এ বারের গরমের ছুটিটা কেমন যেন আচমকাই চলে এল। দিনকয়েকের প্রবল গরম। তার পরই সরকারি ঘোষণামতো ফের স্কুলের ঝাঁপটি বন্ধ হল। নির্ধারিত সময়ের ঢের আগেই। কেমন আছে ছোটরা এই হঠাৎ পাওয়া অনেক দিনের ছুটিতে? সবাই কি এত দিনের ছুটি পেয়ে দারুণ খুশি? তা বোধ হয় নয়। শেষ স্কুলের দিনটিতে ওদের পানসে মুখগুলোই বলে দিয়েছে ফের দীর্ঘ দিন বাড়ি বসে থাকার সম্ভাবনায় ওদের কতখানি মন খারাপ।
আসলে, অতিমারি এসে ওদের শৈশব থেকে ছুটির আনন্দটাই কেমন যেন মুছে দিয়েছে। গত দু’বছর ওরা কার্যত ছুটিতেই ছিল, স্কুলমুখো হওয়ার সুযোগই পায়নি। অতিমারির তিন-তিনটে ঢেউ কাটিয়ে সবেমাত্র বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, টিফিন ভাগ করে খাওয়ার রুটিনে ধীরে ধীরে ফিরছিল ওরা, ঠিক সেই মুহূর্তে ফের ছন্দপতন। মন খারাপের আর দোষ কী? অস্বীকার করার উপায় নেই, ব্যস্ত জীবনে বাবা-মায়েরা সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। প্রতি মুহূর্তে ঘরের কাজ আর বাইরের কাজের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলতে হয়। ফলে, একটি শিশু যতটা সঙ্গ চায়, তা জোগানোর মতো সময় খুব কম পরিবারেই আছে। অণু-পরিবারের দাদু-ঠাকুমা-কাকা-কাকিমা-জেঠু-জেঠিমার আদর-আবদারের জায়গাটা হারিয়েই গিয়েছে। ছোটরা অনেকেই খুব একা। এই একাকিত্বের জায়গাটা অনেকটাই ভরাট করে দিতে পারে স্কুল। অথচ অতিমারি সেই সুযোগটাও কেড়ে নিল।
এখন প্রশ্ন হল, কী ভাবে ওদের এই লম্বা ছুটিতে ভাল রাখা যায়? অনেক স্কুলই ছুটিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য হোমওয়ার্ক পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একটি শিশু সারা দিন হোমওয়ার্ক করবে আর বাকি সময়টা মোবাইল বা টিভিতে মুখ গুঁজে থাকবে, এমন ভয়ঙ্কর রুটিনে ওদের আটকে না রাখাই ভাল। ওর যেগুলো ভাল লাগে, তেমন কাজ ওকে করতে দিতে হবে। সন্তান যদি আঁকতে ভালবাসে, তা হলে কিছু সময় ওর ইচ্ছেমতো আঁকিবুঁকি কাটতে দিন। না-ই হল সেগুলো একেবারে ‘পিকচার পারফেক্ট’। জীবনের সব কিছু কি নিখুঁত হতে পারে? ওর কোনও এক রঙা টিশার্ট বা জামা ওকে দিন। আর কিনে দিন নানা রঙের ফেব্রিক কালারের কৌটো। যা ইচ্ছে আঁকুক। অপটু হাতের আঁকিবুঁকি চমৎকার দেখতে লাগে। নিজের হাতে রং করা জামা পরতে ওদেরও মজা লাগবে। অনলাইনে এখন ঝটপট ড্রয়িংয়ের নানা রকম ভিডিয়ো পাওয়া যায়। দরকার হলে সেগুলো দেখে আইডিয়া তৈরি করে নিতে পারে। ছোট ছোট সাদা কার্ড কিনেও ওকে স্টোন, স্টিকার বা রং দিয়ে কার্ড বানাতে বলুন। ওর বন্ধুদের বা পরিবারের কারও জন্মদিনে তাতে নিজে হাতে লিখে গিফটের সঙ্গে দেওয়া যেতে পারে। আমাদের সময়ে ছেলেবেলায় অনেকেই নিজে নিউ ইয়ারের কার্ড বানিয়ে দিত। কাঁচা হাতের কাজ হলেও তাতে যে ভালবাসার ছোঁয়া থাকত, তাতেই মন ভরে যেত।
শিশুকে সবুজের সঙ্গে পরিচিত হতে দিন। ও শুধু আপনার বাগানে জল দেবে, তা নয়। ওকে সঙ্গে করে গাছ কিনতে যান। দু’-একটা ওর পছন্দমতো গাছ, টব কিনে দিতে পারেন। আপনি যখন বাগানের কাজ করবেন, ওকেও ওর গাছের চর্চা করতে দিন। এক দিনে ও সব জেনে যাবে না, ভুল করবে। আপনি ওকে গাইড করুন। কিন্তু ওর কাজটা ওকেই করতে দিন। নিজে হাতে করা গাছে ফুল ধরলে, ফল ফললে তাতে যে আনন্দ হয়, তার শরিক হতে দিন আপনার সন্তানকেও। পোড়ামাটির টব কিনে ছোটদের বলুন তার গায়ে ছবি আঁকতে। ছবি আঁকা টব ঘর সাজানোর জন্য চমৎকার।
অবসর সময়ে বাড়ির ছোটদের কিছু খাবার বানাতে দিন। অনেক স্কুলে এখন নন-ফায়ার কুকিং শেখায়। বাড়িতেও এক দিন তেমনটা ওকে করতে দিন। কোনও এক দিনের ব্রেকফাস্ট বানাতে বা স্যালাড তৈরি করতে পারে। সেই সঙ্গে যদি এপ্রন কিনে বা বানিয়ে দিতে পারেন, তা হলে তো দ্বিগুণ উৎসাহ পাবে। বাড়িতেই পড়ে থাকা পুরনো কাপড় বা কাগজ দিয়ে শেফের মাথার টুপি বানিয়ে নেওয়া যায়। গরমের দিনে নানা রকম শরবত তৈরি করা শেখাতে পারেন সন্তানকে। একই ভাবে ঘরের কাজেও ওকে হাত লাগাতে বলুন। নিজের স্কুলড্রেস গুছিয়ে তোলা, বইখাতা সাজিয়ে রাখা, রোজকার জামাকাপড় ভাঁজ করা, যা এত দিন ওর স্কুল আর আপনাদের অফিসের চাপে শেখাতে পারেননি, সেগুলো শিখিয়ে নেওয়ার সময় এটাই। অফিস বেরিয়ে যাওয়ার আগে হালকা কোনও কাজের দায়িত্ব ওর উপরে দিয়ে যান। যেমন, পোষ্যকে ঠিক সময়ে খেতে দেওয়া, শুকনো জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা, বোতলে জল ভরে রাখা। এতে নিজে হাতে কিছু করার মধ্য দিয়ে ওর দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। ভবিষ্যতেও ওকে সব কাজের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না।
স্কুল ছুটি মানেই বন্ধুদের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ একেবারে বন্ধ, কে বলল? বাড়িতেই একটা দিন ওদের ডেকে নিন। বাড়িতে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, ছাদ, উঠোন থাকলে পোর্টেবল পুলে জল ঢেলে ওদের জন্য পুল পার্টিরও ব্যবস্থা করতে পারেন। সঙ্গে থাক ওদের পছন্দসই খাবার। বিভিন্ন স্কুলও এখন সামার ক্যাম্পের ব্যবস্থা করছে। সেখানে বাচ্চাকে ভর্তি করে দিতে পারেন। আঁকা, হাতের কাজ, গান, নাচের সঙ্গে বিভিন্ন ইন্ডোর গেম, পুল পার্টিরও বন্দোবস্ত থাকে সেখানে। এ সব নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ছোটদের মনটাও ভাল থাকবে।
এর সঙ্গে ওর স্বাস্থ্যের কথাটাও ভুললে চলবে না। সকালে স্কুল নেই। ওই সময়ে ছোটরা যোগাসন, হালকা এক্সারসাইজ় করতে পারে। সকালে মাঝেমধ্যে ওকে নিয়ে হাঁটতে বেরোন। পার্ক, খোলা মাঠের মতো ফাঁকা জায়গা পেলে সেখানে স্কিপিং, স্পট জগিং, সাইক্লিং প্র্যাকটিস করান। সকালে সময় না পেলে বিকেলেও নিয়ম করে বেশ খানিকটা হেঁটে আসতে পারেন। সকালে ওরা স্কুলে যায়, স্কুলের মাঠে খেলে বা পিটি ক্লাস করে বলে কিছুটা এক্সারসাইজ় হয়েই যায়। ছুটিতে তো সেই উপায় নেই। কিন্তু অভ্যেসটা যেন নষ্ট না হয়। ঘরে বসে এই দু’বছরে ওদের স্বাস্থ্যের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি যতটা সম্ভব মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে।
মোট কথা, ছুটি মানেই মোবাইলে ভিডিয়ো গেম বা টিভিতে কার্টুন দেখা নয়। রোজ ওর স্কুল, আপনার অফিসের ব্যস্ততায় অনেক কিছুই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। একটু ভেবে দেখুন, সেগুলো ফিরিয়ে আনা যায় কি না। রোজ আধঘণ্টা করে ও নিজের পছন্দের বই থেকে কয়েক পাতা মা-বাবার সঙ্গে পড়তে পারলেও একাকিত্ব কিছুটা কাটে। আসলে এখনকার ব্যস্ত দুনিয়ায় বন্ধনগুলো বড় আলগা হয়ে পড়েছে। লম্বা গরমের ছুটিটা সেই সুতোগুলোকে শক্ত করে বাঁধার সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy