হাত ধুতে বলায় ‘পাগল’ আখ্যা পান হাঙ্গেরিয়ার ইগনাজ ফিলিপ স্যামেলওয়াইজ। ইনসেটে সেই চিকিৎসক।
বলেছিলেন স্রেফ হাত ধুতে। বলেছিলেন, প্রসূতিদের পরীক্ষার আগে ভাল করে হাত ধুতে হবে। যে সব যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, সে সবও ধুতে হবে। আর সেই ‘অপরাধ’-এ পিটিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছিল এক চিকিৎসককে!
তিনি হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক ইগনাজ ফিলিপ স্যামেলওয়াইজ। হাত ধুতে শিখিয়েছিলেন বলে যাঁকে পাগল আখ্যা দিয়ে পাঠানো হয়েছিল মানসিক হাসপাতালে।
হ্যাঁ, ১৮৪৭ সালে, যখন জীবাণু নিয়ে কোনও জ্ঞান ছিল না মানুষের, ডাক্তারদেরও নয়, তখন যদি কেউ প্রসূতি মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রেতাত্মার বদলে হাত না-ধোওয়া, যন্ত্রপাতি ঠিক করে পরিষ্কার না করাকে দায়ী করেন, তাঁর মরা কি কেউ আটকাতে পারে! পারে না। এ হল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের লড়াই, যে লড়াইয়ে যুগে যুগে প্রাণ দিয়েছেন তাঁর মতো আরও অনেকে। কী ভাবে শুরু হয়েছিল তাঁর যাত্রা, আসুন দেখে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: র্যাপিড কিটে সম্পূর্ণ সায় নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার, তবু ভারত কেন এই পথে হাঁটছে?
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি। সাধারণ ভাবে যত রোগী মারা যেতেন, তার প্রায় তিন গুণ। চাইল্ড বেড ফিভার নামের সমস্যার রমরমা ছিল তখন। কিছু দিন লক্ষ্য করার পর তাঁর মনে হল সম্ভবত অপরিচ্ছন্নতাই এর কারণ। প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকদের তিনি নির্দেশ দিলেন, গর্ভবতী মহিলাদের পরীক্ষা করার আগে হাত ভাল করে ক্লোরিনেটেড লাইম দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। যে সব যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, সে সবও ধুতে হবে।
কেন, কী বৃত্তান্ত, কিছুই মাথায় ঢুকল না চিকিৎসকদের। কিন্তু উপায় নেই। তাই ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও তাঁরা মানতে বাধ্য হলেন। দেখা গেল, শুধু এটুকুতেই মৃত্যুর হার প্রায় ৯৯ শতাংশ কমে গিয়েছে। গোটা একটা বছরে এক জন রোগীরও মৃত্যু হল না হাসপাতালে। চিকিৎসক স্যামেলওয়াইজ খুব খুশি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বলতে ও লিখতে শুরু করলেন যে এর মূলে রয়েছে পরিচ্ছন্নতা। হাত ও যন্ত্রপাতি ধোওয়া। কিন্তু কেন? জীবাণু সম্বন্ধে ধারণা ছিল না সে সময়। কাজেই স্যামেলওয়াইজ এর কারণ বলতে পারলেন না। কিন্তু নানা রকম পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে লাগলেন। অন্য ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা বেঁকে বসলেন। তবে কি স্যামেলওয়াইজ রোগী মারা যাওয়ার জন্য ডাক্তারদের দোষী সাব্যস্ত করছেন? বেঁকে বসলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।
আজকের হাত ধোয়ার অভ্যাস রপ্ত করাতে চেয়েছিলেন ১৭৩ বছর আগের চিকিৎসক ইগনাজ ফিলিপ স্যামেলওয়াইজ।
হাঙ্গেরিতে নিজের ঘরে ফিরে এলেন স্যামেলওয়াইজ। অনেক ভাবলেন। পরীক্ষানিরীক্ষাও করলেন কিছু। তার পর ১৮৬১ সালে এক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশ করলেন গবেষণামূলক প্রবন্ধ। তাতে তিনি জানালেন, টয়লেট থেকে এসে, ছোটখাটো অপারেশন বা রোগীকে পরীক্ষা করার সময় ডাক্তারদের উচিত হাত ভাল করে ধুয়ে নেওয়া। কারণ এক বার নয়, বহু বার তিনি দেখেছেন, মর্গ থেকে এসে ডাক্তাররা যখন রোগী দেখেন তখন মৃতদেহ থেকে ভয়ঙ্কর কিছু উপাদান রোগীর মধ্যে চলে আসে। তাতেই অনেকে মারা যান। লাভ হল না। ডাক্তাররা তো বটেই, বিজ্ঞানের অন্য শাখার মানুষরাও তখন বিশ্বাস করতেন যে রোগ-শোক-মৃত্যু, সবের মূলেই রয়েছে দুষ্ট আত্মা। মানুষের সাধ্য নেই তাকে অতিক্রম করে। স্যামেলওয়াইজ পাগলের প্রলাপ বকছেন। এমনকি, তাঁর স্ত্রী-ও ভাবতে শুরু করলেন তিনি পাগল হয়ে গিয়েছেন। না হলে এ সব কেউ বলে!
আরও পড়ুন: হৃদরোগীদের করোনা-হানার ভয় কতটা? সুস্থ থাকতে কী কী করবেন?
এ বার ধরে ধরে সব চিকিৎসককে চিঠি পাঠাতে শুরু করলেন স্যামেলওয়াইজ। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের অনুরোধ করলেন, যেন তাঁরা হাত ধুয়ে, যন্ত্রপাতি ধুয়ে তবে রোগী পরীক্ষা করেন, অপারেশন করেন। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর এটাই এক বড় রাস্তা। আর সব জেনেও যদি তাঁরা তা না করেন, ধরে নিতে হবে তাঁরা অজান্তে মানুষ খুন করার মতো অপরাধ করছেন।
পরিস্থিতি চরমে উঠল। সবাই মিলে পাগল বলে দেগে দিলেন তাঁকে। চরম হতাশা থেকে গ্রাস করল অবসাদ। ১৮৬৫ সালে নার্ভাস ব্রেকডাউন হওয়ার পর তাঁকে পাঠানো হল মানসিক হাসপাতালে। সবার অবজ্ঞাই যে তাঁকে এই অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে, তা কেউ বুঝলেন না। বললেন না। বরং বললেন তাঁর ‘নিউরো সিফিলিস’ হয়েছে, কেউ বললেন ভর করেছে আত্মা।
হাসপাতালে চিকিৎসা হওয়া দূরস্থান, শুরু হল মারধর। ১৪ দিনের মাথায় মারের চোটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেন তিনি। কোনও চিকিৎসার সুযোগ পেলেন না, পড়ে রইলেন ও ভাবে। ফলে কয়েক দিনের মধ্যে বিষিয়ে উঠল ক্ষতস্থান। পচন ধরল ডান হাতে, সেখান থেকে বিষ ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে, রক্তে। কার্যত বিনা চিকিৎসায় মাত্র ৪৭ বছর বয়সে সেপ্টিসেমিয়া হয়ে মারা গেলেন তিনি। নীরবে। দিনটা ছিল ১৩ অগস্ট, ১৮৬৫। তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত হলেন না এক জন চিকিৎসকও। হাঙ্গেরিয়ান মেডিক্যাল সোসাইটিতে এক কলমও লেখা হল না তাঁকে নিয়ে।
তা হলে কি হারিয়েই গেলেন তিনি? না। দেরিতে হলেও তাঁর মূল্যায়ন হল লুই পাস্তুরের হাত ধরে। স্বীকৃতি পেল তাঁর গবেষণা। জীবাণু তত্ত্ব, অর্থাৎ জীবাণু থেকে রোগ হতে পারে তা মেনে নিলেন তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল তাঁর নাম। হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট আজও তার স্বাক্ষর বহন করছে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy