Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
অটোইমিউন ডিজ়িজ় হওয়া মানেই জীবন শেষ নয়। চিকিৎসকের কথা মেনে চললে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। প্রয়োজন মনোবল ও ধৈর্য 
Disease

হাল ছেড়ো না বন্ধু...

অটোইমিউন ডিজ়িজ় কী? এই রোগে আক্রান্ত হলে কি সারা জীবনই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে?

নবনীতা দত্ত
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:১৯
Share: Save:

বেশ ক’দিন ধরেই খুব ক্লান্ত লাগছে দিয়ার। রোজই জ্বর আসছে। অ্যান্টিবায়োটিকস খেয়েও জ্বর কমছে না। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানা গেল, দিয়া একটি অটোইমিউন ডিজ়িজ়ে আক্রান্ত। অটোইমিউন ডিজ়িজ় কী? এই রোগে আক্রান্ত হলে কি সারা জীবনই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে? চিকিৎসকদের মতে, ব্যক্তিবিশেষে এ রোগের ধরন যেমন আলাদা, তেমনই তার চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে আগে জানতে হবে, এই রোগ কেন হয়?

অটোইমিউন ডিজ়িজ় কী?

মেডিসিনের ডা. অরুণাংশু তালুকদার কথায়, ‘‘আমাদের শরীর জন্মের পর থেকেই কোনটা সেল্ফ আর কোনটা নন-সেল্ফ সেই পার্থক্য বুঝতে শুরু করে। যখন শরীরে ফরেন প্রোটিন প্রবেশ করে, তখন শরীর সচেতন হয়ে যায়। ফলে সে অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করে এবং সেই অ্যান্টিজেনকে আক্রমণ করে শরীরের অনাক্রম্যতা বাড়ায়। কিন্তু যখন শরীর কোনটা সেল্ফ ও কোনটা নন-সেল্ফ বুঝতে পারে না, তখন নিজের কোষকেই সে ফরেন প্রোটিন ভেবে আক্রমণ করে। একেই বলে অটোইমিউন ডিজ়িজ়।’’

এ ক্ষেত্রে রোগীর ইমিউন সিস্টেম রোগীর শরীরকেই আক্রমণ করে। রিউমাটোলজিস্ট ডা. অভ্রজিৎ রায় বললেন, ‘‘জন্মের তিন বছর অবধি বাচ্চার ইমিউনিটিতে নিজের কোষের প্রতি একটা টলারেন্স তৈরি হয়। ফলে সে নিজের কোষের ক্ষতি করে না। কিন্তু তিন বছরের মধ্যে যদি তা ডেভলপ না করে, বড় হলে টি-সেল তখন বি-সেলকে উদ্দীপিত করে অটো-অ্যান্টিবডি তৈরি করার জন্য। এই অটো-অ্যান্টিবডি মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের যে কোনও অংশে আক্রমণ করতে পারে। শরীর নিজের কোষের বিরুদ্ধে একটা প্রোটিন তৈরি করে নিজেরই ক্ষতি করা শুরু করে। লুপাস রোগে এ রকম হতে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে শরীরের কোন অংশে তা আঘাত করছে, সেই অনুযায়ী রোগের ধরন ও চিকিৎসা পদ্ধতি পাল্টাতে থাকে। যেমন কিডনিতে আঘাত করলে যে চিকিৎসা হবে, মাথায় আঘাত করলে তা হবে না।’’ অটোইমিউন ডিজ়িজ় যেমন অনেক ধরনের হয়, তেমনই শরীরের কোন অংশে হচ্ছে তার উপরেও নির্ভর করে রোগের গুরুত্ব ও চিকিৎসা।

এই রোগের ধরন

কিছু ধরনের ডায়াবিটিস, কিছু থাইরয়েড, কয়েক ধরনের শ্বেতি যেমন এই রোগের মধ্যে পড়ে, তেমনই অটোইমিউন আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাসও (সিস্টেমিক লুপাস ইরিথেম্যাটোসাস)অটোইমিউন ডিজ়িজ়। লাংস থেকে শুরু করে পেশিকেও আক্রমণ করতে পারে এই রোগ। মধ্যবয়স্ক মহিলাদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আবার রোগীর শরীরের উপরে নির্ভর করে রোগের প্রকোপ কতটা হবে। কারও ক্ষেত্রে অটোইমিউন ডিজ়িজ় খুব একটা কাবু করতে পারে না, অনেকের আবার সারা জীবনই অসুখ কখনও বাড়ে, কখনও কমে... এ ভাবে চলতে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে আবার হঠাৎ রোগ অনেকটা বেড়ে যায়। তাই অবশ্যই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত কি না, তা বুঝবেন কী ভাবে?

রোগের লক্ষণ কী?

ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। জ্বর আসে, তা অ্যান্টিবায়োটিকসেও কমে না। আবার অনেকের গাঁটে-গাঁটে ব্যথা হয়, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এলে বিভিন্ন পরীক্ষা করে রোগনির্ণয় করা হয়। ব্লাড কালচার, ইউরিন কালচার, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির পরীক্ষা করে কোনও ইনফেকশন পাওয়া না গেলে, তখন বিভিন্ন ধরনের রক্তপরীক্ষা যেমন রিউমাটয়েড ফ্যাক্টর, অ্যান্টি সিসিপি, অ্যান্টি নিউক্লিয়ার ফ্যাক্টর ইত্যাদি করতে দেওয়া হয়। ইনফেকশন বাদ দেওয়ার পরে ইমিউনোলজিক্যাল ডিজ়িজ়ের কথা ভাবা হয়। অনেক সময়ে মুখের লালা শুকিয়ে যায়। ড্রাই আইজ়ের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

চিকিৎসা হবে কী ভাবে?

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইমিউনিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে রোগীদের স্টেরয়েড দেওয়া হয়। কারণ স্টেরয়েড হল ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট। স্টেরয়েডের ডোজ়ও দু’ভাগে ভাগ করা হয়, লো-ডোজ় (১০ মিলিগ্রাম বা তার কম) ও হাই ডোজ় (৪০-৬০ মিলিগ্রাম) অথবা ইন্ট্রাভেনাস ডোজ় (১ গ্রাম) পর্যন্ত দেওয়া হয়। গাঁটে-গাঁটে ব্যথা কমাতে, শরীরের ক্লান্তি কমাতে, অটোইমিউন রেসপন্স কমাতে স্টেরয়েড ভাল কাজ দেয়। তবে স্টেরয়েড বাদ দিয়েও এ রোগের চিকিৎসা কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব। ডা. অভ্রজিৎ রায়ের কথায়, ‘‘বেশি স্টেরয়েড না দিয়ে অ্যাজ়াথিয়োপ্রাইন, সাইক্লোস্পোরিন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এই ধরনের ওষুধ দেওয়া হয় রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও লুপাসে আক্রান্ত রোগীদের। আবার অনেক সময়ে কেমোথেরাপির প্রয়োজন পড়ে। অনেক রোগীর হাতের আঙুলে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। তখন কেমোথেরাপি যেমন সাইক্লোফসফামাইডও ব্যবহার করা হয়।’’

কম ডোজ়ের স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা শুরু করে, দরকার মতো ডোজ় বাড়িয়ে আবার কমানো হয়। তবে প্রাণসংশয় দেখা দিলে হাই ডোজ়ের স্টেরয়েড দেওয়া হয়। নেফ্রাইটিস বা ব্রেন অ্যাটাকের মতো মেজর অর্গ্যান আক্রান্ত হলে হাই ডোজ় দেওয়ার কথা ভাবা হয়। পরে সেই ডোজ় ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়।

দীর্ঘ দিন স্টেরয়েড কি নিরাপদ?

ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অস্টিয়োপোরোসিস ইত্যাদি অসুখ বাড়তে পারে। মনে রাখবেন, প্রত্যেকের শরীরেই কিন্তু ২৫ মিলিগ্রাম কর্টিজ়ল তৈরি হয় অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে। তাই স্টেরয়েড কিন্তু আমাদের শরীরেরই অংশ। স্টেরয়েড নেওয়ার কথা ভেবে আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। তবে জেনারেল মেডিসিনের ডাক্তার সুবীরকুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘এই রোগ নিয়ন্ত্রণে স্টেরয়েডের কার্যকারিতা রয়েছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে সাবধানতা জরুরি। যেহেতু এটি ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট, তাই বেশি এক্সপোজ়ড হলে ইনফেকশনের আশঙ্কা বেড়ে যায়। ইউটিআই থেকে শুরু করে সব ধরনের ইনফেকশনের ভয় থাকে। তাই বাড়তি সতর্কতা জরুরি। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।’’

অটোইমিউন ডিজ়িজ় কি কমে?

নিয়ম মেনে চললে এই অসুখও নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। ডা. অভ্রজিৎ রায় বললেন, ‘‘অটোইমিউন ডিজ়িজ়ের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অসুখ হল ভাসকুলাইটিস বা স্মল ব্লাড ভেসেল ডিজ়অর্ডার। যেহেতু শরীরের প্রত্যেক জায়গায় শিরা ও ধমনী রয়েছে, তাই এ রোগ ছড়ায় তাড়াতাড়ি। এই অসুখে মর্টালিটি রেটও হাই, প্রায় ১৫ শতাংশ। কিন্তু এ রোগেও এখন সারভাইভাল রেট বেড়েছে। ১৯৬০ সালে রোগনির্ণয়ের চার বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ রোগী মারা যেতেন। ২০১৮ সালে সেই সারভাইভাল রেট ৮৫ শতাংশ। এখন আরও বেড়েছে। এমন রোগীও আছেন, যাঁদের সন্তান হয়েছে ও সংসারজীবনও করছেন। উদাহরণস্বরূপ, লন্ডনের প্রফেসর ডেভিড আইসেনবার্গের পর্যবেক্ষণের উল্লেখ করতে হয়। তাঁর কাছে চিকিৎসাধীন লুপাস রোগীদের পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে যে, চিকিৎসা চলাকালীন অনেকেই একটা ভাল ফেজ় পায়, যখন এঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। তখন খুব একটা ওষুধেরও দরকার পড়ে না। এমনকি এএনএ নেগেটিভ হয়ে যায় সে সময়ে।’’ বছর তিনেক পর্যন্ত এ রকম ভাল ফেজ় পেয়েছেন, এমন রোগীর উদাহরণও আছে। পরে মানসিক উদ্বেগ বা ভাইরাল ইনফেকশনের জন্য রোগ ফিরে আসতে পারে। কিন্তু চিকিৎসা চালু রাখলে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

এ রোগে সবচেয়ে বেশি দরকার ধৈর্য। এই অসুখ হলে সারা জীবন চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে চিকিৎসাবিদ্যা এখন এতটাই এগিয়েছে যে, অটোইমিউন ডিজ়িজ়ও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। চিকিৎসকদের মতে, হাল না ছেড়ে রোগের মোকাবিলা করার মনোবল রাখতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Disease
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy