মাতৃদুগ্ধে ডেকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড নামে একটি বিশেষ ধরণের উপাদান থাকে, যা শিশুর বুদ্ধির বিকাশে অত্যন্ত উপযোগী। ছবি: শাটারস্টক।
শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে মায়ের কাছে দেওয়া দরকার। এর ফলে এক দিকে মায়ের প্রসবের কষ্ট যেমন কিছুটা লাঘব হবে, তেমনই অন্য দিকে সন্তানের স্পর্শে মাতৃদুগ্ধ নিঃসরণ দ্রুত শুরু হবে। এই সময় মায়ের স্তন থেকে যে হালকা হলদেটে দুধ নিঃসৃত হয় (কলোস্ট্রাম), তাতে আছে নানা ধরনের অ্যান্টিবডি যা সদ্যোজাতকে আজীবন রোগপ্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। কিছু কাল আগেও এই দুধ শিশুদের দেওয়া হত না। কিন্তু পরে জানা গিয়েছে সদ্যজাতর জন্য কলোস্ট্রাম কতটা জরুরি। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ ও ‘ইউনিসেফ’ যৌথ ভাবে জন্মের পর প্রথম ছ’মাস শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
বিশ্বের সব স্তন্যপায়ীর মা তাঁদের শিশুকে জন্মের পর স্তন্যপান করায়। কিন্তু আশ্চর্যের, মানুষ স্বয়ং অনেক সময় এই সত্য ভুলতে বসে। তাই মায়ের দুধের পরিবর্তে ‘ফর্মুলা ফুড’ খাওয়ানোর প্রতি তাদের ঝোঁক রয়েছে। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে, ভারতে আজও প্রতি ৫ জন শিশুর জন্মের পর ৩ জনকে কলোস্ট্রাম দেওয়া হয় না। বার বার সচেতন করার পরেও আমরা ভুলে যাই, সদ্যোজাতের পাচনতন্ত্র বা ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ওদের মতোই ছোট্ট আর অপরিণত। অন্য খাবার খাওয়া আর হজম করা বেশ মুশকিল। আর ঠিক এই কারণেই ওদের জন্য আদর্শ খাদ্য কলোস্ট্রাম।
প্রোটিন, ভিটামিন এ এবং সোডিয়াম ক্লোরাইড সমৃদ্ধ অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন। এই দুধ সামান্য খেলেই শিশুর পেট ভরে যায়। অন্য দিকে এই হলদেটে দুধ গ্রোথ ফ্যাক্টর ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ফ্যাক্টরে সমৃদ্ধ থাকায় শিশুর রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রথম ধাপ তৈরি হয়ে যায়। এই কথা মনে করিয়ে দিতেই বিশ্ব জুড়ে ১–৭ অগস্ট পালন করা হল বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। বিশ্বের ১২০টি দেশের সঙ্গে আমাদের দেশও এতে শামিল।
আরও পড়ুন: ব্ল্যাকহেডসের ভয়! এ সব ঘরোয়া উপায়েই দূরে থাকবে সমস্যা
মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে কৃত্রিম ফর্মুলা দুধের একটা পার্থক্য আছেই, যা শিশুর জন্য খুব একটা উপকারী নয়।
‘ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাকশন’ মায়ের দুধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন বিশ্ব জুড়ে। সেই ১৯৯০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ যৌথ ভাবে মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা সম্পর্কে প্রচার শুরু করেন। এদেরই উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ১–৭ অগস্ট প্রথম মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালন শুরু হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বিশ্ব জুড়েই চিকিৎসকদের মতে, এই বিষয়ে সদ্য হওয়া মায়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবারকেও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে অনেক সময় একঘরে সবাই থাকতে বাধ্য হন বলে শিশুকে দুধ খাওয়াতে মা ইতস্তত করেন। পরিবারের উচিত, আর পাঁচটা ব্যক্তিগত কাজের মতো শিশুকে দুধ খাওয়ানোর জন্যও সেই পরিসর মাকে দেওয়া।
মায়ের দুধের সঙ্গে কৃত্রিম ফর্মুলা দুধের একটা পার্থক্য আছেই। ফর্মুলা দুধ রোবটের মত, স্থায়ী উপকরণে ঠাসা। মায়ের দুধের উপাদান শিশুর প্রয়োজন অনুযায়ী অনবরত বদলে বদলে যায়। সদ্য জন্মানো শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত মাতৃদুগ্ধের উপাদান বদলাতে থাকে। তাই জন্মের পর থেকে প্রথম ছ’মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
মাতৃদুগ্ধে ডেকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড নামে একটি বিশেষ ধরণের উপাদান থাকে, যা শিশুর বুদ্ধির বিকাশে অত্যন্ত উপযোগী। ভাবনাচিন্তা ও বুদ্ধির বিকাশের জন্য প্রয়োজন ডেকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড বা ডিএইচএ। দৃষ্টিশক্তির বিকাশের জন্যেও এই ডিএইচএর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বিরল দু’-একটি ঘটনা ছাড়া সব মায়েরই দুধ তৈরি হতে বাধ্য। তেমন কোনও সমস্যা থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।
আরও পড়ুন: একটু অনিয়মেই মেদ বাড়ছে? এই উপায়ে মোটা হওয়ার ভয় কমে, টক্সিন দূরে থাকে
কর্মরত মায়েদের মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণ করার ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে।
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’-র হিসেব অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রত্যেক বছর অসংখ্য পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশু মারা যায় স্রেফ ডায়েরিয়ার কারণে। পাকিস্থান, মায়ানমার, কেনিয়াকে পিছনে ফেলে শিশুমৃত্যুর ব্যাপারে অনেক এগিয়ে ভারত। এই ঘটনা প্রতিরোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারেন মায়েরা। জন্মের পর থেকে প্রথম ছ’মাস যে শিশু শুধুমাত্র মায়ের দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠে, তাদের ডায়েরিয়া-সহ অন্যান্য অসুখবিসুখের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। ল্যাকটেশন নার্স সায়ন্তী নাগচৌধুরী জানালেন, ‘‘বিভিন্ন উন্নত দেশে হবু মায়েদের ব্রেস্টফিডিং সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কলকাতাতেও সেই চল শুরু হয়েছে।
প্রত্যেক বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মায়ের দুধের উপযোগিতা ও মায়েদের দুধ দিতে উৎসাহ দিয়ে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই বছর ২৭ তম ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাওয়ারনেস সপ্তাহে বাচ্চাকে দুধ দেওয়ার ব্যাপারে অনেক বেশি উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। সচেতনতা আগের থেকে অনেক বেড়েছে, কিন্তু তাও অনেক মা তাঁর শিশুকে দুধ দেওয়ার বিষয়ে গড়িমসি করেন।’’
মায়ের দুধই যে শিশুর সেরা খাবার তা জানানোর পাশাপাশি মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে চেহারা নষ্ট বা শরীর খারাপ হওয়ার মতো ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল, তাও জানান তিনি। তাঁর মতে, বরং স্তন্যপান করালে জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। আবার কর্মরত মায়েদের মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণ করার ব্যাপারেও পরামর্শ দেওয়া হয় নানা ভাবে। সদ্যোজাত শিশুরাও চায় সহজে পেট ভরাতে। তাই বোতলে ভরা ফর্মুলা ফুড টানলে অল্প পরিশ্রমেই বেশি দুধ পেয়ে যায় বলে এক বার বোতলে অভ্যস্ত হলে কষ্ট করে মায়ের দুধ টেনে খেতে চায় না। তাই জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে স্তন্যপান করান। শিশু ও মা উভয়ের মঙ্গলের কারণেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy