এ দেশে অনেক মহিলাই একা যাপনের পক্ষে।
রেস্তরাঁয় একা বসে থাকা বছর তিরিশের মেয়েটির দিকে সকলেই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। ছুটির দিনে কেউ এমন একলা খেতে আসে নাকি! হতে পারে মেয়েটি জরুরি কোনও পরিস্থিতিতে একা এসেছে। কিংবা তার ভীষণ ভাবে ভাল খাবার খেতে ইচ্ছে করছিল, তাই দোকা হওয়ার পরোয়া করেনি বা অন্য কিছু... তলিয়ে না ভেবেই আমরা ‘বিচারক’ হয়ে বসি। প্রশ্ন তুলি, সোলো ট্রিপে যাওয়া মেয়েটির ছবিগুলো কে তুলে দিয়েছে?
একা যাপন, একা উদ্যাপনে আপত্তিকর কিছু আছে কি? এর চেয়েও একধাপ এগিয়ে সোলোগ্যামি। যেখানে কেউ নিজেকেই বিয়ে করেন। নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। অনুষ্ঠান করে সেই প্রতিজ্ঞা পালন করেন। জনপ্রিয় টিভি সিরিজ় ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’র সারা জেসিকা পার্কার অভিনীত চরিত্র ক্যারি ব্র্যাডশ ঘোষণা করেছিল, সে নিজেকেই বিয়ে করবে। তার যুক্তি, সিঙ্গল মেয়েদের জীবনে উদ্যাপনের জন্য কি কিছুই নেই? ভুল মানুষকে বিয়ে করে যে সে পস্তাচ্ছে না, সেটারও তো সেলিব্রেশন প্রয়োজন। তার উপর বিয়ের পোশাক, খাওয়াদাওয়া, আড়ম্বর উপভোগ করতে হলে একজন সঙ্গীকে বেছে নিতে হবে, এমনটাই বা কে বলল? ২০০৩ সালে ক্যারি ব্র্যাডশর এই সংলাপ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছিল। দু’দশক পার করে সোলোগ্যামি আর ভ্রু কোঁচকানোর বিষয় নয় বিদেশে। কিন্তু এ দেশে আমরা এখনও চমকে উঠি এমন সিদ্ধান্তে। তাই গুজরাতের ক্ষমা বিন্দু যখন তাঁর সোলোগ্যামির সিদ্ধান্ত জানান, তখন নিন্দার ঝড় উঠেছিল। কোনও মেয়ে নিজের মর্জিতে একা থাকছে, আনন্দে থাকছে... এটা মেনে নিতে কোথাও আমাদের আটকায়। তার উপর কেউ যদি নিজেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে গেল গেল রব ওঠে বইকি। ক্ষমা বিন্দুই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি সোলোগ্যামির পথ বেছে নিয়েছেন। মেহন্দি, সঙ্গীত, সাতপাকে ঘোরা, সিঁদুর পরা... কোনও উপচারই বাদ দেননি ক্ষমা।
সাইকায়াট্রিস্ট জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘আমাদের মধ্যে স্টিরিয়োটিপিক্যাল ধারণা রয়েছে, একা থাকা মানেই সে কষ্টে আছে। বিয়ে না করলে, পার্টনার না থাকলে সেই মহিলা বা পুরুষ ভাল নেই বলে ধরে নেওয়া হয়। সঙ্গী থাকলেও বহু মানুষ কষ্টে থাকেন। একটি নামী সংস্থার সমীক্ষা বলছে, ভারতে বিবাহিত মহিলারাই বেশি আত্মহত্যা করেন, যাঁদের গড় বয়স ৩৫ বছর।’’
২০২২-এ দাঁড়িয়ে বিয়ের ধারণা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। মেয়েরা পারিবারিক-সামাজিক চাপ কাটিয়ে নিজের মতো জীবনযাপন করছেন। এখন অধিকাংশ শহুরে মেয়েই অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর। সেটা তাঁদের বাড়তি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। ডা. জয়রঞ্জন রাম তিনটি বিষয়ের উপরে জোর দিলেন। এক, বিয়ে করা বা সঙ্গী থাকাই মানেই জীবনের মোক্ষলাভ হল এমন নয়। দুই, কারও একাধিক বন্ধুবান্ধব থাকতে পারে, যাদের সঙ্গে সে রোম্যান্টিক রিলেশনশিপে রয়েছে। এবং বিবাহের স্বীকৃতির তাগিদ অনুভব করছে না। তিন, পার্টনার নেই মানেই সে একাকিত্বে ভুগছে, এটাও ভুল ধারণা। একাও মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। ডা. রামের মতে, ‘‘সোলোগ্যামি একটা সিম্বলিক মেসেজ। যেখানে মেয়েটি বলতে চাইছে, আমি নিজেকে বিয়ে করলাম, এ বার তোমরা দূরে থাকো। অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে পারিবারিক-সামাজিক চাপটা বেশি। ছেলেদেরও চাপ আছে, কিন্তু তুলনায় কম। শহুরে শিক্ষিত মেয়েরা যে সেই চাপ অগ্রাহ্য করে বেরোতে পেরেছে, এটা শুভলক্ষণ। গুজরাতের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েটির ওই সিদ্ধান্ত খুবই সাহসী পদক্ষেপ।’’
রোম্যান্টিক বা সেক্সুয়াল সম্পর্কের জন্য বিয়েটাই আগে একমাত্র পথ ছিল। সেই ধারণা বদলেছে। বদলে গিয়েছে মানুষের সামাজিক পরিসর। কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট যশোবন্তী শ্রীমানী বলছেন, ‘‘কম্প্যানিয়নশিপ আর বিয়ের গণ্ডিতে আটকে নেই। বর্তমান বাস্তবে মানুষ একা থাকছেন এবং ভাল থাকছেন। নিজের মতো করে সোশ্যালাইজ় করছেন। সকলেরই বিভিন্ন ধরনের সমাজিক বৃত্ত রয়েছে। কেউ বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে, বাচ্চাদের হোমে গিয়ে সময় কাটান। কেউ বেড়াতে যান। কেউ সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন গ্রুপে নিজের মতো করে সময়টা উপভোগ করছেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজন তো আছেনই।’’
শুধু গুজরাতের ক্ষমা বিন্দুই নন, হিন্দি ধারাবাহিকের পরিচিত মুখ কনিষ্কা সোনি সোলোগ্যামির পথ বেছে নিয়েছেন সম্প্রতি। সোশ্যাল মিডিয়ায় সে খবর জানিয়েছেন অভিনেত্রী। ক্ষমা বা কনিষ্কা বার্তা দিয়েছেন, তাঁরা নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেন। তাঁদের মতো সোলোগ্যামির পথ না বাছলেও, বহু মহিলাই এখন একা থাকছেন। সেই সিদ্ধান্তের পিছনে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বড় কারণ। স্বাধীন ভাবে নিজের মতো করে থাকা বাড়তি আত্মবিশ্বাস দেয়।
কিন্তু দীর্ঘ সময় একাযাপন কি কখনও মানসিক অবসাদের কারণ হতে পারে? মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম পাল্টা প্রশ্ন তুললেন, বিবাহিত এবং পরিবারের মধ্যে থেকেও কি অবসাদ গ্রাস করে না কাউকে? ‘‘একা থাকার সঙ্গে অবসাদের সম্পর্ক নেই। আসলে আমরা ধরেই নিই, কেউ একা আছেন মানেই তিনি খারাপ আছেন,’’ মন্তব্য তাঁর। একই কথা বলছেন যশোবন্তী শ্রীমানী। কেউ যখন একা থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে সেই যাপনে তিনি ভাল থাকছেন। কেউ নিজের জীবন কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, সেটা তাঁর সিদ্ধান্ত। অনেকের মতে নার্সিসিজ়মের একটা রূপ সোলোগ্যামি। অতিরিক্ত আত্মমগ্নতাও কি ভাল? ‘‘আমরা জোর দেব ভাল থাকার উপরে। তাতে যদি কেউ নার্সিসিস্ট হন, সেটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই,’’ বললেন যশোবন্তী শ্রীমানী।
এমনও হতে পারে ভবিষ্যতে গিয়ে কেউ নিজের একা থাকার সিদ্ধান্ত বদলাতে চান। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি, জীবনদর্শন সবটাই তো বদলায়। নিজের পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে ডা. রাম বলছিলেন, ‘‘কেউ আগে বিয়ে করেননি, পরে মনে হচ্ছে কোনও সঙ্গী থাকলে ভাল হত, এমন ঘটনাও দেখা যায়। কুড়ি বছর বয়সে আমরা জীবন নিয়ে যা ভাবি, চল্লিশ বছরে গিয়ে তা বদলাতেই পারে। রিগ্রেশন আসতেই পারে জীবনে। কিন্তু তাতেও প্রশ্ন তোলার কিছু নেই।’’ অনেক সময়েই দেখা যায়,পুরুষ বা মহিলাটি জীবনসঙ্গীর প্রয়োজন অনুভব করেননি। বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকেন। কিন্তু তাঁরা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, আশপাশের বন্ধন আলগা হয়ে যায়, তখন মনে হতে পারে কোনও সঙ্গী থাকলে ভাল হত। কিন্তু এই ক্রাইসিস কাটিয়েও অনেকে একা থাকার পথ বেছে নেন। আবার কেউ দোকা হতে চান। কোনওটাতেই তাঁকে বিচার করার অধিকার নেই কারও।
আমাদের দেশে সোলোগ্যামির আইনি স্বীকৃতি নেই। তবে বিদেশে সোলোগ্যামির ঘটনা অনেক বেশি এবং সেখানে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এই পথ বেছে নিতে বেশি আগ্রহী। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দেশে অনেক মহিলাই একা যাপনের পক্ষে এবং তাঁরা একা থাকছেনও। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কখনও কেউ এই সিদ্ধান্ত নেন, কেউ ব্যক্তিগত জীবনের ধাক্কা থেকে। আবার অনেক সময়েই বাবা-মায়ের অসুখী দাম্পত্য দেখার ফলে বিয়েতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আবার এই কারণগুলোর বাইরেও কেউ একা থাকতে পারেন।
সাইকোঅ্যানালিস্ট-লেখক সুধীর কাকরের একটি বিখ্যাত উক্তির কথা মনে করিয়ে দিলেন জয়রঞ্জন রাম। ‘‘বহু ভারতীয় দম্পতিই আসলে ডিভোর্সড, কিন্তু তাঁরা সেটা জানেন না।’’ তাই সোলোগ্যামি বা একা যাপনের দিকে আঙুল তোলার আগে ভাবতে হবে, সেই মানুষটা কেমন থাকছেন? কারণ দিনের শেষে ভাল থাকাটাই সবচেয়ে জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy