কোভিড রোগীদের জন্য তিনবেলা রান্না করছেন ত্রি। নিজস্ব চিত্র
রিহার্সাল নেই। মেকআপ করা, চুল বাঁধার তাড়া নেই। নাচের সাজপোশাক আলমারিতে বন্দি প্রায় দেড় বছর। মঞ্চের আলো দেখা হয়নি বহু দিন। নাচের দলের সঙ্গে নানা শহরে ঘুরে শো করা তিনি ভুলেই গিয়েছেন। একটা অনলাইন বস্ত্রবিপণি ছিল বাড়তি উপার্যনের জন্য। কিন্তু যেখানে মানুষ অক্সিজেন-ওষুধ খুঁজতেই হয়রান, সে অবস্থায় কাউকে নতুন পোশাক কী করেই বা কিনতে বলেন তিনি। হঠাৎই তাঁর ব্যস্ত জীবন কেমন যেন খালি হয়ে যায়। অবসাদ ঘিরে ধরে তাঁকে। ভাল ভাবে বাঁচার উপায় খুঁজতে এক দিন প্রায় মধ্যরাতে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছিলেন। পাড়ার কারও ওষুধ কেনা, বাজার করা, মিস্ত্রি ঢেকে দেওয়া, ডাক্তারের নম্বর জোগাড় করার মতো যাবতীয় জরুরি কাজের জন্য থাকবে ত্রি পালের ‘হেল্পিং হ্যান্ড’।
কিন্তু সেই টুকটাক কাজ করতে গিয়ে দেখলেন, অসুস্থ মানুষদের খাওয়ার বড় সমস্যা। এমনকি যাঁরা আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল, তাঁদেরও এই সময় তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা মুশকিল হয়ে পড়ছে। সেই থেকে ত্রিয়ের কোভিড-ক্যান্টিন শুরু। ২০ মে থেকে এখনও চলছে সেই ক্যান্টিন। প্রত্যেকদিন সকালটা কেটে যায় জলখাবারের ব্যবস্থায়। একদিন অন্তর ৩২ জনের জলখাবার তিনি পাঠান ভারত সেবাশ্রমের সেফ হোমে। তার পর শুরু হয় দুপুরের রান্না। বাঘাযতীন, রানিকুঠি, গল্ফগ্রিন, যাদবপুর এলাকার কোভিড রোগীদের জন্য দুপুরের খাবার শেষ করেই তিনি শুরু করেন রাতের রান্না। খাবার বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন নিজেই সাইকেল করে। কিন্তু লকডাউনে সেই সাইকেলও এক দিন চুরি হয়ে গেল! তাতেও দমে যাননি ত্রি। ফেসবুকে সাহায্য চাইতেই এগিয়ে এলেন প্রচুর তরুণ-তরুণী। কেউ সাইকেল, কেউ বাইক, কেউ গাড়ি করে পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁর রান্না করা খাবার।
কিন্তু রোজগার ছাড়া এত জনের রান্না কী করে করছেন ত্রি? তিনি জানালেন, সংসার চালানোর জন্য কিছু বাচ্চাকে অনলাইনে নাচ শেখান তিনি। যা উপার্যন করেন, তার থেকে এক অংশ তুলে রাখেন বাজার করার জন্য। যাঁদের অবস্থা ভাল, তাঁদের জন্য ‘পেড মিল’এর ব্যবস্থাও রয়েছে ত্রিয়ের। কেউ হয়তো ডেলিভারির জন্য কিছু টাকা দেন। সেই থেকে তিনি বিনামূল্যের মিলগুলোর ব্যবস্থা করে ফেলেন। ত্রি বললেন, ‘‘ফেসবুকে পোস্ট করার পর বহু মানুষ অর্থ-সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা। আমার নাচের দলের বন্ধুদের রোজগার নেই। কিন্তু তারাও কেউ ৫০০, কেউ ৭০০ টাকা করে দিয়েছে। আমার কাছে টাকার অঙ্কটা জরুরি নয়। কেউ ১০ টাকা দিলেও আমার ২টো কলা কিনে দু’জনের জলখাবার হয়ে যাবে।’’
এত জনের রান্না রোজ একা হাতে করেন কী করে? ‘‘ইচ্ছে থাকলেই করা যায়। অনেকে আমায় বলেছিল বাড়ি এসে রান্নায় হাত লাগাবে। কিন্তু এই অতিমারির পরিস্থিতিতে সকলকে বাড়িতে ডাকাও ঠিক নয়। আমি একা থাকলেও বাড়িতে আগে প্রচুর লোক আসত। ১০ জনের রান্না এমনিও অনেক করেছি। আর কয়েক জনের কি করতে পারব না?’’ হেসে বললেন ত্রি। তিনি শুরু করেছিলেন ১০ জনের তিন বেলার খাবার দিয়েই। কিন্তু অনেকে অসহায় হয়ে ফোন করায়, তাঁদের ফেরাতে পারেননি। ‘‘একটা বা়ড়িতে ৩ জনের কোভিড হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়স যাঁর, তিনি ৮০ বছরেরে। একটি মেয়ে অন্য রাজ্য থেকে এসে আটকে গিয়েছে। একাই থাকে। কোভিড হওয়ার পর তার এলাকায় কোনও কোভিড ক্যান্টিন পাওয়া যায়নি। এঁদের কী করে না বলি বলুন তো?’’
আগের তুলনায় পরিস্থিতি এখন অনেকটা ভাল। কোভিড রোগীর সংখ্যা কমেছে। কিন্তু ত্রিয়ের ক্যান্টিন চলবেই। অনেক বয়স্ক মানুষ তাঁর উপরেই ভরসা করে বসে থাকেন। কারও ছেলেমেয়ে বিদেশে, কারও দেখাশোনার লোক লকডাউনে যেতে পারছেন না। তাই রোদ-ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও রোজ ত্রিয়ের খাবার পৌঁছে যায় সাইকেল করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy