সংক্রমণ হওয়ার পরেও মাস্ক বাধ্যতামূলক। ছবি: শাটারস্টক
করোনা যে হয়েছে বা সেরেছে, বা কবে হয়েছে ও কবে সারল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে আজকাল। অতএব, কতদিনে স্বাভাবিক জীবন, প্রশ্ন তা নিয়েও। দুটো উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাবে।
উত্তরবঙ্গের এক চিকিৎসক কোভিড আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন কলকাতার হাসপাতালে। উপসর্গ কমে যায় কয়েকদিনেই৷ কিন্তু পর পর সাতবার আরটিপিসিআর রিপোর্ট পজিটিভ আসে। অষ্টমবার, রোগ ধরা পড়ার ৪০দিন বাদে নেগেটিভ রিপোর্ট পেয়ে তবে বাড়ি যেতে পারেন তিনি। উল্টোদিকে আবার কলকাতার এক বিশিষ্ট চিকিৎসক রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়ায় কোয়রান্টিনে চলে যান এবং করোনাভাইরাসের জন্য সোয়াব পরীক্ষা করান৷ প্রথম রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। কিন্তু উপসর্গ না কমায় কয়েকদিন পর আবার টেস্ট হয়, আবার রিপোর্ট নেগেটিভ। এরপর একদিন আচমকা প্রবল শ্বাসকষ্ট, তড়িঘড়ি তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় হাসপাতালের আইসিইউ-তে৷ সিটি স্ক্যানে দেখা যায় নিউমোনিয়ার সংক্রমণ এবং বিষয়টি গুরুতর৷ আরটিপিসিআর রিপোর্টও পজিটিভ আসে। ভেন্টিলেশনে চলে যান তিনি।
এই তো পরিস্থিতি! কোন রিপোর্ট দেখে বুঝবেন রোগ হয়েছে আর কোনটা দেখে বুঝবেন সেরে গিয়েছে, তা নিয়েই তো সন্দেহ। তার উপর খবর পাওয়া যায়, শহরের ইতিউতি গজিয়ে উঠেছে ভুয়ো পরীক্ষাকেন্দ্র। অভিযোগ, তারা পরীক্ষা না করেই সুবিধামতো পজিটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট দেয়। প্রভাবশালী রোগী হলে পজিটিভ রিপোর্ট দিয়ে হাসপাতালের বিল বাড়ানো হচ্ছে, আর অন্য ক্ষেত্রে হয়তো নেগেটিভ রিপোর্ট দেয়, উপসর্গ না থাকলে তো হয়েই গেল। ফলে চিন্তায় সাধারণ মানুষ, কোন রিপোর্ট ধরে এগোবেন, কতদিন বিশ্রাম নিয়ে তবে কাজে যাবেন বা লিপ্ত হবেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে?
আরও পড়ুন: নিজে থেকে কোভিড টেস্ট করা কতটা জরুরি? কী বলছেন চিকিৎসকরা?
করোনার পর শরীর ঠিক হলে মাস্ক পরে অফিস যেতে পারেন, কাজ করা যায় বাড়ি থেকেও। ছবি: শাটারস্টক
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীর মতে, “এগুলো কিছুটা ব্যতিক্রমী খবর৷ সব সময় যে এরকম হয় এমন নয়। যখন পরীক্ষা হয়েছে সেই মুহূর্তে শরীরে কতটা ভাইরাস আছে তার উপর রিপোর্টের পজিটিভিটি বা নেগেটিভিটি নির্ভর করে। অন্য কারণও থাকতে পারে। তবে সাধারণভাবে, চিকিৎসকের পরামর্শমতো পরীক্ষা করলে এবং তাঁর নির্দেশমতো চললে রোগ নির্ণয় নিয়ে খুব অসুবিধা হয় না। প্রশ্ন জাগে না স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়েও।”
কত দিনে স্বাভাবিক জীবন?
সুবর্ণবাবু জানিয়েছেন, “রিপোর্ট পজিটিভ হওয়ার বা উপসর্গ দেখা দেওয়ার তিন সপ্তাহ বাদে শরীরে ভাইরাল লোড খুব কমে যায়৷ ফলে তখন আর মানুষটি রোগ ছড়াতে পারেন না। আরও সাবধানতা হিসেবে আমরা ২৮ দিন বলি। কারণ এই ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড হল সর্বাধিক ১৪ দিন, অর্থাৎ উপসর্গ হওয়ার আগে ১৪ দিন পর্যন্ত সে শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। এর দ্বিগুণ সময়, অর্থাৎ ২৮ দিন পরেও যদি রিপোর্ট পজিটিভ আসে, মানুষটি কিন্তু নিরাপদ। তাঁর থেকে আর রোগ ছড়ায় না।”
আরও পড়ুন: সাপ্লিমেন্টস নয়, রোজকার এই সব খাবারেই বাড়বে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
করোনা সেরে গেলেও মাস্ক বর্জন করা যাবে না কিছুতেই। ছবি: শাটারস্টক
ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সৌতিক পাণ্ডা বলছেন, “হাসপাতালে ভর্তি কোভিড রোগীর জ্বর বা শ্বাসকষ্ট জাতীয় উপসর্গ তিন দিন না থাকলে তবে তাঁকে ছুটি দেওয়া হয়৷ বলা হয়, বাড়ি গিয়ে আরও সাতদিন সবার থেকে আলাদা থাকতে। অনেকের তারপরেও ক্লান্তি থাকে। তাঁদের আরও কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হয়।কারও কাশি থাকে৷ কারও অ্যালার্জি হয়। কষ্ট কমাতে কিছু ওষুধপত্র দেওয়া হয়। তবে যা-ই থাক না কেন, তাঁদের আর রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা থাকে না। তখন শরীরে কুলোলে মাস্ক পরে অফিস যেতে পারেন।”
আরও পড়ুন: কম ঘুমচ্ছেন না তো? রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্ব দিতেই হবে ঘুমকে
সেরে গেলে আর মাস্ক কেন?
যিনি সেরে গিয়েছেন, তাঁর শরীরে আছে ভাইরাস মারার অস্ত্র অ্যান্টিবডি৷ কাজেই তিনি আর সংক্রামিত হবেন না। তাঁর থেকে অন্য কারও সংক্রমণের আশঙ্কা নেই। কাজেই মাস্ক তথা অন্যান্য সুরক্ষাবিধির প্রয়োজন না থাকারই তো কথা! কিন্তু তা হয় না। চিকিৎসক গোস্বামী জানিয়েছেন, “এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গিয়েছে, তা থেকে বলা যায়, রোগ সেরে যাওয়ার পর অ্যান্টিবডি কার্যকর থাকে ১৫দিন থেকে তিন মাস৷ যেদিন রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে বা উপসর্গ হয়েছে, সেই দিনটিকে ধরে৷ কার ক্ষেত্রে ১৫দিন সুরক্ষা থাকবে আর কার ক্ষেত্রে তিন মাস, তা যেহেতু নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে মেলামেশা করা ঠিক নয়।”
চিকিৎসক পাণ্ডার মতে, “দ্বিতীয়বার রোগ হলে তার মাত্রা কীরকম হবে তা জানা নেই বলে সাবধানে থাকাই ভাল। ডেঙ্গির ক্ষেত্রে যেমন দ্বিতীয়বার রোগের জটিলতা বেশি থাকে, এক্ষেত্রেও যদি তা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপদ আরও বাড়বে।কারণ এই মুহূর্তে ভর্তির সুযোগ নেই প্রায় কোনও হাসপাতালে।”
অর্থাৎ, রোগ সারলেও চিন্তার হাত থেকে মুক্তি নেই৷ বাড়িতে বয়স্ক মানুষ বা কো-মর্বিড কেউ থাকলে তো বিশেষ করে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যেও কি সেই আঁচ এসে পড়বে? সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তো সেটাই।
আরও পড়ুন: করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকতে কী কী প্রয়োজন? কী বললেন চিকিৎসকেরা?
স্বামী-স্ত্রী-র সম্পর্কের কী হবে?
যেদিন থেকে সিমেনে করোনা-র হদিস পাওয়া গিয়েছে, বেড়েছে চিন্তা। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, শরীর ভাইরাস-মুক্ত হওয়ার পরও সিমেনে থেকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে যদি সে ছড়িয়ে পড়ে! সুবর্ণ গোস্বামী জানিয়েছেন, “সিমেনে ভাইরাসের হদিস পাওয়া গেলেও তা থেকে সংক্রমণ ছড়ায় কি না তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা নেই। না ছড়ানোর সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক সম্পর্কে কোনও সমস্যা নেই। অতিরিক্ত সাবধানতা হিসেবে গর্ভনিরোধক ব্যবহার করতে পারেন। তবে বাড়িতে একজনের হলে অন্যদের হওয়ার আশঙ্কা এত বেশি যে দেখা যায় স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে একজনের হলে, সহবাস হোক না হোক, অন্যজন সংক্রামিত হন।”
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy