বাহুমূলের কেশ নিয়েই ছবি তুলেছেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী এমিলি রটাকোস্কি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
নারীর চুল হবে অন্ধকার বিদিশার নিশার মতো, এমন চাহিদা রয়েছে অনেকেরই। কিন্তু কেশ যদি মাথার না হয়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গের হয়? হাত-পা থেকে বাহুমূল, নারীশরীরের কোথায় কতটা লোম থাকবে, তা-ও যেন সমাজনির্দিষ্ট। নারীর শরীরে রোম থাকলেই তা কামিয়ে ফেলতে হবে— এমন ধারণা আজও রয়ে গিয়েছে অনেকের মনে। সেই ধারণা ভাঙতেই এ বার এগিয়ে আসছেন বেশ কিছু তারকা। তাঁদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন বহু সাধারণ নারীও। ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে কেশ কামাব না,’ কিছুটা এমন স্লোগানেই তাঁরা ভাঙতে চাইছেন প্রচলিত ধারণা।
পিছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস
দেহের বিভিন্ন অঙ্গের লোম না কামানোকে অনেকেই নারীমুক্তি আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবেই দেখছেন। যাঁরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কারও কারও মতে, নারীর বাহুমূলে লোম দেখতে অভ্যস্ত না হওয়ার চোখ সচেতন ভাবে তৈরি করা হয়েছে। এর পিছনে রয়েছে মূলত দু’টি বিষয়। এক, সৌন্দর্যের চিরাচরিত ধারণা। আর অন্য দিকটি বিপণন।
আজ থেকে নয়, নারীর শরীর কেমন হবে, তা নিয়ে কিছু বদ্ধমূল ধারণা সচেতন ভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতাতেও দেহের লোম কামিয়ে ফেলার চল ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। কিন্তু তাতে লিঙ্গনিরপেক্ষতা ছিল। সমাজের উচ্চ বর্গের মানুষ বিষয়টিকে শালীনতার অংশ হিসাবে দেখতেন। তাই নারী ও পুরুষ উভয়েই দেহের রোম পরিষ্কার করতেন। শোনা যায়, রানি ক্লিওপেট্রা মধু ও পদ্মপাতা বাটা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের মিশ্রণ ব্যবহার করতেন এই কাজে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালের আশপাশে রোমানদের মধ্যেও এই বিষয়টি দেখা যেত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি উচ্চ বর্গের নারীর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসাবে দেখা শুরু হয়। গ্রিক ও রোমান দেবীদের যে মূর্তি ও ছবি দেখা যায়, তাতে এই বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায়। ভেনাস কিংবা অ্যাফ্রোদিতির ছবি কিংবা মূর্তিতে কোনও রকম দৈহিক লোমের অস্তিত্ব নেই। ১৫০০ সাল নাগাদ যখন রানি এলিজাবেথ ক্ষমতায় আসেন, তখন ইউরোপীয় নারীদের মুখের লোম কেমন হবে তা নিয়ে একটি পরিষ্কার চল আসে। মুখের কোনও রকম চুল রাখা তখন নারীর সাজের ধারণার বিপ্রতীপ হয়ে দাঁড়ায়।
বিংশ শতকের গোড়ার দিকে বিষয়টি ঘুরে যায় বিপণনের দিকে। বিভিন্ন পোশাক নির্মাতা সংস্থা ও প্রসাধনী সংস্থা নারীদের দেহের লোমকে নেতিবাচক বিষয় হিসাবে তুলে ধরে। ১৯১৫ সালে জিলেট সরাসরি দাবি করে, নারী দেহের লোম অপমানজনক। সুন্দরী নারীরা তাঁদের বাহুমূল পরিছন্ন রাখেন বলেও দাবি করা হয় বিজ্ঞাপনে। একই চল দেখা যায় জীবনশৈলীর বিভিন্ন পত্রিকায়। একটি পত্রিকায় শুরু হয় ‘দ্য গ্রেট আন্ডারআর্ম’ অভিযান। এতে সরাসরি নারীদের বাহুমূলে চুল রাখার বিরোধিতা করা হয়।
স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি
সামাজিক নির্মাণে যা-ই বলার চেষ্টা করা হোক, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান কিন্তু বলছে বহু ক্ষেত্রেই দেহের বিভিন্ন স্থানের লোম উপড়ে ফেলার এই চল ভাল নয় শরীরের জন্য। চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, লোম বিবর্তনের অংশ। ত্বককে রক্ষা করতে ও বিভিন্ন গ্রন্থির ক্ষরণে এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া, বগল কিংবা যৌনাঙ্গে যে কেশ থাকে, তার কাজ আরও বেশি। ওই সকল অঙ্গের ত্বক অনেক বেশি স্পর্শকাতর, থাকে বিভিন্ন গ্রন্থিও। তাই সেগুলিকে ঘর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন হয় কেশের।
গোপনাঙ্গের কেশ কামিয়ে ফেলতে গিয়ে বিপদে পড়েন বহু নারীই। কখনও তৈরি হয় অবাঞ্ছিত ক্ষত, কখনও কোনও না কোনও গ্রন্থি ফুলে ওঠে। ত্বকে দেখা দিতে পারে ব্রণর সমস্যাও। এই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট অঙ্গে ঘাম বা ময়লা জমা হলে বেড়ে যায় জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা। তাই বহু নারীই এখন রাজি হচ্ছেন না কেশ নির্মূল করতে। এই তালিকায় রয়েছেন হলিউডের মাইলি সাইরাস থেকে ম্যাডোনার মতো তারকারাও। দেহের কেশ নিয়ে সঙ্কোচ রাখতে রাজি নন তাঁরা। বাহুমূলের কেশের ছবিও তুলতে দেখা গিয়েছে তাঁদের। কিছু ক্ষেত্রে আবার হরমোনের সমস্যা থাকলে মুখের দাড়ি- গোঁফও দেখা দিতে পারে নারীদের। অনেক নারী কামাতে রাজি নন সেই দাড়িও। কিছু দিন আগেই কেরলে গোঁফ রেখে শিরোনামে উঠে এসেছিলেন আমেরিকার এক মহিলা। এ দেশেও বিভিন্ন সময়ে বহু নারী বাহুমূলের রোম না কামিয়ে হাতকাটা পোশাক পরে সৌন্দর্য সম্পর্কে নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। এখন এ সংক্রান্ত সচেতনতা আরও বাড়ছে। স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও বহু নারী দেহের রোম কামানো বা ওয়্যাক্স করার বিরোধিতা করছেন। সব মিলিয়ে কে নিজের শরীরের লোম রাখবেন, আর কে রাখবেন না, তার সম্পূর্ণ অধিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাতেই থাকা উচিত বলে দাবি জানাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy