পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতেই হবে, মত চিকিৎসকদের। ছবি: শাটারস্টক
বিপদ তো রয়েইছে, এল আর এক নতুন বিপদ। কোভিড সংক্রমণ সেরে যাওয়ার এক মাসের মধ্যেই আবার আক্রান্ত হয়েছেন উত্তরবঙ্গের এক বাসিন্দা। সাপ্তাহিক লকডাউনেও সংক্রমণ কমার কোনও লক্ষণ এখনও পর্যন্ত নেই। কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার উপরের দিকে উঠছে প্রত্যেক দিন। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন।
দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স (এমস)-এর অধিকর্তা রণদীপ গুলেরিয়া সম্প্রতি জানিয়েছেন, দিল্লি, মুম্বই ও আমদাবাদে সংক্রমণ কমছে। তিনি বলেছেন, দেশের এই তিন মেগাসিটি এবং দক্ষিণের কয়েকটি শহরে করোনা আক্রান্তের গ্রাফ নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে। গত ২৫ জুন কলকাতা শহরে কোভিড ১৯ পজিটিভ ছিলেন ১৩৪ জন। শনিবার সকাল ৯টা থেকে রবিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত রাজ্যে ২৭৩৯ জনের দেহে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। মৃত্যু হয়েছে ৪৯ জনের।
রাজ্যে মোট আক্রান্ত ৭৬ হাজার পেরিয়ে গেছে। এই হিসেব অনুযায়ী কলকাতা শহরে কোভিড পজিটিভের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০৯। ব্যাপারটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে মনে করেন সংক্রামক রোগের চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী। তাঁর আশঙ্কা, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সংক্রমিতের সংখ্যা আরও বাড়বে। আরও উদ্বেগের ব্যাপার হল সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর হারও ক্রমশ বাড়ছে। অমিতাভবাবুর অভিমত, অবস্থার আরও অবনতি হওয়ার আগেই সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করতে হবে বলেই মনে করেন তিনি। সন্দেহ হলেও অনেক সময় সাধারণ মানুষ হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা করাতে ভয় পাচ্ছেন। এ ছাড়া রয়েছেন উপসর্গহীন আক্রান্ত। কোনও শারীরিক সমস্যা না থাকায় এঁরা দ্বিধাহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে আরও বেশি। এই সমস্যা প্রতিরোধ করতে এবং কোভিডের দ্রুত বিস্তার ঠেকাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে অ্যান্টিজেন, অ্যান্টিবডির টেস্ট করানো আবশ্যক।
প্রচুর টেস্ট-সহ নানা পন্থার মাধ্যমে দেশের ৩টি শহরে সংক্রমণের হার কমানো গিয়েছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
আরও পড়ুন: সংক্রমণের হার ১৪.৫৯%, পরিকাঠামোর অভাবে রাজ্যে নমুনা পরীক্ষায় বিঘ্ন
একই সঙ্গে ডেঙ্গি পরীক্ষা করানোও জরুরি বলে মনে করেন অমিতাভবাবু। এখন করোনার সঙ্গে ডেঙ্গি সংক্রমণও বাড়ছে। দুই সংক্রমণ একসঙ্গে হলে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা না করালে ভয়ানক বিপদ। ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সবার কোভিড টেস্ট বাধ্যতামূলক বলে মনে করেন অমিতাভ নন্দী। রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি কঠোর ভাবে রোগী ও তাঁর সংস্পর্শে আসা মানুষজনকে আইসোলেশনে না রাখতে পারলে অবস্থার আরও অবনতি হবে বলে তাঁর আশঙ্কা।
মৃদু উপসর্গে বাড়িতে থাকা ও নিয়মিত চেকআপের পাশাপাশি গুরুতর অসুস্থদের জন্য যথযথ ব্যবস্থাও জরুরি। অনেক সময় আরটিপিসিআর টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও একাধিক বার পরীক্ষা করানো দরকার, বললেন অমিতাভবাবু। দিল্লিতে প্রচুর টেস্ট করে ও যথযথ ব্যবস্থা নিয়ে রোগ আয়ত্তে আনা গিয়েছে। তবে আলগা দিলে আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন অমিতাভবাবু।
তাঁর মতে, “এখন সরকারের উচিত প্রথম পর্যায়ে সংক্রমণ নির্ণয় করা। আর এই কারণেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে টেস্ট করা দরকার। প্রথম স্টেজে সংক্রমণ নির্ণয় করা গেলে রোগীকে আইসোলেট করে চিকিৎসা করালে এক দিকে যেমন রোগ ছড়ানো আটকানো যাবে, অন্য দিকে হাসপাতালে বেডের হাহাকার কমবে।” এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর বিষয়েও জোর দিচ্ছেন তিনি।
মেডিসিনের চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় বললেন, “দিল্লি, মুম্বই বা আমদাবাদে সংক্রমণ কমার পিছনে আছে পর্যাপ্ত পরীক্ষা, প্রথম পর্যায়ে আর্লি ডিটেকশন ও আইসোলেশন। ওই শহরগুলিতে এখন সংক্রমণ কমেছে ঠিকই, কিন্তু তা ধরে রাখতে গেলে আরও সতর্ক থাকা দরকার। তা না হলে দ্বিতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।” তাঁর দাবি, টানা এক মাস সংক্রমণের হার কমলে তবেই আশা করা যাবে কোভিড ১৯ ক্রমশ পিছু হঠছে। আমাদের রাজ্যে সংক্রমণ না কমার অন্যতম কারণ হিসাবে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবের কথা শোনা গেল তাঁর মুখেও। সুকুমারবাবু বললেন, “এখনও অনেকে সঠিক ভাবে মাস্ক পরছেন না, অকারণে বাজারে-বাসে ভিড় করছেন।”
তাঁর দাবি, “সরকারি তরফে রোগ নির্ণয় আরও অনেক বাড়িয়ে রোগীকে আইসোলেশনে রাখলে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। মহামারি মোকাবিলা করতে গেলে সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সচেতনতাও জরুরি। আরটিপিসিআর ছাড়া র্যাপিড অ্যান্টিবডি ও র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করা জরুরি। দিল্লিতে র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট করে ২৫ শতাংশ অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে, আমাদের রাজ্যে ২২ শতাংশ। এই টেস্ট বাড়িয়ে যদি দেখা যায় ৪০ শতাংশের ওপর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তা হলে আশা করা যাবে সংক্রমণ কমছে।”
শুধু লকডাউন নয়, দিল্লিতে সংক্রমণের গ্রাফ নিম্নমুখী হওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাপক হারে টেস্ট । ফাইল ছবি।
সপ্তাহে দু’দিন লকডাউন করে কতটা সুফল পাওয়া যাবে তা এখনই বোঝা যাবে না বলে জানিয়ে তাঁর দাবি, “কড়া লকডাউন ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া করোনার মতো মহামারি আটকানো সম্ভব নয়।”
আরও পড়ুন: ক্লান্ত লাগলেই কি করোনা? উদ্বিগ্ন হবেন না, এ সব করুন
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী বললেন, “দিল্লি, মুম্বই বা আমদাবাদের মতো শহরে প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। চূড়ায় উঠে সংক্রমণ এখন কমার দিকে। কিন্তু আমাদের রাজ্যে সংক্রমণ এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছয়নি। এ ছাড়া দিল্লি বা অন্যান্য শহরে প্রচুর পরিমাণে টেস্ট হয়েছে। আমাদের রাজ্যে টেস্টের সংখ্যা সেই তুলনায় বেশ কম। দিল্লিতে প্রথমেই প্রত্যেকের টেস্ট করে রোগ নির্ণয় হয়েছে এবং তাঁদের আইসোলেশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসতে সময় লাগেনি। আর সেই তুলনায় আমাদের রাজ্যে অসুস্থ না হলে টেস্টই করা হচ্ছে না। উপসর্গহীন মানুষ যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়ে রোগ ছড়াচ্ছেন। সপ্তাহে দু’দিন লকডাউন করে কোনও লাভ হচ্ছে না। ইন্টারমিটেন্ট লকডাউন করতে হয় টানা দুই সপ্তাহ। তা না করলে কোনও লাভ হয় না।”
আরও পড়ুন: ফ্রিজ থেকে কি করোনা ছড়ায়? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা, জেনে নিন
তাই নিরর্থক সাপ্তাহিক লকডাউনের পথে না গিয়ে পর্যাপ্ত টেস্ট আর টানা দুই সপ্তাহ লকডাউন করে করোনা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা উচিত বলে মনে করেন সুবর্ণবাবু।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
(ইনফোগ্রাম: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy