়, অরগ্যানিক অর্থাৎ প্রাকৃতিক এবং হোল অর্থাৎ প্রসেসড খাবার বা দ্রব্য নয়, এমন একটা জীবনধারাই স্লো লিভিংয়ের উদাহরণ। প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে আরাম ও বিলাসিতার কথা বলে না স্লো লিভিং। প্রকৃতির সমানুপাতে এগোনো একটা জীবন। সেখানে সময়ের সঙ্গে আপনিও এগোবেন, প্রকৃতিও তার বাড়বৃদ্ধির পরিসর পাবে। কিছু উদাহরণ তুলে ধরলে হয়তো ধারণা স্পষ্ট হবে।

কোন সুদূর সেই স্বপ্নপুর...

বীরভূমে প্রকৃতির মাঝে সংসার সাজিয়েছেন দেবল মজুমদার। বিদেশে চাকরি নিয়ে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটছিল তাঁর। কিন্তু মনে যেন সুখ ছিল না। তাঁর কথায়, “কাজশেষে রাতে বাড়ি ফিরে এত ক্লান্ত থাকতাম যে, বাড়িতে সময় দিতে পারতাম না। যে জীবনটা কাটাচ্ছিলাম, সেটায় আনন্দ ছিল না। সব ছেড়ে দেশে ফিরে আসি। এখানে মাটির বাড়ি বানিয়েছি। সেখানেই আমরা থাকি। এসি ব্যবহার করি না। কিন্তু বাইরের থেকে প্রায় ১৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কম তাপমাত্রা থাকে ঘরে। একে মাটির বাড়ি, তার উপরে ছাদটা একটু উঁচুতে, ফলে বাড়ি ভীষণ ঠান্ডা থাকে।” দৈনন্দিন কাজও এমন ভাবে করেন, যাতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কম হয়। কাছাকাছি যাতায়াতের জন্য ভরসা রাখেন সাইকেলে। বাড়ির জমিতেই প্রয়োজনীয় আনাজপাতি ও চাল-ডাল ফলান দেবল। সাসটেনেবল জীবনের ছবি পাওয়া যায় দেবলের যাপনে।

বিন্নি চালের ভাত আর লাউপাতায় কই

আবার লোকাল বা স্থানীয় খাবারেই দিন গুজরান হয় অমৃতার। কলকাতার বাসিন্দা অমৃতা ভট্টাচার্য পড়াতেন চারুচন্দ্র কলেজে। কিন্তু সে সব ছেড়ে তিনি এখন থাকেন বল্লভপুরে। ছোট থেকেই প্রকৃতি ও গাছগাছালির সঙ্গে তাঁর সখ্য। শহরে মন টিকছিল না। ফলে বল্লভপুরে চলে আসেন। অমৃতা বললেন, “এখানে থাকতে শুরু করে দেখলাম, স্লো ফুড ধারণাটা আলাদা করে আমাকে ভাবতে হয় না, এর মধ্যেই আমি ঢুকে পড়েছি। কলকাতায় পাড়ার দোকানেই সব পেয়ে যেতাম। কিন্তু এখানে আমার সবচেয়ে কাছের মুদি দোকানটাও প্রায় কয়েক কিলোমিটার দূরে। চট করে যাওয়া যায় না। গেলেও সব পাওয়া যায় না। তাই দোসা করব ভাবলে আগের রাতে চাল ভেজাতে হবে। টক দইটাও পেতে নিতে হয়। দুধ থেকে কোনও দিন ছানা, কোনও দিন ঘি, কোনও দিন মোজ়ারেলা চিজ় তৈরি করছি। আবার নিজের বাগান থেকেই কত কী রান্না হয়ে যায়। এখানে নানা রকম শাক সহজলভ্য। গিমে শাক, কুলেখাঁড়া আরও কত শাক খাওয়া হয়। মুসুর ডালে কুলেখাঁড়ার পাতা কুচিয়ে খাওয়া এখানে এসেই শিখেছি। কোনও দিন রাঁধতে না ইচ্ছে করলে সব মশলা মাখিয়ে লাউ পাতায় মাছ (কই) মুড়ে কাঠকয়লার নিভু আঁচে দিয়ে দিই। রান্না হয়ে যায়।”

নিরিবিলি এই গ্রামে যেহেতু নিজের ঘরের জিনিসই ভরসা, তাই ঘরোয়া জিনিস দিয়েই টুকিটাকি অনেক কিছু তৈরি করতেও শিখেছেন। তাঁর কাছেই জানা গেল, পাকা কলার খোসা রোদে শুকিয়ে সেটা পুড়িয়ে যে ছাই পাওয়া যায়, সেটা জলে মিশিয়ে ছেঁকে নিয়ে অ্যালক্যালি পাওয়া যায়। ডাল সুসিদ্ধ করার জন্য কুকিং সোডার বদলে এটা মেশানো যায়। “আবার আখের গুড়ের জল এখানে ন্যাচারাল স্যালাইনের মতো সারা গরমে খাওয়া হয়। আদিবাসীদের কাছ থেকে শাকপাতা সংরক্ষণ করাও শিখেছি। ওঁরা শীতশেষে সরষে শাক তুলে রাখেন। তার পর শুকিয়ে সবুজ পাউডারের মতো গুঁড়ো করে সংরক্ষণ করেন। সেটা খাওয়া হয় বর্ষায়, প্রায় চার মাস পরে। আমিও একই ভাবে পলতা পাতা স্টোর করি। বেশ কয়েক মাস সেটা খাওয়া যায়। আমার মতে, স্থানীয় যা পাচ্ছি, সেটা খেলেই আমার দৈনন্দিন চাহিদা যদি মিটে যায়, বাইরের জিনিস খাব কেন? অ্যাভোকাডো না খেয়ে পেয়ারাও তো খাওয়া যায়,” হাসতে-হাসতে বললেন অমৃতা।

পলাশছোপানো পোশাকে

একই মনোভাব প্রকাশ পেল ফ্যাশন ডিজ়াইনার সুমন মজুমদারের কথায়। সুমন-সেঁওতি দু’জনে ‘দর্জি শান্তিনিকেতন’ নামে সাসটেনেবল পোশাকের বিপণি তৈরি করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য পরিবেশবান্ধব উপায়ে পোশাক তৈরি করা। সুমন বললেন, “বছরখানেক আগে যমুনা নদীর দূষণ নিয়ে যখন খবর হচ্ছিল, সেটা আমায় ভীষণ ভাবায়। এ দেশের নদীদূষণের প্রায় ষাট শতাংশই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অবদান। গোড়াতেই ঠিক করি, এই দূষণের ভাগীদার আমরা হব না। আমাদের প্রত্যেকটি পোশাকে ন্যাচারাল ডাই ব্যবহার হয়। কোনও রাসায়নিক রং ব্যবহার করি না। আর পুরো কাজটাই হয় লোকালি। মুর্শিদাবাদ বা ওড়িশা থেকে হ্যান্ডস্পান সুতো কিনি। সেটা স্থানীয় তাঁতিরা হ্যান্ডলুমে বুনে ফ্যাব্রিকটা তৈরি করে দেন।” আর একটা দিকও উল্লেখ করলেন সুমন, “পোশাক ইন্ডাস্ট্রিতে একটা পোশাক প্রায় তিনবার ওয়াশ করা হয়। একবার উইভিংয়ের পরে, একবার পোশাকের স্টিচের পরে। দরকার হলে আরও একবার। কিন্তু আমরা শুধু সুতো ডাই করার পরে ওয়াশ করি। তার পর আর করি না। এতে দু’বার জল সাশ্রয় হয়। পোশাক তৈরির পরে কাটপিসও ফেলি না। সেগুলো জুড়ে প্যাচওয়ার্ক করেও পোশাক বানাই।” ফলে অনেক বেশি অরগ্যানিক তাঁদের পোশাক। সকলে যে সবটুকু করতে পারবেন, এমন নয়। কিন্তু যে যার মতো করে চেষ্টা করতে পারি, যেমন দেবল, অমৃতা, সুমন-সেঁওতিরা করছেন।

জরুরি পদক্ষেপ

কিছু পদক্ষেপ কিন্তু নগরজীবন থেকেও শুরু করা যায়।

বাড়ির বারান্দা বা ছাদে আনাজপাতির বাগান করা যায়। বাজার হয়ে যাবে সেখান থেকে।

আর্টিফিশিয়াল ফ্যাব্রিকের বদলে সাসটেনেবল পোশাক বাছা যায়। দশটা ফ্যাশনেবল পোশাকের বদলে একটা পরিবেশবান্ধব পোশাক বাছতে হবে।

এক দিন নাহয় এসিটা বন্ধ করে জানালা খুলে ঘুমোলেন।

ফাস্ট ফুডে ভরসা না করে একটু সময় নিয়ে একটা পদই রাঁধুন।

মাসে একটা করে গাছ (অবশ্য ছায়াপ্রদানকারী বড় গাছ) লাগানো যেতেই পারে।

প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, পরিবর্তে কাপড়ের ব্যাগ।

স্ক্রিনে নয়, পরিবারকে সময় দিন।

বেড়াতে গেলে ফ্লাইটের বদলে ট্রেনজার্নি উপভোগ করুন।

আসলে একটু গতি কমাতে হবে। একটু ভাবতে হবে। প্রকৃতি থেকে যেমন আমরা আহরণ করে বাঁচছি, তেমন প্রকৃতিকে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও আমাদেরই। সেটুকু বোধ তৈরি করে এই স্লো জীবনযাপন। পৃথিবীটা ছুটে চলেছে ফাইভ জি স্পিডে। কিন্তু কোন দিকে? আদৌ কি সে দিকে আছে ভবিষ্যৎ? পুঁজিবাদের দাস হয়ে না থেকে নিজেদের অস্তিত্বসঙ্কট নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। বিজ্ঞাপনের চাকচিক্যে ভুলে না গিয়ে সারবত্তা খুঁজতে হবে। প্রকৃতির ক্ষতি করেও ভোগবিলাস চলবে না আর। এখন প্রশ্ন টিকে থাকার। একটু-একটু করে প্রকৃতির দিকে ফিরতে হবে। পৃথিবীটাকে তার রূপ-রস-গন্ধ ফিরিয়ে দিতে পারলে তার ভাগ তো আমরাই পাব। তাই এ বার একটু থেমে ভাবুন তো, কী-কী বদল আনা যায় আপনার রোজযাপনে।

মডেল: সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়, অঙ্কিত রাজপুত সিংহ, তৃষানজিৎ চৌধুরী; ছবি: জয়দীপ দাস।

অন্য বিষয়গুলি:

family Healthy Lifestyle
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy