মুঠোভরে: স্কুল থেকে বেরিয়ে মোবাইলে বুঁদ খুদেরা। ছবি: সুমন বল্লভ
কোনও বাক্যেরই পুরোটা ঠিক করে লিখতে পারছিল না বছর আটেকের ছেলেটি। ‘আই ওয়ান্ট টু গো হোম’ লিখতে বললে সে লিখছিল— ‘আই ওয়ান্ট হোম’। অর্থাৎ মাঝখানের কয়েকটি শব্দ ডিঙিয়ে পরের শব্দে চলে যাচ্ছিল সে। শুধু তা-ই নয়। একটানা ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতেও সমস্যা হচ্ছিল তার। বই থেকে পড়তে বললেও সমস্যা। সে ক্ষেত্রে ছেলেটি এত দ্রুত গতিতে পড়ে যাচ্ছিল যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে নিজেই তার অর্থ বুঝতে পারছিল না।
কেন এমন হচ্ছে, তা জানতে হাতের লেখা বিশারদের কাছে ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার অভিভাবকেরা। সেখানেই তার হাতের লেখা পরীক্ষা করা জানা যায়, ছেলেটি ‘গ্যাজেট ইনডিউসড বিহেভিয়েরাল ডিজ়অর্ডার’-এ ভুগছে। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের আট থেকে সতেরো বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের প্রায় ৪০ শতাংশই বর্তমানে এই রোগে আক্রান্ত। অত্যধিক মোবাইল ফোনের ব্যবহার অথবা টিভি দেখাই যার মূল কারণ। মানসিক রোগ চিহ্নিতকরণ এবং তা ব্যাখ্যা করার আন্তর্জাতিক মনস্তত্ত্ব অভিধানে গত বছর থেকে তাই নতুন ভাবে ঠাঁই পেয়েছে এই রোগটি।
হাতের লেখা বিশারদ বা গ্রাফোলজিস্ট মোহন বসু জানাচ্ছেন, শহরের খুদেদের মধ্যেই ক্রমশ এই সমস্যা বাড়ছে। এই রোগের ক্ষেত্রে বাচ্চাদের মস্তিষ্ক ‘ডিজিটাল স্পিড’ বা গতির সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে যে, তারা আর বাস্তব জীবনের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। কারণ, বাস্তবের কোনও ঘটনার গতি স্বাভাবিক ভাবেই মোবাইল গেম বা টেলিভিশনের যে কোনও গতির থেকে কম হয়। কিন্তু এই যন্ত্রগুলির অত্যধিক ব্যবহার শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের নিউরোট্রান্সমিটারের উপরে প্রভাব ফেলে। তখন তার মস্তিষ্ক ডিজিটালের সেই দ্রুত গতির সঙ্গেই খাপ খাইয়ে নেয়। ‘হাই স্পিড ট্রান্সমিশন’ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক গতি পাল্টে দেয়।
ফলে দেখা যায় যে, সেই শিশু বা কিশোর যখনই কোনও কম গতির কাজ করছে বা লিখছে-পড়ছে, তখন তার মস্তিষ্ক সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। ফলে পড়ার সময়ে কয়েকটি অক্ষর বা শব্দ বেমালুম ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার ঠিকঠাক ভাবে লিখতেও পারছে না। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইলের ব্যবহারে হাত ও চোখের মণির সমন্বয় (কোঅর্ডিনেশন) পাল্টে যাচ্ছে তার। ফলে ঠিক করে লিখতে পারছে না। মোহনবাবুর কথায়, ‘‘এসব ক্ষেত্রে শিশু ও কিশোরদের ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডার’ দেখা দেয়। এমনিতে হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডার সাধারণত উত্তরাধিকার সূত্রে আসে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মোবাইল বা ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র ব্যবহারের কারণেই এই রোগ হয়।’’
বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও জানাচ্ছেন, ইদানীং ক্লাসে এই ধরনের সমস্যা নিয়ে অনেক শিশুকেই দেখছেন তাঁরা। অভিভাবকেরাও গোড়ায় সমস্যার উৎস ধরতে পারছেন না। এক অভিভাবক বলছেন, ‘‘ছেলের বয়স দশ বছর। হঠাৎ খেয়াল করেছিলাম, ও একটা বাক্য পুরো লিখতে পারছে না। একটা শব্দ ডিঙিয়ে আর একটা শব্দে চলে যাচ্ছে।’’ আর এক অভিভাবক বলছেন, ‘‘স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে যা লেখা হত, সেটা পুরো টুকতে পারছিল না মেয়ে। কয়েকটি অংশ ছেড়ে দিয়ে লিখে আনছিল। অথচ তার বন্ধুরা পারছিল।’’ তবে তাঁরা জানালেন, টানা কাউন্সেলিং এবং মোবাইলের ব্যবহার কমানোর পরে আপাতত তারা স্বাভাবিক ভাবে পড়াশোনা করছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনোরোগ চিকিৎসক এডওয়ার্ড হ্যালওয়েল এক সময়ে বলেছিলেন, ‘ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া’ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক গতি পাল্টে দিয়েছে। সেই সূত্র ধরেই মনোবিদ নীলাঞ্জনা স্যান্যাল যেমন বললেন, ‘‘মোবাইল গেম বা টেলিভিশনের যে কোনও কিছুর গতির সঙ্গে মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হয়ে গেলে ছোটরা বেশি ঝোঁকের মাথায় কাজকর্ম করতে থাকে। যেহেতু ঝোঁক ও যুক্তি পরস্পরবিরোধী, তাই তারা যুক্তির জগৎ থেকে ক্রমশ বিযুক্ত হতে থাকে।’’
তা হলে গতির এই ফাঁদ থেকে মুক্তির উপায়? বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বাস্তব জীবনে যে কোনও খেলাধুলো, তা সে ঘরে বা মাঠে যেখানেই হোক না কেন, তাতে ফিরতে হবে ছোটদের। অর্থাৎ মোবাইল স্ক্রিন থেকে বেরোতেই হবে। না হলে ডিজিটাল ও বাস্তব জীবনের গতির এই ফাঁক থেকেই যাবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy