যাবতীয় কোভিড-তথ্য একসঙ্গে পেয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন মোনালী।
দিন শুরু হয় সকাল ৯টা থেকে। প্রায় ৩০০টা হাসপাতালে ফোন করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। প্রত্যেকটায় খোঁজ নিচ্ছেন, ক’টা বেড রয়েছে, আইসিইউ কেবিন রয়েছে কিনা, অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে কি না। সঙ্গে সঙ্গে সেই তথ্য উঠে যাচ্ছে ওয়েবসাইটে। ঠিক ক’টা নাগাদ এই তথ্য যাচাই করা হয়েছিল, থাকছে সেই সময়ও। এই কাজ চলতে থাকে রাত ১২টা-১টা-২টো পর্যন্তও। মানুষকে বিপদের সময়ে যেন হয়রান না হতে হয়, সেটাই মূল লক্ষ্য।
কোভিড লড়াইয়ের জন্য যাবতীয় তথ্য যেন এক জায়গায় মানুষ পেয়ে যান, সেই ভাবনা থেকে এই বিশাল কাজ শুরু করেছিলেন চিকিৎসক মোনালী সেনগুপ্ত। তাঁর সঙ্গী ছিলেন আরও কিছু চিকিৎসক। ৪-৫জন মিলে শুরু করেছিলেন একটি হোয়াট্স্যাপ গ্রুপ। এক সপ্তাহের মধ্যে ৫ থেকে সংখ্যাটা ৫০ হয়ে ২৫০ হয়ে ৬০০ হয়ে গেল! কে কী করে এলেন, তা নিজেও জানেন না মোনালী। তবে তাঁর ছোট্ট প্রয়াস বড় করে তুলতে যে প্রচুর মানুষ এগিয়ে এসেছেন, তাতেই তিনি আপ্লুত। এখন সেই গ্রুপে স্কুল-কলেজপড়ুয়া, রে়ড ভলান্টিয়ার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল— সকলেই রয়েছেন। সকলেই নিজের মতো করে চেষ্টা করছেন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে।
হোয়াট্স্যাপ গ্রুপ এত বড় হয়ে যায় যে সেটা ৩ ভাগে ভাগ করে দিতে হয়। কোভিড পরীক্ষা কোথায় হবে, ওষুধ কোথায় পাওয়া যাচ্ছে, অক্সিজেন সিলিন্ডার কোথায় মিলবে, কোন হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে, কার বাড়িতে মুদিখানার জিনিস পৌঁছে দিতে হবে, কারা কোভিড রোগীদের জন্য রান্না করছেন— সব রকম তথ্য জড়ো করা হতো এই গ্রুপে। তার পরে সেগুলো যাচাই করা হতো, যাতে ভুল নম্বরে ফোন করে মানুষকে হয়রান না হতে হয়। যার যখন যা প্রয়োজন হবে, তা যেন সহজেই এই গ্রুপ থেকে পেয়ে যান। এই ব্যবস্থা করছিলেন মোনালী এবং তাঁর সঙ্গীরা। কিন্তু ক্রমে সেই তথ্য অনেক বেশি হয়ে গেল। তখন মোনালীরা ঠিক করেন একটা ওয়েবসাইট তৈরি করবেন। আমেরিকা, বেলজিয়াম, তুরস্ক থেকে যাঁরা দেশের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরাই এগিয়ে এলেন ওয়েবসাইট তৈরির কাজে। কেউ চ্যাটবট তৈরি করলেন। কেউ সোশ্যাল মিডিয়ার টিম বানালেন। আরও ছোট ছোট দল এই ধরনের কাজ করছে। কেউ তাদের সকলকে এক ছাতার নীচে আনতে সাহায্য করলেন। সব মিলিয়ে তৈরি হল http://www.wbcan.org
এপ্রিল মাস পর্যন্ত নিত্য রোগী দেখতেন মোনালী। কিন্তু তার পরেই তিনি কোভিড আক্রান্ত হন। সেই সঙ্গে আক্রান্ত হন তাঁর পরিবারের বাকি সকলেও। ‘‘আমার যখন কোভিড হয়েছিল, তখন খুব অসহায় লাগত নিজেকে। রান্না করার শারীরিক বা মানসিক অবস্থা ছিল না। মনে হতো অন্য মানুষের উপকার করতে গিয়ে নিজের বাড়ির লোককে বিপদে ফেললাম। রোজ মনে হতো, হঠাৎ কোনও বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে কার সঙ্গে যোগাযোগ করব? কারই বা সাহায্য পাব! নিজের কোভিড হওয়ার পরে প্রথম বুঝলাম এই রোগ হলে মানুষের মনের অবস্থা কী হয়। আমার মতো অসহায় যেন কাউকে না হতে হয়, সেই কারণেই আমি এই তথ্য জোগাড় করে একটা নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ শুরু করি। রাত ২টো-৩টে পর্যন্ত কাজ করতাম প্রথম দিকে। অনেকে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, কোভিডের পরেই এতটা চাপ নেওয়া ভাল নয়। কিন্তু মনে হয়েছিল যখন বেঁচে গেলাম, নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। ঠিক করলাম বাকিদের সাহায্য করবই,’’ বললেন মোনালী।
এখন তাঁর ওয়েবসাইট অনেকটাই বড়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ছাড়া প্রবাসীরা নিত্যদিন তাঁর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সাহায্য করছেন নিজেদের আত্মীয়দের। অনেক ছোট ছোট দল হাত মিলিয়েছে মোনালীদের সঙ্গে। তবে গোটা পথটা খুব সহজ ছিল না। ‘‘হাসপাতালের বেড জোগাড় করতে করতেই কতজনের মৃত্যু হয়েছে। শত চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। আমরা যাঁরা স্বাস্থ্যকর্মী, তাঁরা মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। কিন্তু কম বয়সিরা এতে খুব ভেঙে পড়ত। মাঝরাতে ফোন করে কান্নাকাটি করেছে। অনেকের মনে এটা এতটা প্রভাব ফেলে যে, তাঁরা হ্যালুসিনেট করা শুরু করে। তখন আমরা মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখার কর্মশালার কথা ভাবি,’’ বললেন মোনালী। এ ছাড়াও বাধা অনেক রকমই ছিল। কোনও মানুষ প্রচুর পরিমাণে ওষুধ কিনে বাকিদের অসুবিধা সৃষ্টি করছে। কেউ অক্সিজেনের কালোবাজারি করছে। কেউ অক্সিজেন সিলিন্ডার ফেরত দিচ্ছে না— এই ধরনের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে মোনালীদের। মোনালীর এই উদ্যোগে কাজ করেছেন বহু মানুষ। কিন্তু উৎকর্ষ বেদেকর, চিকিৎসক মহেন্দ্র বণিক এবং দেব ঋষি ব্রহ্ম এই কাজের সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে। তাঁরা সকলেই আশা করছেন, তৃতীয় তরঙ্গ আসার আগে সব সমস্যাই আরও কিছুটা কমিয়ে ফেলতে পারবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy