নিয়মমাফিক রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ দেওয়া হয় জটিল কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে। ফাইল ছবি।
কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ আজকাল মোটামুটি নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি থাকলে তো বটেই, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরও ব্যবহার করা হচ্ছে এই ওষুধ। তাতে রোগ জটিল হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যাচ্ছে। রোগী মারা যাচ্ছেন কম।
কিন্তু কেন? কী এমন আছে এই ওষুধে যে করোনার মতো শ্বাসনালীর ভাইরাসের বাড়াবাড়ি সে ঠেকিয়ে দিতে পারছে? আসুন দেখে নেওয়া যাক ।
কী কী হল
• কোভিড আসার পর থেকেই বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অনেক রোগীরই পা নীল হয়ে ফুলে যাচ্ছে। তাঁরা জানতেন যে, এ হল ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস অর্থাৎ গভীরের শিরায় রক্তের ডেলা জমে পায়ে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে যে সমস্যা হয়, তার উপসর্গ।
আরও পড়ুন:হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাবেন কি খাবেন না, ডাক্তারের উপর ছাড়ুন
• শয্যাশায়ী জটিল রোগীদের, বিশেষ করে যাঁদের ওজন বেশি, হাই প্রেশার-সুগার বা হৃদরোগ আছে, তাঁঁদের এমন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে নিয়ম মাফিক রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ দেওয়া হয়। আইসিইউ-তে ভরতি থাকা কোভিড রোগীদেরও দেওয়া হয়েছিল এই একই কারণে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের অনেকেরই এই সমস্যা হয়। এবং এত বাড়াবাড়ি হয় যে, দু'একজনের পা কেটে বাদ দিতে হয়।
• আইসিইউ-তে ভরতি শতকরা ৫ জন জটিল কোভিড রোগীর কিডনির কার্যকরিতা কমে যায়। ফলে রক্তের দূষিত পদার্থ বার করতে তাঁদের ডায়ালিসিস করতে হয়। একটি টিউব দিয়ে দূষিত রক্ত যায় মেশিনে, তার পর শুদ্ধ হয়ে আবার ফিরে আসে শরীরে। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ দেওয়া সত্ত্বেও কিছু রোগীর ক্ষেত্রে খুব ছোট ছোট রক্তের ডেলা জমে টিউবে রক্ত চলাচল থেকে থেকেই আটকে যাচ্ছে।
• নিউমোনিয়ার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোমে মৃত কোভিড রোগীদের ময়নাতদন্তে দেখা যায়, তাঁদের অনেকেরই ফুসফুসে নিউমোনিয়ার চিহ্ন নেই। তার বদলে রয়েছে ছোট ছোট রক্তের ডেলা।
• নিউরো সার্জন পাস্কাল জাব্বর জানালেন, সেখানে হঠাৎ স্ট্রোক রোগীর সংখ্যা খুব বেড়ে যায়। মস্তিষ্কে জমা রক্তের ডেলা গলিয়ে দেওয়ার পরও তাঁদের অনেককেই বাঁচানো যায়নি। পরে দেখা যায়, এঁদের মধ্যে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশের কোভিড ছিল। এবং তাঁদের ৫০ শতাংশ যাবতীয় চিকিৎসার পর মারা গেছেন।
• হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা জানালেন, হার্ট অ্যাটাকের রোগীর হার্টের ধমনিতে জমা রক্তের ডেলা গলানো হচ্ছে, অন্যান্য চিকিৎসা হচ্ছে, তবু মারা যাচ্ছেন অনেকেই। পরে দেখা গেছে, তাঁরা ছিলেন কোভিডে আক্রান্ত।
• আইসিইউ-তে ভরতি কোভিড রোগীদের অবস্থার পর্যালোচনা করে ট্রান্সপ্লান্ট সার্জেন হান্টার মুর বলেছেন, "এঁদের শরীরে জমা রক্তের ডেলাগুলো এমন যে, ওষুধ দিলেও চট করে গলছে না। ফলে প্রায় ৩০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কিছু ডেলা মস্তিষ্কে চলে যাচ্ছে। প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ফুসফুসে গিয়ে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে রক্তসঞ্চালনে।"
• এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ 'থ্রম্বোসিস রিসার্চ জার্নাল'-এ প্রকাশিত হয় ডাচ বিজ্ঞানীদের গবেষণা। তাতে জানা যায়, ১৮৪ জন আইসিইউ-তে ভর্তি রোগীর মধ্যে কম করে ৩৮ শতাংশের শরীরে অস্বাভাবিক হারে রক্তের ডেলা জমছে। চিনের খবর অনুযায়ী, ১৮৩ জন রোগীর মধ্যে যত জন মারা গেছেন, তাঁদের ৭০ শতাংশের শরীরের বিভিন্ন রক্তনালী ও প্রত্যঙ্গে পাওয়া গিয়েছে রক্তের ডেলা।
আরও পড়ুন: স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি নেই মানেই কি করোনা, কী বলছেন চিকিৎসকরা
গলাতে হবে রক্তের ডেলা
অঘটনের মূলে রক্তের ডেলার হাত আছে জানার পর বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ দিয়ে এর চিকিৎসা করতে হবে। শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নয়, সবাইকেই। বিশেষজ্ঞ চিকিসিক সুকুমার মুখোপাধ্যায় জানালেন, “দিনে দিনে এমন রোগীর খবর পাওয়া গেল, যাঁদের রোগ এত মৃদু পর্যায়ের ছিল যে তাঁদের নিয়ে চিন্তা করার যে প্রয়োজন আছে, তা ভাবা যায়নি। ফলে চিকিৎসা চলেছে বাড়িতে। হঠাৎ খবর পাওয়া গেছে, আচমকা শ্বাসকষ্ট হওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে আসার পথে মারা গিয়েছেন রোগী। আবার এমন অনেক রোগী দেখা গেছে, যাঁদের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা এত কম যে তাঁদের অজ্ঞান হয়ে মর-মর হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা কথাবার্তা বলছেন। পরমুহূর্তেই অবস্থা এত খারাপ হয়েছে যে আর কিছু করা যায়নি। ফলে সবাইকে এক ধার থেকে রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ দেওয়া হল। এবং দেখা গেল আশাতীত ফল হয়েছে।”
যত বেশি প্রদাহ হয়, তত বাড়ে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা। ফাইল ছবি
কোন ওষুধ কী মাত্রায়
কোন ধরনের রক্ত পাতলা করার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করলে সবচেয়ে ভালো ফল হব্, তা নিয়ে শুরু হল ভাবনাচিন্তা। কারণ দেখা গেল আইসিইউ-তে ভর্তি থাকা রোগীদের ডায়ালিসিস করার সময় যে ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়, কোভিড রোগীদের সেসব দিয়ে ডায়ালিসিস করে খুব একটা ভাল কাজ হচ্ছে না। একই অভিজ্ঞতা হল অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসকদেরও। ফলে শুরু হল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ায় হেপারিন নামের ওষুধ নিয়ে কাজ শুরু করলেন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম কুকার। বিভিন্ন রোগীকে বিভিন্ন মাত্রায় প্রয়োগ করে বুঝতে লাগলেন তার কার্যকারিতা। ক্রিস্টোফার ব্যারেটের তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু হল টিপিএ বা টিস্যু প্লাজমিনোজেন অ্যাকটিভেটর নামের ওষুধ নিয়ে, যা ব্যবহার করা হয় স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায়, মস্তিষ্কে ও হার্টে জমা রক্তের ডেলা গলাতে। বিভিন্ন রোগীর উপর এই সব ওষুধ প্রয়োগ করে ভাল সাফল্য পাওয়া যেতে লাগল। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেল, করোনাভাইরাসের মতো ভাইরাস, যাকে আগাগোড়া ফ্লু ভাইরাস ভেবে এসেছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা, তার প্রভাবে কেন এত পরিবর্তন হচ্ছে রক্তে?
আরও পড়ুন:যাতায়াত গণপরিবহণে, ভিড় রাস্তাতে, কী করবেন কী করবেন না
কেন জমছে রক্তের ডেলা
ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সৌতিক পাণ্ডা জানিয়েছেন, মূলত দু'টি কারণে এরকম হতে পারে। প্রথম হল, সাইটোকাইন স্টর্ম। শরীরে যখন প্রবল পরাক্রমী কোনও বহিরাগত বস্তু আক্রমণ করে, রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা অতি সক্রিয় হয়ে সাইটোকাইন নামে একগুচ্ছ রাসায়নিকের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে কিছু রাসায়নিক প্রবল প্রদাহ ঘটায় শরীরে।
যত বেশি প্রদাহ হয়, তত বাড়ে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা, যাকে বলে ডিআইসি বা ডিসিমিনেটেড ইন্ট্রাভ্যাসকুলার কোয়াগুলেশন, সহজ কথায়, শরীরের ছোট-বড় সব রক্তবাহী নালীতে জমতে শুরু করে রক্তের ডেলা। দ্বিতীয় যে কারণটির হাত থাকতে পারে, তাকে বলে হিমোস্ট্যাটিক ডিরেঞ্জমেন্ট।
শরীরের কোথাও চোট লেগেছে, শরীর তখন রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ সেখানে পাঠিয়ে রক্ত বন্ধ করে। শরীরে বড় আঘাত বা সংক্রমণ হলে শরীর দিশাহারা হয়ে যায়। ফলে যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানেও পাঠাতে থাকে রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ। রক্ত জমাট বাঁধা ও পাতলা থাকার মধ্যেকার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।’
‘‘আইসিইউ-তে দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী রোগীদের যেমন পায়ের গভীরে রক্ত জমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট মাত্রায় রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ দেওয়া হয়, কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রেও এখন তেমন করে খুব ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে ,’’ জানালেন সৌতিকবাবু।
আরও পড়ুন: রাতে জেগে, দিনে ঘুম? কোভিড আবহে কতটা ক্ষতি করছেন জানেন
কী করা উচিত
বিজ্ঞানীদের মতে, ওষুধপত্র দিয়ে এই অহেতুক রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা ঠেকানো গেলে রোগের জটিলতা কমবে। শরীরের সব প্রত্যঙ্গ খারাপ হবে না একে একে। মৃত্যুর হার অনেক কমে যাবে। ফলে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ না থাকা সত্ত্বেও, শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থাই তখন ভাইরাসকে নির্মূল করতে পারবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy