সঞ্চিত অর্থেই কোভিড আক্রান্তদের খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন রাজীব। নিজস্ব চিত্র
মাস্ক, সাদা গেঞ্জি আর সাধারণ ট্রাউজার পরা একজন হোটেলের ঘরে খাবারের বাস্ক সাজিয়ে চলেছেন। অত্যন্ত যত্নে প্রতিটি বাক্সে ভরে চলেছেন খাবার। দেখে মনে হচ্ছে, বড় কোনও অর্ডার। কিন্তু আসলে তা নয়। লকডাউনে ক্রেতাদের কোনও অর্ডার নেই এই হোটেলে। যিনি এই কাজটি করছেন, তিনিও রোজগারের জন্য করছেন না। করছেন ভালবাসার তাগিদে।
খাবারের বাক্স সাজিয়ে চলা মানুষটি এই হোটেলের মালিক রাজীব রামপাল। কোভিড রোগীদের জন্য পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু খাবার বাক্সে ভরে রাখছেন তিনি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর থেকে এ ভাবেই করোনা রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজীব।
চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোডে রাজীবের একটি হোটেল কাম রেস্তরাঁ রয়েছে। করোনার জন্য দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যবসায় ভাটা চলছে তাঁর। তার উপর লকডাউনের জেরে হোটেল এখন বন্ধ হয়ে রয়েছে। অথচ ক্রেতাহীন এই হোটেলে দু’বেলা রান্না চলছে। সেই রান্না পৌঁছে যাচ্ছে চুঁচুড়ার করোনা আক্রান্ত পরিবারের কাছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
দুপুরে ভাত, ডাল, ভাজা, তরকারি, মাছ (মাংস অথবা ডিম) এবং রাতে রুটির সঙ্গে থাকছে তরকা বা আলুরদম, চিকেন স্যালাড ইত্যাদি। রীতিমতো এলাহি আয়োজন। গত ১৩ মে থেকে এ ভাবেই আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। আপাতত ৪১ জনকে দু’বেলা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। যে সমস্ত আক্রান্তদের বাড়িতে রান্নার সমস্যা রয়েছে, তাঁরা ফোনে সরাসরি যোগাযোগ করছেন। তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে খাবার।
রাজীব জানালেন, সপ্তাহে ৫ দিন আমিষ রান্না হয় তাঁদের জন্য। আর ২ দিন নিরামিষ। আমিষের মধ্যে কাতলা মাছের ঝাল থেকে শুরু করে সহজপাচ্য মাংসের ঝোল যেমন রয়েছে, তেমন হোটেলের জনপ্রিয় পদ কাবাবও রয়েছে।
আগাগোড়া এই এলাকার লোক নন তাঁরা। তাঁর পূর্বপুরুষের বাস অমৃতসরে। রাজীবের দাদু ব্রিটিশ আমলে অমৃতসর থেকে চুঁচুড়ায় এসেছিলেন। তখন থেকে এখানেই। ধীরে ধীরে চুঁচুড়ার নামজাদা ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন তাঁরা। তবে গোড়ায় জীবন এত মসৃন ছিল না। প্রথম জীবনে তাঁর বাবা বাস চালাতেন। সংসারে প্রবল অভাব ছিল। অনটনকে খুব কাছ থেকে দেখেই বড় হয়েছেন রাজীব। পরে অবশ্য তাঁর বাবা বাসের ব্যবসা শুরু করেন। আর্থিক ভাবে অনেকটাই সাবলীল হয়ে ওঠেন তাঁরা।
রাজীবের জন্ম এই চুঁচুড়াতেই। এখানেই পড়াশোনা। তার পরে পাকাপাকি ভাবে ব্যবসা নেমে পড়েন। চিরকালই মানুষের সেবা করতে আগ্রহী তিনি। করোনার প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়তেই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেননি। মাস্ক, স্যানিটাইজার দিয়ে এলাকাবাসীকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু এ বারের পরিস্থিতিটা গতবারের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। এ বারে মানুষ যেন আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন। রাজীবের কথায়, “দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাড়ির কোনও সদস্য আক্রান্ত হলে ধীরে ধীরে সেই বাড়ির প্রত্যেকেই আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে বাড়িতে রান্না বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মূলত তাঁদের কথা ভেবেই আমার এই সিদ্ধান্ত।”
চুঁচুড়া প্রতাপপুরের একটি পরিবার যেমন রাজীবের মানবিক রূপে আপ্লুত। সেই পরিবারের করোনা আক্রান্ত এক সদস্য দীপা পুরকাইত বলেন, “গত এপ্রিলে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছি। তার পরে একে একে পরিবারের সকলে করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। বাড়িতে রান্না বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে রাজীবের সাহায্য না পেলে খুব সমস্যা হত।”
ব্যবসা বন্ধ। উপার্জন নেই। তার উপর সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবারের জোগান দিতে হচ্ছে নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকেই। এতে অবশ্য বিচলিত নন রাজীব। অর্থের থেকে মানুষের ভালবাসা তাঁর কাছে অনেক দামি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy