চোখের আলো। ফাইল চিত্র।
মৃৎশিল্পীর নিপুণ তুলির টানে চক্ষুদান হয় প্রতিমার। পদ্মপলাশের মতো চোখ খুলে প্রথমেই দেখে নেন শিল্পীকে, তার পর নজর পড়ে বিশ্বচরাচরে। মানুষের ক্ষেত্রে অপারেশন থিয়েটারে সেই দায়িত্ব নেন চিকিৎসক। সহায়ক হন চক্ষু দান করা মানুষটি। তাঁর সহায়তায় চোখের আলো ফিরে পান দৃষ্টিহীন মানুষেরা। বাস্তবিক, দৃষ্টিশক্তির মতো উপহার খুব কম রয়েছে।
কাকে বলে চক্ষু প্রতিস্থাপন?
চক্ষু প্রতিস্থাপন আদতে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন। চোখের আর কোনও অংশ প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। চোখের সামনের স্বচ্ছ অংশকে বলে কর্নিয়া। কর্নিয়ার মধ্য দিয়ে চোখের মধ্যে আলোকরশ্মি প্রবেশ করে ও রেটিনাতে কেন্দ্রীভূত হয়। আঘাত বা অসুস্থতার কারণে কর্নিয়া অস্বচ্ছ হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে দৃষ্টিহীনতা দেখা যায়। এক মাত্র কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফেরানো সম্ভব।
কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের চক্ষু বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডা. জ্যোতির্ময় দত্ত বললেন, “পেঁয়াজের খোসার মতো পাঁচটি স্তর রয়েছে কর্নিয়ার। সেগুলি আলাদা করে তুলে ফেলতে পারেন চিকিৎসক। আগে কারও কর্নিয়া নষ্ট হয়ে গেলে মৃতদেহের চোখ থেকে সম্পূর্ণ কর্নিয়া তুলে প্রতিস্থাপন করা হত। এখন যে লেয়ারটি নষ্ট হয়েছে শুধু সেটি তুলেই প্রতিস্থাপন সম্ভব। ফলে, একটা চোখের কর্নিয়া দিয়ে দু’তিন জন মানুষের চোখের দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব।” তবে মানুষের চোখে অন্য জীবজন্তুর কর্নিয়া দিয়ে প্রতিস্থাপন এখনও সফল নয়।
কেন অস্বচ্ছ হয় কর্নিয়া?
ডা. দত্ত জানালেন, মূলত কর্নিয়া অস্বচ্ছ হয় দুটি ‘ইন’-এর মাধ্যমে—
* ইনজুরি বা চোখে চোট-আঘাত
* ইনফেকশন বা কোনও সংক্রমণ, কর্নিয়াল আলসার। কোথাও কেটে গেলে শুকিয়ে যাওয়ার পর যেমন দাগ থাকে, কর্নিয়ার সংক্রমণ সেরে গেলেও একটি দাগ থেকে যায়। অস্বচ্ছতার শুরু সেখানেই। যেহেতু কর্নিয়ার ঠিক মাঝখানের অংশ দিয়ে দেখি, তাই সেই স্থানটি অস্বচ্ছ হয়ে উঠলে অন্ধত্ব অনিবার্য। জন্মগত ভাবেও কর্নিয়ার অস্বচ্ছতা থাকতে পারে। আবার, একটা দীর্ঘ সময় ভিটামিন এ-র অভাবে শিশুদের মধ্যে জ়েরোপথালমিয়া রোগ দেখা যেত। তাতেও কর্নিয়া অস্বচ্ছ হয়ে যেত। বর্তমানে পানীয় জল ও খাদ্যের উন্নতির ফলে জ়েরোপথালমিয়ার প্রকোপ অনেকাংশেই কমেছে।
প্রতিস্থাপনের নিয়মকানুন
ডা. জ্যোতির্ময় দত্ত জানালেন, কর্নিয়ায় কোনও শিরা-উপশিরা নেই, তাই অন্য অঙ্গের চেয়ে কর্নিয়া সংগ্রহ করা সহজ। মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে ছ’ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া সংগ্রহ সম্ভব। শীতকালে সময়টা একটু বেশি। সাধারণত মৃত্যুর আগে দেহ দানের অঙ্গীকার করলে কর্নিয়া দান করা সম্ভব। আবার কেউ যদি দেহ দান না করেন, তা-ও মৃত্যুর পরে তাঁর চোখ দান করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে তাঁর পরিজনকে। যাঁরা কর্নিয়া দান করেন তাঁদের এক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুর শংসাপত্র দেওয়া হয়।
চেষ্টা করা হয় যত দ্রুত সম্ভব মৃতদেহ থেকে কর্নিয়া তুলে অপারেশনের মাধ্যমে দৃষ্টিহীন ব্যক্তির চোখে প্রতিস্থাপন করতে। প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচারে চিকিৎসক কোনও টাকা নেন না।
প্রসঙ্গত, কার চোখ কাকে দেওয়া হয়েছে এটা সম্পূর্ণ গোপন থাকে। ডা. দত্ত এ-ও জানালেন, চোখ তথা কর্নিয়া কেনাবেচা করা যায় না।
রয়েছে কিছু কুসংস্কার...
কর্নিয়া দান নিয়ে মানুষের মধ্যে রয়েছে কুসংস্কার। তার মধ্যে অন্যতম হল, মৃত্যুর পরে চোখ দান করলে পরের জন্মে দৃষ্টিহীন জন্ম হবে। সে প্রসঙ্গে ডা. দত্ত জানালেন, মানুষের কুসংস্কারের পিছনে কোনও যুক্তি থাকে না। হ্যাঁ, সম্পূর্ণ চোখ তুলে নেওয়া নিয়ে অনেকের সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু এখন পুরো চোখ তোলা হয় না। শুধু কর্নিয়ার দেওয়ালটুকু তুলে নেওয়া হয়। পরে বিভিন্ন প্রিজ়ারভেটিভ মিডিয়ায় ডুবিয়ে রেখে ফ্রিজে রাখা হয়।
গ্রিফ কাউন্সেলর
ডা. দত্ত জানালেন, কিছু মানুষ রয়েছেন যাঁরা মানুষকে কর্নিয়া দান করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এদের বলা হয় গ্রিফ কাউন্সেলর। এঁরা এসে মৃতের পরিজনের সামনে সত্যটা তুলে ধরেন যে কর্নিয়া দান করলে কিছু মানুষ চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবেন।
কারা দান করতে পারেন?
সব মানুষই কর্নিয়া দিতে পারেন, তবে জীবন্ত অবস্থায় কর্নিয়া দান করা হয় না। মৃত ব্যক্তির বয়স ২০ থেকে ৩৫ হলে, তাঁর কর্নিয়া সবচেয়ে উপযুক্ত। মৃত ব্যক্তির ডায়াবিটিস বা মায়োপিয়া থাকলেও কর্নিয়া দেওয়া সম্ভব। তবে রেবিস, সেপ্টিসেমিয়া, টিটেনাস, এনকেফেলাইটিস, লিভারের কিছু রোগে কর্নিয়া নেওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়াও, অজানা কারণে মৃত্যু হলেও তাঁর কর্নিয়া নেওয়া হয় না। কোভিডও এই তালিকায় পড়বে।
লাসিক করা চোখের কর্নিয়া বা ৬০ বছরের বেশি বয়সিদের কর্নিয়া না নেওয়াই ভাল। এ ধরনের কর্নিয়া চোখে বসালে চোখ তা গ্রহণ করে না, ফলে ফিরে আসে দৃষ্টিহীনতা।
কর্নিয়া দান করতে চাইলে...
যিনি তাঁর মৃত পরিজনের কর্নিয়া দান করতে চাইবেন, তাঁর কিছু ভূমিকা রয়েছে। প্রথমে মাথার নীচে বালিশ দিয়ে মাথাটা উঁচু করে রাখতে হবে। তার পরে বরফজলে ভেজা রুমাল চোখের উপর বিছিয়ে দেওয়া। ফ্যান বন্ধ করে দেওয়া। এসি চলতে পারে, কিন্তু ফ্যানে কর্নিয়া শুকিয়ে যায়। এর পরে একটি অ্যান্টিবায়োটিক ও লুব্রিকেটিং আই ড্রপ দিলে ভাল হয়।
শেষ কথা...
এ দেশে কর্নিয়াল দৃষ্টিহীনতা বেশি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কমপক্ষে ৬৮ লক্ষ মানুষ কর্নিয়ার সমস্যায় এক চোখে দেখতে পান না। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ দু’চোখেই দেখতে পান না। প্রতি বছর ২৫ অগস্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর আই ডোনেশন ফোর্টনাইট পালন করে মানুষকে চক্ষুদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে ডা. দত্ত জানালেন, চক্ষুদানের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন সর্বোপরি চিকিৎসকদের এগিয়ে আসতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy