Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Breadcrumbing

সম্পর্কের ‘খুড়োর কল’ ব্রেডক্রাম্বিং

এই হাসি-কথা-গান, এই অবহেলা। এই উষ্ণ কফির কাপ, এই মাইলের পর মাইল শীতল বরফ ভেঙে হাঁটা। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘ব্রেডক্রাম্বিং’ তিলে তিলে নষ্ট করে দিতে পারে একটি মানুষের মনোবল। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দু’তরফই।

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শ্রেয়া ঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৪ ০৯:০০
Share: Save:

একটা মন্থর ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল তিথির মুখ। ইয়ারফোনে ম্যাডোনার কণ্ঠে তখন, ‘হোয়েন আই লুক অ্যারাউন্ড, বেবি ইউ জাস্ট কান্ট বি ফাউন্ড।’ বিষণ্ণ চোখে মোবাইলটার দিকে তাকাল সে, কোনও মেসেজ নেই। এই নিয়ে তিন দিন হল। অদ্ভুত ভাবে চুপ করে গিয়েছে শুভ্র। অথচ, তিন দিন আগেই শুভ্র তাকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখছিল...

ঘটনা অপরিচিত নয়, ধরন অপরিচিত নয়। ‘তোমায় ভালবাসি না, আবার বোধহয় বাসি...’ বর্তমানে এই অদ্ভুত দোটানায় আবর্তিত হয় তিথি-শুভ্রর মতো অনেকের জীবনই। এর একটি গালভরা নামও রয়েছে, ‘ব্রেডক্রাম্বিং’। পাখির সামনে রুটির গুঁড়ো ছড়িয়ে তাকে যেমন আটকে রাখা যায়, তেমনই মিষ্টি কথায়, আলতো অনুভূতি ও মনোযোগে একটি মানুষকে আশা দেন এক জন। চলতে থাকে দিনের পর দিন আলাপ, তৈরি হয় নির্ভরতার জায়গা। তার পর হঠাৎ একদিন সব চুপ... বেশ কয়েক দিন সেই নৈঃশব্দ্যের পরে ফের একদিন কথা শুরু। ফের মনোযোগ, ফের অনুভূতির ছোঁয়া। এ পারের মানুষটি তখন বুঝে উঠতে পারছেন না সম্পর্কের ভবিতব্য আসলে কী। টানাপড়েনে মনোবল ক্রমশ ভাঙছে তাঁর। সেখান থেকেই অ্যাংজ়াইটি, ডিপ্রেশনের মতো মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

শুধু কি ‘ব্রেডক্রাম্বিং’? জেনারেশন জ়ি-এর সম্পর্কের ভাষায় রয়েছে ‘সিচুয়েশনশিপ’, ‘গোস্টিং’, ‘লাভ বম্বিং’-এর মতো রকমফের। অ্যাপের সাহায্যে আলাপ, তার পর দেখা-সাক্ষাৎ, কফি ডেটে যাওয়া... এগুলো খুব চটজলদি হতে থাকে বর্তমান প্রজন্মের জীবনে। সম্প্রতি এই বিষয়গুলি নিয়ে মুখ খুলেছেন অমিতাভ বচ্চনের নাতনি নব্যা নভেলি নন্দা। মা শ্বেতা নন্দা ও দিদিমা জয়া বচ্চনকে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন নতুন প্রজন্মের প্রেমের সংজ্ঞা। স্পষ্টতই দাবি করেছেন, ‘দো জিসম এক জান’ এখন আর অতটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেরিয়ারমুখী নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই সম্পর্ক এখন এক রহস্যময় সময়যাপন। সেখানেও রয়েছে রকমফের—

  • সিচুয়েশনশিপ: প্রেম আছে না নেই, সেটা স্পষ্ট নয়। এটাও স্পষ্ট নয় ভবিষ্যৎ কী, তবে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্ক শারীরিক হতে পারে, আবার হতে পারে স্রেফ মানসিক। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে হালকা প্রেম প্রেম সম্পর্ক... কিন্তু কোনও দায়বদ্ধতা নেই।
  • গোস্টিং: দিব্যি কথা চলছে, হালকা অনুভূতি উঁকিও মারছে। হঠাৎ কথা একেবারে বন্ধ করে দিলেন একজন। ফোন নম্বর বা ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলটা স্রেফ রয়ে গেল। মানুষটি আর কোনওদিনই যোগাযোগ করলেন না।
  • লাভ-বম্বিং: নেট মাধ্যমে আলাপ, বন্ধুত্ব থেকে ডেটিং সবে শুরু হয়েছে। সঙ্গে শুরু হয়েছে লম্বা লম্বা প্রেমের মেসেজ, উপহার, ডাকলেই চলে আসার বাহারও। ভালবাসার বিস্ফোরণ একেবারে। নতুন প্রজন্মের দাবি, এটা কিন্তু বড়সড় ‘রেড ফ্ল্যাগ’, এখন লাভ-বম্বিং মানে পরে অধিকারবোধ, সুতরাং সাধু সাবধান।
  • সাবমেরিনিং: এটা ব্রেডক্রাম্বিং আর গোস্টিংয়ের মাঝামাঝি। কথা বন্ধ, বহু মাস পরে ফের পিং। এতে অন্য জনের মধ্যে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়তে থাকে... ব্রেডক্রাম্বিং-এ এই পিং করার বা কথা বলার সময়ের ব্যবধানটা কম। কয়েক দিন মাত্র। সাবমেরিনিং-এ বহু মাসও হতে পারে।
  • অরবিটিং: দু’টি ভাবে হয়, অনলাইনে কাউকে ভাল লেগেছে। তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ না করে নীরবে তার সব পোস্ট দেখে যাওয়া। নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা কল্পনা করা। দ্বিতীয়টি হল, প্রেম ভেঙেছে, ব্যক্তিগত যোগাযোগ নেই, কিন্তু সমাজমাধ্যমে যোগাযোগ রয়েছে। কমেন্টে কথা-টথাও হয়...
  • সফট লঞ্চ: খুব ধীরে বহির্জগতে প্রকাশ করা যে দু’জন প্রেম করছে। ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে বিশেষ মুহূর্তের ছবি, যেমন হাত ধরা, দুটো কফির কাপ, ওয়াইনের গ্লাস। একই জায়গায় একসঙ্গে ঘুরতে গিয়ে আলাদা ছবি দেওয়া ইত্যাদি।
  • কুকি জারিং: বাংলায় যাকে বলে ‘হাতে রাখা’। একজনকে বেশি পছন্দ, আর একজনকে কম। বেশি পছন্দের মানুষ যদি পাত্তা না দেয়, অগত্যা কম পছন্দের মানুষের সঙ্গেও কফির কাপে তুফান।

এর সঙ্গেই রয়েছে ‘ব্রেডক্রাম্বিং’। আসলে, ‘ব্রেডক্রাম্বিং’ এমন এক খুড়োর কল যাতে মন্ডা মিঠাই একেবারেই মুখে এসে পড়ে না। দৌড়নোই সার হয়। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত এমন কৌশল, যাতে মনে হয় মানুষটি সম্পর্ক নিয়ে ভীষণ আন্তরিক। কিন্তু আদতে পুরোটাই ছল। সময়ে সময়ে প্রকট হয়ে আসে ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র মনোভাব। এই ধরনের মানসিকতার মানুষ বেশির ভাগই ভার্চুয়াল আলাপচারিতায় আগ্রহী।

এর কারণ কী?

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “ব্রেডক্রাম্বিং-এর কারণকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হল অনিচ্ছাকৃত— ব্যক্তিগত আঘাত বা ট্রমার কারণে কমিট করতে না চাওয়া। তিনি হয়তো চাইছেন না ব্রেডক্রাম্বিং করতে, কিন্তু তাঁর ফোবিয়া বা পূর্ব অভিজ্ঞতার ক্ষত তাঁকে বাধ্য করছে। নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেক ক্ষেত্রে বড় হওয়ার পরিবেশ, বাবা-মায়ের সম্পর্কের মাত্রা এই বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করে। দ্বিতীয়টি হল নিজের সুবিধের জন্য কাউকে ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণ করা। সেখান থেকেই কখনও মধুর আলাপ, কখনও নৈঃশব্দ্য। এই টক্সিক ম্যানিপুলেশন বিষয়টি ওই ব্যক্তির চারিত্রিক গঠন।”

কিন্তু কেন এই ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণ?

ডা. মুখোপাধ্যায় জানালেন, “প্রথমেই বলব ‘অ্যাটেনশন-সিকিং’-এর কথা। সঙ্গে বৈধতা তথা ভ্যালিডেশন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। মানুষ বরাবর অন্যের মনোযোগ পেতে পছন্দ করে। সমাজমাধ্যমের যুগে সেই আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়েছে। সেখান থেকে ক্রমাগত এক জনের মনোযোগ পাওয়ার জন্য এই অছিলা। এ ক্ষেত্রে যিনি ‘ব্রেডক্রাম্ব’ করছেন তাঁর মনে হয়, অন্যের কাছ থেকে মনোযোগ বা বৈধতা না পেলে তাঁর আত্মবিশ্বাস আঘাত খাবে। আর যাঁদের কিছু কিছু পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার রয়েছে, তাঁরা অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তৃপ্তি পান। তাঁদের মনে হয়, সম্পর্কে এই আচরণ করে তিনি এগিয়ে রয়েছেন।”

কিছু বিশেষ ধরনের পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে এই আচরণ দেখা যায়। যেমন, নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা দেখা যায়। স্পষ্ট করে বললে, নিজেকে ক্ষমতার মধ্যে রাখতে বা ক্ষমতা জাহির করতে যারা ভালবাসে তাদের মধ্যেই দেখা যায় অন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা। এর সঙ্গে রয়েছে আত্মবিশ্বাস কম হওয়ার ব্যাপারটাও। হঠাৎ হঠাৎ শীতল হয়ে যাওয়ার পিছনে কাজ করে ক্ষমতাশীল হওয়ার লোভ এবং আত্মবিশ্বাস কম হওয়া। সঙ্গতে কমিটমেন্ট ফোবিয়া। অর্থাৎ, এটা মনে হওয়া যে আমি যদি এই সম্পর্কে রাজি হয়ে যাই, তা হলে আমাকে বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। আমি দায়িত্বটা নিতে চাইছি না। কিন্তু মনোযোগ পেতে ভাল লাগছে। আমাকে যে কেউ চায়, এই বিষয়টা ভেবেই ফুরফুরে মনে দিন কেটে যাচ্ছে। তাই, আমার দায়িত্বহীনতায় কেউ বিরক্ত হয়ে সরে যেতে চাইলে তখন তাকে মিষ্টি কথায় ফিরিয়ে আনছি নিজের কাছে।

ডা. মুখোপাধ্যায় জানালেন, “বিহেভিয়োরাল সায়েন্সের পরিভাষায় একে বলা হয় ইন্টারমিটেন্ট রিইনফোর্সমেন্ট। জুয়া খেলায় সব সময় জেতা যায় না, কিন্তু জেতার মোহে বার বার খেলা হয়। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এটা কাজ করে।”

পাশাপাশি তিনি আরও জানালেন, যদি এমন হয় যে দু’জনেই সিরিয়াস কোনও সম্পর্কে যেতে রাজি না হন, তাদের ক্ষেত্রে এই আছি, এই নেই সম্পর্ক খুব একটা ক্ষতি করে না। কিন্তু এক জন সম্পর্কে যেতে চান, আর এক জন ভান করছেন, সেখানে সম্পর্ক না এগোনোই ভাল।

‘ব্রেডক্রাম্বিংয়ের’ শিকার হলে কী ভাবে বুঝবেন?

দু’টি মানুষের মধ্যে এক জন হঠাৎ কাছে, হঠাৎ দূরে। অপর জন তার মনের তল বোঝে না। এই অপর জন যদি বিরক্ত হয়ে সরে আসতে চায়, সেটা টের পেয়ে কাছে-দূরের মানুষটি ভীষণ ভাল ব্যবহার করতে শুরু করে। কখনও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং, কখনও গভীর অনুভূতির দোহাই দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করে। সেই সময় হয়তো ‘মায়ের শরীর কেমন আছে’ জাতীয় প্রশ্ন করেও মন জয় করতে চায়। ফলে, অপর জনের বিরক্তি কমে আসে, সে মনে করে সব ঠিক আছে।

ব্রেডক্রাম্বিং কর্মক্ষেত্রে, পারিবারিক জীবন বা বন্ধুদের মধ্যেও দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রে কেউ হয়তো বিরক্ত হয়ে চাকরি ছাড়ার কথা ভাবেন, সেই মুহূর্তে ফের প্রতিশ্রুতি, কিন্তু আদতে কিছুই হয় না। পরিবারে বা বন্ধুদের মধ্যেও প্রয়োজনের তাগিদে মধুর ব্যবহার, প্রচুর কথা বলা আর প্রয়োজন ফুরোলেই ‘চিনি না’ এই আচরণ বার বার দেখা যায়।

কী ভাবে সামলাবেন?

প্রিয় মানুষটির এই প্রবণতা দেখলেই প্রথমে নিজের কাছে স্পষ্ট হোন আপনি কী চান। তার পরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন তিনি কী চান। তাতে কাজ না হলে, সম্পর্কটি থেকে সরে আসতে হবে। ভেঙে পড়লে আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বাড়াতে মনোবিদের সাহায্য নিতে পারেন। যিনি ব্রেডক্রাম্বিং করছেন তাঁকেও বোঝানো প্রয়োজন, তিনি এই আছি-নেই-এর নেশায় মজে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। তাঁরও আসলে কাউন্সেলিং প্রয়োজন। না হলে কাছে-দূরের খেলা থেকে বেরিয়ে, কখনও সুস্থ সম্পর্কের দায়িত্ব নিতে পারবেন না।

আর যিনি এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ব্রেডক্রাম্বিং জাতীয় সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হল আত্মবিশ্বাস তথা সেলফ ওয়ার্থ সুদৃঢ় করা। সমাজমাধ্যমের দৌলতে এই প্রবণতা এখন বেড়েছে জেনারেশন জ়ি-র মধ্যে। জানা-অজানার ধোঁয়াশার মাঝের জায়গাতেই তৈরি হচ্ছে সম্পর্কের খুড়োর কল।

মনে রাখতে হবে

নিজের প্রয়োজনে সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে চান এমন মানুষকে প্রশ্র‍য় দেবেন না।

প্রেম-ভাললাগার পাশাপাশি "ব্রেডক্রাম্বিং" দেখা যায় কর্মক্ষেত্রে, বন্ধুদের মধ্যে, এমনকি পরিবারেও। তাই সব ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকুন।

আর একটা জিনিসও বুঝতে হবে, আপনি নিজেই ব্রেডক্রাম্বিং করছেন না তো? করলে সেটা কেন করছেন? নিজেকে বোঝার জন্য প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করাতে পারেন।

মডেল: অভীপ্সা খন্না, দেবদীপ চট্টোপাধ্যায়, সোমরাজ মাইিতি, আয়ুশী তালুকদার; মেকআপ: অভিজিৎ কয়াল (অভীপ্সা, দেবদীপ); ছবি: অমিত দাস; লোকেশন: দ্য পার্ক হোটেল

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy