২৫ নভেম্বর ২০২৪
Transgender

নিজের হাতে সব পরিচয় মুছে ফেলে সুপ্রিম কোর্টের রায়ই এখন ধর্মগ্রন্থ জয়িতার

শরীরে পুরুষ ছিলেন। আর মনে মনে নারী। জন্মের পর বাবা-মা নাম রেখেছিলেন জয়ন্ত। এই শহরতলির ‘ছেলে’ ছোটবেলা থেকেই দিদিদের অনুকরণ করত।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

লিপি সিংহ
রায়গঞ্জ শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২১ ১০:০১
Share: Save:

মুছে ফেলেছেন জয়িতা। একে একে সব মুছে ফেলেছেন। সযত্নে। নিজের প্রথম জীবনের নাম। জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম। এমনকি বদলে ফেলেছেন জন্মগত ভাবে পাওয়া নিজের শরীর এবং শরীরী লিঙ্গপরিচয়কেও। সবই করেছেন ধীরে-সুস্থে। স্থিরপ্রতিজ্ঞ জেদ নিয়ে। মনের ইচ্ছেগুলোকে ডানা মেলে উড়তে দিয়ে। সমাজের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন অধিকার। জয়িতার সেই জয়ের কাহিনি হারিয়েছে সামাজিক অসম্মানকে। আর লড়াইটা তিনি লড়েছেন একা। এবং একাই।তিনি জয়িতা। জয়িতা মণ্ডল। শরীরে পুরুষ ছিলেন। আর মনে মনে নারী। জন্মের পর বাবা-মা নাম রেখেছিলেন জয়ন্ত। দুই দিদির পর এক ভাই। কলকাতার কাছাকাছি শহরতলির এই ‘ছেলে’ ছোটবেলা থেকেই দিদিদের অনুকরণ করত। প্রাথমিক স্কুলে তা নিয়ে নানা সমস্যা। বাড়িতেও।

তিনি জয়িতা। কিন্তু পরিচয়ে তো জয়ন্তই। প্রাথমিকের পর উচ্চ বিদ্যালয়। এবং অবধারিত ছেলেদের স্কুল। কিন্তু সেই পরিবেশে যে বড্ড ‘বেমানান’ জয়ন্ত। সহপাঠীদের থেকে জয়ন্তর চলনবলন একেবারেই আলাদা। ফলে নানা রকমের কটাক্ষ। শুধু কী তাই! শারীরিক ভাবেও হেনস্থা। কারণ, ছেলেদের স্কুলে পড়লেও সে তো নিজেকে মনে মনে ছেলে ভাবে না। স্কুলের শিক্ষকদের কাছে সহপাঠীদের একাংশের ব্যবহার এবং ভঙ্গিমা নিয়ে অভিযোগ করেও কোনও লাভ হত না। জয়ন্তই সব ক্ষেত্রে ‘দোষী’। শৌচাগারে নিয়ে গিয়ে সহপাঠীদের যৌন নিগ্রহও কোনও ভাবে মান্যতা পায়নি শিক্ষকদের কাছে। মনে মনে ভেঙেচুরে দুমড়ে যেতে থাকে জয়ন্তর ‘রক্তাক্ত কিশোরীবেলা’। বাবা-মাকে এ সব নিয়ে বলে কোনও সুরাহা মেলেনি। আসলে ‘মেয়ের’ মনটাই পড়তে পারেননি তাঁরা।

 জয়িতার জয়ের কাহিনি হারিয়েছে সামাজিক অসম্মানকে। আর লড়াইটা তিনি লড়েছেন একা। এবং একাই।

জয়িতার জয়ের কাহিনি হারিয়েছে সামাজিক অসম্মানকে। আর লড়াইটা তিনি লড়েছেন একা। এবং একাই। —নিজস্ব চিত্র।

তিনি জয়িতা। কিন্তু ভর্তির কাগজপত্রে তখনও জয়ন্ত। পরে হলফনামা দিয়ে জয়িতা হবেন যদিও। শরীরেও বদল আনবেন। ফলে কলেজেও একই অবস্থা। নেতাজি নগরের একটি কলেজে বিএ পড়ার সময়ে সহপাঠীদের টিটকিরিতে পড়াশোনাটাই ছেড়ে দিতে হল। পড়াশোনা ছেড়ে, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। নিজের পরিবার, নিজের সমাজ, সব ছেড়ে অচেনা-অজানা কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে উঠে পড়া। পৌঁছনো নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। সেখান থেকে শিলিগুড়িতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে এইচআইভি সচেতনতার কাজ। তার পর এক বন্ধুর ডাকে প্রথম বার ইসলামপুরে যাওয়া। এক দিকে বিহার। অন্য দিকে বাংলাদেশ। প্রান্তিক ওই এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গ তথা হিজড়ে, রূপান্তরকামীদের জন্য কাজের ইচ্ছেটা তখন থেকেই আরও জোরালো। আর নতুন লড়াইয়ের শুরুটাও সেখান থেকেই। সেটা ২০০৯ সাল।

তিনি জয়িতা। রূপান্তরকামী। ঘষে ঘষে মুছে ফেলেছেন নিজের প্রাক্তন-জীবন। তখনকার ইসলামপুর গত ১২ বছরে অনেক বদলে গিয়েছে। ঠিক যেমন ভাবে বদলে গিয়েছে জয়িতার বেঁচে থাকা। জয়িতার কাজকর্ম। সেই ইসলামপুরের হোটেল ‘হিজড়ে’ জয়িতার হাতে দু’পাঁচ টাকা গুঁজে দিয়ে ‘খদ্দের কমে যাবে’ বলে হঠিয়ে দিত। বলত, অন্য কোথাও গিয়ে খাও। সেই ইসলামপুরে রাতে মাথা গোঁজার জন্য কেউ কোনও ঘর ভাড়া দিত না তাঁকে। কোনও দিন বাস টার্মিনাস, কোনও দিন আবার আলুয়াবাড়ি রেল স্টেশনে রাত কাটাতে হত। তার পর হিজড়েদের এক আখড়ায় ঠাঁই। নিউ জলপাইগুড়ি ও কিসানগঞ্জের মধ্যে ট্রেনযাত্রীদের কাছে টাকা চেয়েই অন্নসংস্থান।

তিনি জয়িতা। নিজের সমস্ত পুরনোকে মুছে ফেলে তো এ জীবন চাননি তিনি। যে অসম্মান এবং অবহেলা তিনি পেয়েছেন তাঁর এত দিনকার জীবনে, সেটাই তো বদলাতে চেয়েছেন। এর পরেই ভাবনা আসে, সমাজের জন্য কিছু করতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য লড়াই করতে হবে। এই চিন্তাই জয়িতার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে জয়িতা গড়লেন ‘দিনাজপুর নতুন আলো সোসাইটি’। ট্রেনে টাকা চেয়ে রুজির পাশাপাশি শুরু হয় সমাজের বুকে নিজের নতুন পরিচয় তৈরির লড়াই। দুঃস্থ বয়স্কদের সরকারি বার্ধক্য ভাতা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি দফতরগুলিতে যাতায়াত, তাঁদের জন্য নিখরচায় স্বাস্থ্য শিবির করা— এ সব কাজের মধ্যে দিয়েই লড়তে থাকেন সামাজিক লড়াই। সেই সময়েই ফেলে আসা পড়াশোনা ফের শুরু। দূরশিক্ষায় স্নাতক হলেন।

যে অসম্মান এবং অবহেলা তিনি পেয়েছেন তাঁর এত দিনকার জীবনে, সেটাই তো বদলাতে চেয়েছেন জয়িতা।

যে অসম্মান এবং অবহেলা তিনি পেয়েছেন তাঁর এত দিনকার জীবনে, সেটাই তো বদলাতে চেয়েছেন জয়িতা। —নিজস্ব চিত্র।

তিনি জয়িতা। নিজের এই লড়াই যখন লড়ছেন, তখনই সুপ্রিম কোর্টের নালসা রায়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কাজ করা বা সামাজিক মর্যাদার অধিকার স্বীকৃতি পায়। সেটা ২০১৪ সাল। আর সেই রায়ের প্রতিলিপিকেই জীবনের ধর্মগ্রন্থ বানিয়ে ফেললেন। জয়িতার কথায়, ‘‘২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট তৃতীয় লিঙ্গ সংক্রান্ত রায় দেয়। ওটাই আমার কাছে গীতা, কোরান, বাইবেল। আমাদের তো কোনও ধর্ম নেই। আমাদের কোনও জাতও নেই। আমরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।’’ এর পর থেকেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ের লড়াইয়ে জয়িতা ভারতবর্ষের ‘বৃহন্নলা’ সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। ইসলামপুর শহরে দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে সম্মেলনও করেছেন।

তিনি জয়িতা। ২০১৭ সালে রূপান্তরকামী সেই নারীকেই মহকুমা লোক আদালতে বিচারকের ভূমিকায় দেখা যায়। ইসলামপুর লোক আদালতে বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ইসলামপুরেই সমাজকর্মী হিসেবে নাগাড়ে কাজ করার সুবাদে স্থানীয় প্রশাসনের থেকে এই স্বীকৃতি তিনি ছিনিয়ে এনেছেন। সাধারণত, বিভিন্ন জেলা আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়া কিছু মামলা ও লঘু অপরাধের নিষ্পত্তি হয় লোক আদালতে। প্রাক্তন বিচারক, আইনজীবী ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিচারক হন। জয়িতাই প্রথম দেশের কোনও লোক আদালতে তৃতীয় লিঙ্গের বিচারক। সে দিন সকালে সরকারি গাড়ি এসেছিল তাঁকে আদালতে নিয়ে যেতে। সেই দিনটাকে ভুলতে পারেন না জয়িতা। যে ইসলামপুর বাস টার্মিনাসের হোটেল তাঁকে এক দিন ঘর না দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল, তারই সামনে দিয়ে বিচারকের গাড়িতে চেপে যেতে যেতে একটা গর্ব হচ্ছিল। এই খবর সংবাদমাধ্যমে দেখে জয়িতার মা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া ‘ছেলে’কে মা খুঁজে পান সংবাদমাধ্যমেই।

তিনি জয়িতা। এখানেই থামেননি। দুই দিনাজপুরে রূপান্তরকামী মানুষদের সামাজিক লড়াইয়ের অন্যতম মুখ তিনি। ২০২১ সালে দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে রূপান্তরকামীদের আয়োজনে সর্বজনীন দুর্গোৎসব হয়েছে। জয়িতার কথায়, ‘‘৩৩ বছর ধরে দুর্গাপুজোয় আনন্দ করেছি। এ বার উৎসব পালন করলাম। আমরাই প্যান্ডেল, প্রতিমা, আলোর অর্ডার দিয়েছি। সরকারি অনুমোদন আমরাই নিয়েছিলাম। আমরাই পুজোর জোগাড়যন্তর করেছি। আমারাই বিসর্জন দিয়েছি। সামনের বছর দক্ষিণের সঙ্গে উত্তর দিনাজপুরেও আমাদের দুর্গাপুজো হবে।’’

তিনি জয়িতা। বছরখানেক হল বিয়ে করেছেন। আর সেই বিয়ের জন্যই বদলেছেন শরীর। অস্ত্রোপচার। তবে মা হওয়ার জন্য জয়িতার প্রয়োজন আরও কয়েকটি অস্ত্রোপচার। অর্থের কারণে যা এখনও হয়ে ওঠেনি। সামাজিক সমস্যার কারণেই স্বামীর পরিচয় আপাতত গোপন রাখতে চান। ইতিমধ্যে জয়িতার এক দিদিও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু লড়াই তো শেষ হয় না। চলতেই থাকে। জয়িতা বলছিলেন, ‘‘রূপান্তরকামীদের পড়াশোনা, চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড, এমনকি কোনও জায়গায় একটা পাবলিক টয়লেট পর্যন্ত এখনও হয়নি। এখনও এক জন রূপান্তরকামীকে আইনি নিয়মে বিয়ে করতে গেলে হয় ছেলে বা মেয়ে হিসাবে নিজের পরিচয়ে রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়। এখনও এক জন পথশিশুকে দত্তক নিতে পারেন না কোনও রূপান্তরকামী। এ লড়াই অনেক, অনেক লম্বা। এই এক জীবনে হয়তো শেষ হবে না।’’

তিনিই জয়িতা। সাধারণ নন। অসাধারণ। লড়াইটা চালিয়ে যেতে চান। ভবিষ্যতের জন্য এই লড়াইয়ের ব্যাটনটা তিনি তুলে দিতে চান কারও হাতে। আর সেই মানুষটিকেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন জয়িতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy