বয়স বাড়লে স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়ে বন্ধ্যত্বের সমস্যা।
সমস্যা বেড়েছে। বেড়েছে তা নিয়ে সচেতনতাও। তার সঙ্গে কমেছে চিকিৎসার খরচ। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, সন্তানহীনতার সমস্যায় তাই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে দেরি করছেন না বহু দম্পতি। প্রয়োজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলকাতায় বন্ধ্যত্বের চিকিৎসার পরিকাঠামোও আগের চেয়ে অনেকটাই উন্নত বলে মনে করছেন বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ। এ রাজ্যের তো বটেই, ভিন্ রাজ্য বা বিদেশ থেকেও বন্ধ্যত্বের সমাধান খুঁজতে অনেক দম্পতিরই গন্তব্য হচ্ছে এ শহর।
বন্ধ্যত্বের সমস্যা যে ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তার জন্য বিশেষজ্ঞেরা দায়ী করছেন আধুনিক জীবনযাত্রাকেই। স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, নারী-পুরুষ সকলের মধ্যেই এখন বেশি বয়সে বিয়ে করার প্রবণতা বাড়ছে। আর বয়স বাড়লে স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়ে বন্ধ্যত্বের সমস্যা। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত মানসিক চাপের জেরও এই সমস্যা ডেকে আনতে পারে। এ ছাড়াও রয়েছে শারীরচর্চার অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, মদ্যপান, ধূমপান, ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো জীবনযাত্রাগত কিছু বিষয়ের প্রভাব। মল্লিনাথবাবু আরও জানাচ্ছেন, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নিষিদ্ধ মাদক এবং অতিরিক্ত ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল ব্যবহারের প্রবণতা। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে গর্ভনিরোধক ওষুধের ব্যবহারও সাময়িক ভাবে বন্ধ্যত্ব ডেকে আনতে পারে। এ ছাড়াও চাকরিসূত্রে অনেক দম্পতি আলাদা থাকেন, কল সেন্টারের মতো জায়গায় রাতের শিফটে কাজ করেন অনেকে। এর জেরে যেমন একে অপরের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ কমে যায়, তেমনই সম্পর্কে টানাপড়েন বাড়ে। সব মিলিয়ে সন্তানধারণের সম্ভাবনাও অনেকটা কমে যায় বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বন্ধ্যত্বের চিকিৎসার শেষ ধাপ হল আইভিএফ বা কৃত্রিম প্রজনন। ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ দম্পতির এই চিকিৎসার দরকার হয় না। স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বন্ধ্যত্বের সমস্যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কাউন্সেলিং। প্রজননের জৈবিক পদ্ধতি এবং নারীদের ঋতুচক্র নিয়ে অনেক দম্পতিরই পরিষ্কার ধারণা থাকে না। বিষয়টি ভাল করে বুঝিয়ে দিলেই অনেকের সমস্যা মিটে যায়। ওষুধেরই প্রয়োজন হয় না।’’
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় সবচেয়ে খরচসাপেক্ষ ধাপ আইভিএফ।
এর পরেও সমস্যা থাকলে দ্বিতীয় ধাপে দম্পতির কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে হয় বীর্য পরীক্ষা। মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা হয় বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা ঠিক রয়েছে কি না। আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষার মাধ্যমে ডিম্বাণু, জরায়ু অথবা ফ্যালোপিয়ান টিউবের কোনও সমস্যা রয়েছে কি না, দেখা হয় তা-ও। এর পরে মহিলাদের ক্ষেত্রে ওভ্যুলেশন ঠিক ভাবে করানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হতে পারে। এক বছর ওষুধ খাওয়ার পরেও সন্তানধারণ সম্ভব না হলে ল্যাপারোস্কপি বা হিস্টেরোস্কপির মাধ্যমে পলিসিস্টিক ওভারি, ফাইব্রয়েড অথবা এন্ডোমেট্রিয়োসিসের মতো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা হয়। এতেও যদি কাজ না হয়, সে ক্ষেত্রে তৃতীয় ধাপে ছ’মাস পরে ইন্ট্রা-ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন (আইইউআই বা কৃত্রিম পদ্ধতিতে জরায়ুতে শুক্রাণু স্থাপন) করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। তবে এই পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি তিন বার করা হয়।
আরও পড়ুন: ক্যানসার চিকিৎসাকে নাগালে আনতে পারে ‘টিম ওয়ার্ক’
চিকিৎসা শুরু হওয়ার তিন বছর পরেও যদি সমস্যা থাকে, তা হলে দম্পতিরা আইভিএফ বা কৃত্রিম প্রজননের কথা ভাবতে পারেন। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এখন আইভিএফ পদ্ধতিতে সন্তান জন্মের হার ৩০-৪০ শতাংশ।
এ রাজ্যে কোথায় কোথায় হয় বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা?
রায়গঞ্জ গর্ভনমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক চৈতালি দত্তরায় জানাচ্ছেন, প্রথম তিনটি ধাপ পর্যন্ত চিকিৎসা মেলে কলকাতার সবক’টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই। এ ছাড়াও রাজ্যের বেশ কিছু সরকারি হাসপাতালেও হয় বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা। তবে সরকারি ভাবে এখনও কোথাও আইভিএফ পদ্ধতির সুযোগ পাওয়া যায় না। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, ‘‘আগে পিপিপি পদ্ধতিতে এসএসকেএমে আইভিএফ ক্লিনিক তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা বাতিল হয়ে যায়। তবে এন আর এস আইভিএফ-এর সম্পূর্ণ পরিকাঠামো তৈরি করতে চেয়েছে। এর জন্য জায়গাও দেওয়া হয়েছে। পিডব্লিউডি নকশা তৈরি করছে।’’
আরও পড়ুন: হার্টের অসুখ ঠেকাতে চান? ডায়েটে অবশ্যই রাখুন এই খাবার
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকদের কাছেই প্রথম দু’টি ধাপের সুবিধা মেলে। তবে আইইউআই করাতে আইভিএফ-এর পরিকাঠামো প্রয়োজন। শহরের বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালেই নেই সেই পরিকাঠামো। তাই আইভিএফ-এর জন্য নির্ভর করতে হয় বেসরকারি ক্লিনিকের উপরেই। তবে শহরে আরও ক্লিনিকের প্রয়োজন আছে বলেই কিছু সর্বভারতীয় বেসরকারি সংস্থা এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে— এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। বন্ধ্যত্ব চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীর জানাচ্ছেন, এ রাজ্যে এখন এ ধরনের ৪২টি ক্লিনিক রয়েছে। তাঁর দাবি, পিপিপি মডেলে তাঁর পরিচালনায় এসএসকেএমে একটি আইভিএফ ক্লিনিক খোলার চেষ্টা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল যে, সেখানে রোগীরা শুধু ওষুধের দাম দেবেন। বাকি চিকিৎসা হবে বিনামূল্যে। কিন্তু তা আটকে যায় মূলত খরচের কারণে। আইভিএফ ক্লিনিকে দক্ষ এমব্রায়োলজিস্ট প্রয়োজন। সরকারি ভাবে এই পদটির কোনও অস্তিত্ব নেই। তা ছাড়া, এমব্রায়োলজিস্ট ও ল্যাবরেটরির কর্মীদের বেতন দেওয়ার মতো সংস্থান সরকারি ভাবে তখন ছিল না। গৌতমবাবু জানাচ্ছেন, আগে আর জি কর, এন আর এসের মতো জায়গায় এই বিষয়ে প্রাথমিক কথা হলেও খরচের কারণেই তা ফলপ্রসূ হয়নি।
অথচ বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় সবচেয়ে খরচসাপেক্ষ ধাপ আইভিএফ। ল্যাপারোস্কোপির জন্য খরচ হয় ৪০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা। আইইউআই করালে প্রতি বার খরচ পড়ে প্রায় ৫ হাজার টাকা। সেখানে তিন বার আইভিএফ করানোর খরচ হতে পারে চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা। যে দম্পতিকে আইভিএফ করাতে হচ্ছে, তাঁদের ক্ষেত্রে আগের স্তরের সব চিকিৎসার খরচ মিলিয়ে অঙ্কটা অনেকটাই বেশি হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসা পেলে তাঁদের সুবিধা হত।
তবে অভিনিবেশবাবু জানান, ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর হার বেশি। সাধারণ চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে বহু জায়গায়। তাঁর মতে, এই পরিস্থিতিতে সরকারি ক্ষেত্রে আইভিএফ বিলাসিতা। এ দেশে অনাথ শিশুর সংখ্যাও প্রচুর। তাই যে দম্পতিরা সন্তানধারণে অক্ষম, তাঁদের দত্তক নেওয়ায় উৎসাহিত করা দরকার বলে মনে করছেন তিনি।
কতটা কমেছে সন্তানহীনতা নিয়ে সামাজিক ছুৎমার্গ? বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, আগে ধরেই নেওয়া হত বন্ধ্যত্ব কেবল মহিলাদের সমস্যা। সেই ভুল ধারণা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দূর হয়েছে। চিকিৎসায় খরচ করতেও দ্বিধা করছেন না অধিকাংশ দম্পতি। তবে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি নেতিবাচক দিক হল, অনেক দম্পতি অকারণেই ধরে নিচ্ছেন যে তাঁরা সন্তান পেতে অক্ষম। বিয়ের কিছু দিন পরেই চিকিৎসা করানোর জন্য অনেক সময়ে বাড়ি থেকেও চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ছাড়াও বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বন্ধ্যত্বের কোনও রকম চিকিৎসা এখনও পর্যন্ত চিকিৎসা বিমার আওতায় পড়ে না। সন্তানহীনতা এবং এর চিকিৎসার সঙ্গে যে উদ্বেগ ও শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণার দিকটি জড়িয়ে, তা নিয়ে সচেতনতা এখনও অনেকটাই কম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy