হাজার মাইল দূরে বসে সেই দেশের রাজপরিবারের জন্য পোশাকের নকশা এঁকেছেন প্রিয়াঙ্কা। ছবি- সংগৃহীত
ব্রিটেনের মসনদে শনিবার হবে রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক। অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা সারা। আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘কুইন কনসর্ট’ ঘোষণা করা হবে চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলাকে। আর রাজকীয় সেই অনুষ্ঠানে পরার জন্য ক্যামিলার পোশাকের নকশা গেল হুগলির প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে। নকশা তৈরি করলেন সেই গ্রামের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা মল্লিক।
গ্রামের নাম বাদিনান। প্রিয়াঙ্কা সেখানেই থাকেন। নিজের চোখে কোনও দিন বাকিংহাম প্যালেস দেখেননি। লন্ডন শহরের ত্রিসীমানায় যাওয়ারও সুযোগ হয়নি। হাজার মাইল দূরে বসে সেই দেশের রাজপরিবারের জন্য কাজ করে গিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত হলেও প্রায় সময়েই ফোনের নেটওয়ার্ক থাকে না। স্টেশন থেকে নেমে প্রথমে টোটোয়, তার পর পায়ে হেঁটে যেতে হয় সেই গ্রামে। তবু সব প্রতিকূলতাকে জয় করে সুদূর লন্ডনে পৌঁছে যায় প্রিয়াঙ্কার শিল্প।
দেশ-বিদেশের নানা জ্ঞানীগুণী পোশাকশিল্পীর ভিড়ে প্রিয়াঙ্কার আঁকা নকশা নির্বাচিত হয় ক্যামিলার জন্য। ‘ইটারনাল রোজ়’ থিমের সেই পোশাক রানির এতই পছন্দ হয় যে, ক্যামিলা নিজে সেই নকশার প্রশংসা করেন। প্রিয়াঙ্কা জানান, ড্রেসটি লাল রঙের। কাঁধের কাছে প্রজাপতি এবং গোটা পোশাক জুড়েই গোলাপ ফুলের পাপড়ি মোটিফ থাকবে সেই পোশাকে। সঙ্গে আছে মানানসই হ্যাট। লাল গোলাপ হল ইংল্যান্ডের প্রতীক। তাই এমন নকশা। জানালেন প্রিয়াঙ্কা। রানি যে জুতোটি পরবেন, তার নকশাও করেছেন প্রিয়াঙ্কা। সে সব দেখে মুগ্ধ হয়েছেন রানি। রাজ পরিবারের তরফে কুইন কনসর্টের ব্যক্তিগত সচিব প্রিয়াঙ্কাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠিও পাঠিয়েছেন। সেই চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘‘তুমি অত্যন্ত গুণী শিল্পী। তোমার আঁকা পোশাকের নকশা পেয়ে রানি আপ্লুত। সময় করে তুমি যে এই পোশাকের নকশা পরিকল্পনা করেছ, তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”
পরে ওই অনুষ্ঠানের জন্য একটি ব্রুচের নকশাও এঁকে দেন প্রিয়াঙ্কা। রাজা তৃতীয় চার্লসের পোশাকে শোভা পাবে ‘দ্য কসমিক বাটারফ্লাই ব্রুচ’। প্রিয়াঙ্কা বলেন, “বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন রঙের সমাহার রয়েছে প্রজাপতির আকারের ওই ব্রুচটির গায়ে। এই কসমিক শক্তি রাজার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই। প্রজাপতির উপর মুকুটের ছোট্ট সংস্করণ রাখা হয়েছে অভিষেক অনুষ্ঠানের কথা ভেবেই।” কুইন কনসর্টের ব্যক্তিগত সচিব তাঁকে চিঠি দিয়ে জানান, “তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমার আঁকা ব্রুচের এই নকশা দেখে রাজা অভিভূত।” মূল অনুষ্ঠানে না হলেও অভিষেকের কোন অনুষ্ঠানে রাজা তৃতীয় চার্লস এবং রানি ক্যামিলাকে সেই পোশাক এবং ব্রুচ পরতে দেখা যাবে, বাংলার চোখ এখন সে দিকেই।
তবে এই প্রথম নয়, রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথের রাজত্বের ৭০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে তাঁর জন্য পোশাক এবং মুকুটের নকশা এঁকে পাঠিয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কাই। তা রাজপরিবারে যথেষ্ট সমাদৃতও হয়েছিল। সেই শুরু। তার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সশরীরে সেখানে না গিয়েও গ্রামে বসে রাজপরিবারের জন্য একের পর এক নকশা এঁকে পাঠিয়েছেন সেখানে। প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘‘তখন অনেকেই আমার নকশা পছন্দ করেছিলেন। তার পর ওই মুকুটের মতো একটি মুকুটের নকশা তৈরির বরাত আসে। সেটা দুর্গাপুজোর জন্য। রানির মুকুট গৌরীবাড়ির প্রতিমার মুকুটের মতো বানানো হবে বলে ঠিক হয়। তবে সেই নকশা আবার দিতে পারব কি না, তার জন্য বাকিংহাম প্যালেস থেকে অনুমতি নিতে হয়েছিল আমাকে।’’
প্রিয়াঙ্কার বাড়ি প্রত্যন্ত গ্রামে হলেও তাঁর স্বপ্নটা প্রথম থেকেই আন্তর্জাতিক। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। মা গৃহবধূ। ভাইকে নিয়ে চার জনের মধ্যবিত্ত সংসার। সেই বাড়ির মেয়ে ছোট থেকেই আঁকা শিখতেন। সঙ্গে লেখাপড়াও। বাবা-মা চেয়েছিলেন মেয়ে ডাক্তার হোক। বেশ কিছুটা পথ এগিয়েছিলেন। ভাগ্যে ছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। পাড়া থেকে জেলা স্তরের প্রতিযোগিতায় বহু পুরস্কার পেয়েছেন আঁকার জন্য। তাই একটু বড় হতেই ঠিক করে ফেলেন, ডিজ়াইনার হতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের। বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার মতো আর্থিক অবস্থা ছিল না। তাই অনলাইনেই ইটালির মিলানের একটি সংস্থা থেকে ফ্যাশন ডিজ়াইনিংয়ের কোর্স করেন। এর পরে ঠিক করেন নিজেই ফ্যাশন সংক্রান্ত ব্যবসা করবেন। ভর্তি হয়ে যান আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাসে। পরিবেশবান্ধব অর্থাৎ, ‘সাসটেনেবল বিজ়নেস’ নিয়ে পড়াশোনা করেন। প্যারিসের অ্যাবাইড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ডিগ্রি অর্জন করেন। অন্য দিকে, ডিজ়াইনিংয়ের কাজ চলতে থাকে। নিজের ব্যবসাও শুরু করে দেন। প্রিয়াঙ্কা বলেন, “মেয়েদের ক্ষমতায়ন এবং ই-লার্নিং পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমার লক্ষ্য। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজেও আমার মতামত সমান গুরুত্বপূর্ণ।”
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু বাংলার জন্য কাজ করতে ইচ্ছা করে না? আনন্দবাজার অনলাইনকে প্রিয়াঙ্কা বলেন, “আমার পড়াশোনা আন্তর্জাতিক সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাই বিদেশের মাটি থেকেই কাজ শুরু। তবে আমি বাংলার জন্যও কাজ করছি। বাংলা তো বটেই, ভারতেও লিঙ্গসাম্য নিয়ে খুব একটা কাজ হয় না। আমি শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য মুছে দিতে চাই। এ ছাড়াও এই ফ্যাশনশিল্পে এত দূষণের পরিমাণ খুব বেশি। যে ধরনের রাসায়নিক এই শিল্পে ব্যবহার করা হয়, তা পরিবেশের জন্য একেবারেই ভাল নয়। আমি এই শিল্পকে আরও পরিবেশবান্ধব করে তুলতে চাই।”
রাজার অভিষেকের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিতের তালিকায় নাম রয়েছে প্রিয়াঙ্কারও। শারীরিক ভাবে উপস্থিত থাকতে না পারলেও বাকিংহাম প্যালেসে রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন তিনি। পরিস্থিতি অনুকূল হলে কোনও এক দিন সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে নিজের আঁকা নকশা নিজের হাতেই রাজবাড়িতে পৌঁছে দেবেন বাদিনানের এই মেয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy