সব মিলিেয় প্রায় কুড়ি দিন ধরে ১৬টি ধাপ পেরিয়ে, তবে তৈরি হয় আজরখ প্রিন্ট। যে প্রিন্ট আজ তাবড় ফ্যাশন ডিজ়াইনারেরা নিজেদের কালেকশনে ব্যবহার করছেন, সাধারণ মানুষের ফ্যাশন তালিকায়ও এ বার তা ট্রেন্ডিং। এক কথায় বললে ন্যাচারাল ডাই এবং ব্লক প্রিন্টের সমাহারেই তৈরি আজরখ। এর বৈশিষ্ট্য হল, জিয়োমেট্রিক প্যাটার্ন। সাসটেনেবল এবং পরিবেশবান্ধব ফ্র্যাবিক পছন্দ করলে আজরখ বেছে নিতেই পারেন। শাড়ি, কামিজ, কুর্তি, ব্যাগ, স্কার্ফ, জ্যাকেট এবং ছেলেদের শার্ট— বাজার ছেয়ে গিয়েছে আজরখ প্রিন্টে। তবে আসল জিনিসের পাশাপাশি নকলও হাজির, অতএব সাবধান।
আজরখের ইতিবৃত্ত
আজরখ প্রিন্টের একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। গুজরাতের কচ্ছ উপকূল অঞ্চলে মূলত এই ফ্যাব্রিক তৈরি হয়। ইতিহাসের পাতা ওলটালে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের নাম পাওয়া যাবে, যেখানে এই শিল্পের প্রচলন শুরু। বলা হয়, সিন্ধের কিছু শিল্পী কচ্ছে এসে এই কাজ শুরু করেন। আরবি ভাষায় ‘আজ়রক’ কথার মানে নীল। ফ্যাশন ডিজ়াইনার পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও একটি সূত্রের কথা বললেন, ‘‘আজরক ভেঙে বললে হয় আজ-রাখ। যেহেতু এই ফ্যাব্রিক একদিনে তৈরি হয় না, সময় লাগে, সেই প্রসঙ্গে এসেছে আজ রেখে দেওয়া হোক কথাটি।’’ ইতিহাসের দীর্ঘসূত্রতায় কোথাও আজরক, কোথাও আজরখ। নামের বদল হলেও এর পদ্ধতি আর প্রকৃতিতে বদল হয়নি। আজরখ প্রিন্টের প্যাটার্নে মুসলিম স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট। ব্লক তৈরি করে কাপড়ে প্রিন্ট করা হয়, তার পর প্রাকৃতিক ডাই ব্যবহার করা হয়। এই ফ্যাব্রিকের আরও একটি ৈবশিষ্ট্য, কাপড়ের দু’দিকেই হুবহু একই প্যাটার্নে ব্লক প্রিন্ট করা হয়। প্রিন্টিং আর ডাইয়ের বিভিন্ন ধাপেই সময় লেগে যায় ২০-২১ দিন। এই কাজের জন্য শুষ্ক আবহাওয়া ও প্রচুর জল প্রয়োজন। যে কারণে কচ্ছ উপকূলে তৈরি আজরখের কদর বেশি। সুতি এবং সিল্কে এই ব্লক প্রিন্ট করা হয়। যেহেতু ন্যাচারাল ডাই ব্যবহার করা হয়, তাই খুব বেশি রঙের অপশন মেলে না। নীল, লাল, কালো, সাদার (খুব কম ব্যবহার) মধ্যেই রং ঘোরাফেরা করে। বলা হয়, আজরখের সঙ্গে প্রকৃতির যোগ রয়েছে। লাল হল পৃথিবীর প্রতীক, কালো অন্ধকারের, সাদা মেঘের আর নীল ব্রহ্মাণ্ডের। তবে হালফিলে চাহিদার কারণে সবুজ বা হলুদের ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে। আজরখ ডাই করতে যেহেতু মাটি ব্যবহার করা হয় তাই টেক্সচারে খানিকটা মেটে ভাব থাকে। কাপড়ের রংটাও চাপা, যে কারণে লাল রংটা অনেকটাই মেরুন ঘেঁষা।
ফ্যাশনে আজরখ
আজরখের আর্দি টোন, জিয়োমেট্রিক মোটিফ একে ক্লাসি করে তুলেছে, বলে মনে করেন পারমিতা। এই ফ্যাব্রিক এখন এত কেন জনপ্রিয়? ‘‘আমি নিজে অনেক বছর আজরখ নিয়ে কাজ করছি। অনেক সময়ে, হঠাৎ কোনও ট্রেন্ড জনপ্রিয় হয়। আজরখের ইউএসপি হল, এর জিয়োমেট্রিক প্যাটার্ন যে কোনও চেহারার মানুষকে মানায়।’’ কাপড় জুড়ে একই প্রিন্টের ঢালা কাজ। তাই আজরখের শাড়ি পরলে বৈচিত্র আনতে পারেন ব্লাউজ়ে। টিউব বা ক্রপ টপ পরতে পারেন কিংবা শাড়ির সঙ্গে বেল্ট ব্যবহার করলেন। সলিড কালারের ব্লাউজ় পরলেই মানাবে। অ্যাকসেসরি হিসেবে অক্সিডাইজ়ড গয়না অনেক বেশি মানানসই এই ফ্যাব্রিকের সঙ্গে। কাপড়ের মধ্যেই যেহেতু ম্যাট লুক রয়েছে তাই টিমআপ করার জন্য গ্লসি জিনিস না বাছাই বাঞ্ছনীয়। এতে আজরখের ক্লাসি ব্যাপারটা নষ্ট হয়ে যাবে। আজরখের লং জ্যাকেটও এখন ইন। ভিতরে সলিড কালারের কামিজের উপরে বা ক্রপ টপের সঙ্গে পরতে পারেন। নীচে ডেনিম, পালাজ়ো বা সুতির ট্রাউজ়ার্স। সঙ্গে একটা স্টেটমেন্ট নেকপিসেই সাজ সম্পূর্ণ। শাড়ির সঙ্গেও লং বা শর্ট আজরখ জ্যাকেট পরা যায়। আজরখ কাপড়ের ট্রাউজ়ার্স বা পালাজ়ো পরতে পারেন। নরম এবং আরামদায়ক এই কাপড় কিনে বানাতে পারেন। রেডিমেডও পাওয়া যায়। আজরখের পালাজ়ো, ট্রাউজ়ার্স বা স্কার্ট পরলে উপরে প্যাস্টেল শেডের টপ পরতে পারেন। হালকা মোটিফ ঠিক আছে, ভারী প্রিন্ট কিছু পরবেন না এর উপরে। স্টেটমেন্ট বেল্ট, হাতে কোয়ার্কি ব্যাঙ্গলস বা অক্সিডাইজ়ড একগোছা চুড়ি একটা স্মার্ট লুক নিয়ে আসবে। নিত্যদিনের সাজে এই ফ্যাব্রিকের ছোঁয়া রাখতে পারেন স্কার্ফ ও ব্যাগের মাধ্যমে। শুধু মেয়েদের পোশাকেই যে আজরখের দাপট তা নয়, ছেলেদের শার্টেও এই প্রিন্ট এ বারে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।
এই ফ্যাব্রিক তৈরির পিছনে অনেকটা যত্ন আর পরিশ্রম রয়েছে, তাই অরিজিনাল আজরখের দাম বেশি। এটি আসে গুজরাত থেকে। পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, সুতির আজরখের দাম মিটার প্রতি ৩০০-৩৫০ টাকা। মোডাল সিল্ক বা পিয়োর সিল্ক হলে দাম আর একটু বেড়ে ৫০০-৫৫০ হয়ে যাবে মিটার প্রতি। তবে আসল আজরখ চিনে নেওয়া কঠিন। নকল কাপড়ের দাম কম হয়। খুব উজ্জ্বল রঙের প্রিন্ট হলে বুঝবেন নকল। আজরখ থেকে কিন্তু রং ওঠে, কাপড়ে হাত দিলে টেক্সচারে মাটির ছোঁয়া পাবেন। আসল কাপড়ের দু’দিকেই একই প্যাটার্নের প্রিন্ট থাকবে। সুতির আজরখ বাড়িতে লিকুইড ডিটারজেন্টে হ্যান্ডওয়াশ করতে পারেন। সিল্ক ড্রাই ক্লিনিংয়ে দিলেই ভাল।
তাই এ বারের পুজোয় আপনার ওয়ার্ড্রোবে উঠে আসতেই পারে কচ্ছের এক টুকরো ঐতিহ্য।
ছবি ও পোশাক সৌজন্য: পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy