Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
শহর কলকাতার বহু পুরনো পাড়ায় প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে বাঙালির সংখ্যা। এই বদল হল কবে, কী ভাবে?
West Bengal Assembly Election 2021

ভোটের হাওয়ায় বাড়ছে ‘বন্ধু’র সঙ্গে ‘ইয়ার’-এর দ্বন্দ্ব

মুদিয়ালির বাসিন্দা, পেশায় কলেজ শিক্ষক স্বর্ণকমল সাহা বলছিলেন, “কথায় কথায় ‘কেন কী’ আর ‘বাট’ শব্দটি শুনে হাঁফিয়ে যাচ্ছি।

—প্রতীকী ছবি

—প্রতীকী ছবি

ভোটের হাওয়ায় বাড়ছে ‘বন্ধু’র সঙ্গে ‘ইয়ার’-এর দ্বন্দ্ব
নীলোৎপল বিশ্বাস শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২১ ০২:৫৩
Share: Save:

মানিকতলা গৌরীবাড়ির পুরনো বাঙালি পাড়ায় জনপ্রতিনিধির তরফে ইংরেজি নববর্ষের ব্যানার পড়েছিল সাতটি। এই সময়ে বেশি ব্যানার পড়ে ইংরেজিতেই। কিন্তু গৌরীবাড়ির চারটিই হিন্দিতে। দু’টি ইংরেজি আর মাত্র একটি বাংলায়!

এমনটা কেন? বার কয়েক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টার পরে জন প্রতিনিধি বললেন, “ওটা আর বাঙালি পাড়া নেই। অবাংলাভাষীর সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গিয়েছে। ওঁদের কাছে পৌঁছনোর দায় তো আছেই!” এর পরে স্বগতোক্তির ঢঙে বললেন, “আমি হিন্দি পড়তে পারি না। কিন্তু হিন্দিতে এমন কথা বলব যে বোঝা যাবে না। হিন্দি রাখব না বাংলা, সেই দ্বন্দ্ব মিটিয়ে এ বারের মতো হিন্দিতেই ব্যানার বানিয়ে ফেলেছি। দেখা যাক, কেমন সাড়া মেলে!”

জনপ্রতিনিধি এই দ্বন্দ্ব সাময়িক ভাবে মেটাতে পারলেও পাড়ায় পাড়ায় ‘বন্ধু’র সঙ্গে ‘ইয়ার’-এর, ‘ওই’-এর সঙ্গে ‘আব্বে’-র, পাঞ্জাবির সঙ্গে কুর্তার, ঘোলের সঙ্গে লস্যির, আলপনার সঙ্গে রঙ্গোলির, গায়ে হলুদের সঙ্গে মেহেন্দির বা সঙ্গীতের, দোলের সঙ্গে হোলির, দীপাবলির সঙ্গে দিওয়ালি বা ধনতেরসের দ্বন্দ্ব মিটছে কই? ভোটের হাওয়ায় তা আরও বেড়ে গিয়েছে বলেই খবর। কোথাও অবাঙালিদের নাম করে ‘বহিরাগত’ লেখা ব্যানার পড়ছে। কোথাও আবার নিজেদের নাম-ছবি দিয়ে কেউ লিখছেন, ‘আমরাই ভূমিপুত্র’! রাজনৈতিক নেতা থেকে সমাজতত্ত্বের শিক্ষকেরা যদিও মনে করছেন, এই দ্বন্দ্ব এক দিনের নয়। বদলে যাওয়া পাড়ার চরিত্রের সঙ্গেই তা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। শহরে নতুন তৈরি হওয়া খাবারের দোকানের নাম ইংরেজিতে বা হিন্দিতে রাখার ঝোঁকই বেশি। বেহালায় একটি মাঠের উদ্বোধনের আগে নামফলকের ভাষা ইংরেজি থেকে বদলে হিন্দিতে করা হয়েছে বদলে যাওয়া চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে।

মুদিয়ালির বাসিন্দা, পেশায় কলেজ শিক্ষক স্বর্ণকমল সাহা বলছিলেন, “কথায় কথায় ‘কেন কী’ আর ‘বাট’ শব্দটি শুনে হাঁফিয়ে যাচ্ছি। নিজের ছেলে-মেয়ে তো বটেই, জন প্রতিনিধিরাও এখন দেখছি নিজের ভাষা শুদ্ধ ভাবে বলতে পারছেন না। এ আসলে দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বাস করা অবাঙালি প্রতিবেশীর প্রভাব।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শ্যামপুকুর স্ট্রিটের অনিতা দত্তগুপ্ত বললেন, “মেয়ে কয়েক দিন আগে বাংলায় কথা বলতে বলতে হঠাৎ আহ্লাদের সুরে হিন্দিতে বলল, ‘কব বোলনা থা?’ আহ্লাদ করে হলেও এ ভাবে অন্য ভাষা ঢুকিয়ে দেওয়া আমার একেবারেই অপছন্দ। প্রতিবেশীর সঙ্গে আমরা ছেলে-মেয়েদের মিশতে দিই কতখানি? কিন্তু ওদের সর্বক্ষণের সঙ্গী সোশ্যাল মিডিয়াতেই তো নানা ভাষার মিশ্রণের ছড়াছড়ি।” গড়িয়াহাট মোড়ের শাড়ির ব্যবসায়ী অংশুমান দত্তের আবার দাবি, “একটু হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বললে খুব ‘আপ-টু-ডেট’ মনে হয়। ক্রেতাদের সঙ্গে মিশতে মিশতেই এটা শিখেছি।”

শিক্ষাবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য যদিও মনে করেন, “কোন ভাষা বলছি আর সেটা শুদ্ধ ভাবে বলছি কি না, সেটা নির্ভর করে জীবনযাপনের উপরে। পথচলতি যে সব ভাষা কানে যাচ্ছে, সেটা কী ভাবে আত্মস্থ করছি সেটাও একটা ব্যাপার। দীর্ঘদিন ধরে গড়িয়াহাটের আড্ডা চত্বরেরই তো কত বদল হয়েছে। সেখানে যে সব পেল্লায় বাড়ি উঠেছে, তা কেনার ক্ষমতা বাংলাভাষীদের বড় অংশেরই তো নেই। ফলে অবাংলাভাষীদের যে ভিড় আমাদের আশপাশে বাড়ছে, তার প্রভাব পড়ছে চলতে ফিরতে কানে আসা ভাষার উপরেও।” সেই সঙ্গেই তাঁর মত, “ভোটের রাজনীতির জন্য ভাষার আগ্রাসনের দিকটিকে এত ক্ষুদ্র আকারে দেখা একেবারেই অনুচিত। শক্তি এবং‌ ব্যবহার অনুসারে যে কোনও ভাষা একটি অন্য ভাষাকে বিপন্ন করার ক্ষমতা রাখতে পারে। বাংলা ভাষাও বহু ক্ষেত্রে এমন প্রভাব বিস্তার করে অন্য ভাষার উপরে। আসল প্রশ্নটা হল, বাংলা ভাষার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য আমরা নষ্ট হতে দিচ্ছি কি না, সেইটা।”

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বললেন, “আমি অন্তত বাংলা ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বলে এখনও মনে করতে পারি না। হিন্দির পরে এই বাংলাই ভারতের সবচেয়ে চর্চিত ভাষা। অন্য কোনও ভাষা থেকে আসা শব্দ বাংলায় মিশলে ক্ষতি হয় না, বরং লাভই হয়। আসলে হিন্দি সিনেমা থেকে কিছু মানুষ প্রভাবিত হচ্ছেন, তার জেরেই বাংলাটা তাঁদের মুখে একটু অন্য রকম শোনায়। এর সঙ্গেই পড়ছে অবাঙালিদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার প্রভাব।”

সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র যদিও মনে করেন, “মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। নামকরণ থেকে ভাষার ব্যবহার, সবতেই একটা বদল এসেছে। এর সঙ্গেই প্রগাঢ় হচ্ছে একটা মিশ্র সংস্কৃতির জন্মের ভিত। বিনা বাধায় এই বদল মজ্জাগত হয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ, বাইরের বিষয়কে বাঙালি বরাবরই সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছে। হিন্দির আগ্রাসনে শুধুমাত্র ভাষার ব্যবহারিক বদল নয়, এ আসলে সংস্কৃতির বদল।”

এই সংস্কৃতির বদল নিয়েই চর্চা চলছিল রাতের মেট্রোয়। এক যাত্রীর প্রশ্নের জবাবে অন্য যাত্রী বললেন, “আজ হঠাৎ বহিরাগতদের হাতে সংস্কৃতি বিপন্ন মনে হচ্ছে? এত দিনে ভূমিপুত্রদের ভাষা থেকে হাবভাব— সবই যে বহিরাগতদের মতো হয়ে গেছে সেটা কে দেখবে! আসলে ভাঙা হিন্দি, ভাঙা বাংলা নিয়ে বহিরাগত খুঁজতে নেমেছে ‘আপ টু ডেট’ বাঙালি!”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy