সঞ্জিতের পরিবার তাঁর জন্মেরও অনেক আগে বাংলায় চলে এসেছিল উত্তরপ্রদেশ থেকে।
খানকয়েক গরু-বাছুর আছে গোয়ালঘরে। বাড়ি বাড়ি দুধ ফেরি করেন সঞ্জিত যাদব। পেশায় গোয়ালা। কিন্তু নেশায় মাঠ। দৌড়, হার্ডলস, লং জাম্প, হাই জাম্প তাঁর প্রেম। নিজে অবশ্য খেলাধুলো ছেড়েছেন বহু কাল আগে। কিন্তু ভবিষ্যতের অ্যাথলিটদের তৈরি করে যাচ্ছেন প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে। গরিব পরিবার থেকে মাঠে আসা এই সব ছেলেমেয়েদের থেকে কোনও রকম পয়সাকড়ি নেওয়ার প্রশ্ন নেই। ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যই তাঁর গুরুদক্ষিণা। এবং জেলা, রাজ্য স্তর থেকে শুরু করে জাতীয় স্তর পর্যন্ত তাঁর ছাত্রছাত্রীদের সাফল্য বড়াই করে বলার মতোই।সঞ্জিতের পরিবার তাঁর জন্মেরও অনেক আগে বাংলায় চলে এসেছিল উত্তরপ্রদেশ থেকে। কালে কালে থিতু হয় উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে। সঞ্জিতের জন্ম এখানেই। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। মাধ্যমিক আর উতরোনো হয়নি। কারণ সেই মাঠের নেশা। বইপত্রের সঙ্গে প্রায় কোনও সম্পর্ক ছিল না। মাঠেই মন পড়ে থাকত ছেলের। তত দিনে সফল অ্যাথলিট হিসাবে জেলাস্তরে নাম হচ্ছে। কিন্তু মাধ্যমিকে ফেল করতেই পরিবার বসল বেঁকে। সঞ্জিতকে ঢুকে পড়তে হল পারিবারিক খাটালের ব্যবসায়।
নিজের খেলাধুলা গেল। কিন্তু মাঠের আকর্ষণ থেকে তাঁকে টলানো গেল না। সঞ্জিতের কথায়, “ঠিক করলাম, নিজে পারলাম না কিন্তু ছোটদের তো তৈরি করতে পারি!” এলাকার কচিকাঁচাদের নিয়ে তৈরি করে ফেললেন প্রশিক্ষণ শিবির। সেটা ১৯৯৮ সাল। ধীরে ধীরে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। ২০০১ সাল থেকেই তাঁর হাতে তৈরি ছেলেমেয়েরা সাফল্য পেতে শুরু করে। আর তখন থেকে ভিড় বাড়তে থাকল সঞ্জিতের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। কোভিড পর্বের আগে দেড়শো জন আসত। এখন, এই অবস্থার মধ্যেও জনা ৭০ ছেলেমেয়ে তাঁর প্রশিক্ষণে।
গড়গড় করে বলে যেতে থাকেন নিজের কৃতী ছাত্রছাত্রীদের নাম। রামলাল মাহাতো, রেখা মণ্ডল, রতি সাহা, টুম্পা সরকার, কৃষ্ণ দেবশর্মা, পরিমল দেবশর্মা, বুধোরানি দেবশর্মা, আনন্দ রায়, রিন্টু সরকার, আলমাস কবীর, রমজান আলি, খুশি সিংহ... থামতেই চান না সঞ্জিত। রেখা পূর্বাঞ্চলীয় মিটের ১৫০০ এবং ৩০০০ মিটারে প্রথম। দীপা প্রথম ৫০০০ এবং ১০০০০ মিটারে। রামলাল ৫০০০ এবং ১০০০০ মিটারে। মতিউর, সানি হার্ডলসে প্রথম। বলে যেতে থাকেন সঞ্জিত। জানালেন তাঁর ছাত্র হীরালাল সরকারের অনূর্ধ্ব ১৬-য় ৩০০০ মিটারের রাজ্য-রেকর্ড এখনও অক্ষত। পোল ভল্ট, হাই জাম্পে সফল পরিমল দেবশর্মা এখন কলকাতা ময়দানের পরিচিত ফুটবল রেফারি। শুধু মাঠের সাফল্যই নয়, এই সাফল্যের হাত ধরে চাকরিও করছেন সঞ্জিতের বহু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী।
কিন্তু সাফল্যের আলোর তলায় অভাব আর আশঙ্কার অন্ধকারও ঘাপটি মেরে আছে সঞ্জিতের জীবনে। দিনে তিনি দুধ ফেরি করে বেড়ান নিজের ভাঙাচোরা সাইকেলে। কিন্তু দুধ বেচা আয়ে সংসার চলে না। ফলে পুরসভায় নৈশপ্রহরীর কাজ করে সামান্য বাড়তি আয়ের একটা ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তবু বাড়ির লোকের খেদ, তাঁদের খিদে মেটানোয় ততটা মন নেই সঞ্জিতের, যতটা মন পড়ে থাকে ছাত্রছাত্রীদের অনুশীলনে। বিনেপয়সার ক্যাম্পে।
বাড়িতে স্ত্রী, এক মেয়ে আর দুই ছেলে। তিন সন্তানই পড়াশোনা করে। মেয়ে কলেজে। আর দুই ছেলে দ্বাদশ ও দশম শ্রেণিতে। নিজে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কোনও পয়সাকড়ি নেন না। কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়ানোর খরচে জেরবার সঞ্জিত। বলছিলেন, ‘‘নীতিগত কারণেই আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আমি পারিশ্রমিক নিই না। কিন্তু তিন ছেলেমেয়ের প্রাইভেট টিউশনের যা খরচ! খাব না মাইনে দেব! তা-ও কয়েক জন আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেন। না হলে ওদের পড়াতেই পারতাম না। তবে সব কিছুর মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের সাফল্য আমাকে খুশি রাখে।’’
নিজের তিন সন্তানের আগ্রহ নেই খেলাধুলোয়? স্বর নামিয়ে সঞ্জিতের জবাব, ‘‘ওরাও খেলে। ভালই করছে।’’ কিন্তু নিজের সন্তানদের সাফল্য নিয়ে কথা বলতে যেন একটু লজ্জাই পান সঞ্জিত। বরং অন্য ছাত্রছাত্রীদের নাম বলতেই যেন তাঁর স্বাচ্ছন্দ বেশি। রায়গঞ্জ পুর-আবাসে নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব সামলে রোজ ভোরবেলা সাইকেল চেপে পৌঁছে যান তাঁর তুলসীতলার বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরের কুলিক বনাঞ্চলের মিলিটারি ফরেস্টে। ওখানেই তাঁর প্রশিক্ষণ চলে। সকাল ৬টা থেকে সাড়ে আটটা। মূলত দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েরাই আসে তাঁর কাছে। বছরের পর বছর ধরে তাঁর শেখানোর ডেরায় ১২ থেকে ২০-দের ভিড়।
সাফল্যের আলোর তলায় অভাব আর আশঙ্কার অন্ধকারও ঘাপটি মেরে আছে সঞ্জিতের জীবনে।
ওই ভিড়ের মধ্যেই কথা হচ্ছিল সরস্বতী দেবশর্মার সঙ্গে। কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ছ’বছর বয়স থেকে সঞ্জিতের কাছে প্রশিক্ষণ। রাজ্য স্তরে একাধিক পদক আছে। জুনিয়র ন্যাশনালে সুযোগ পেয়েও যাওয়া হয়নি পারিবারিক অভাব ইত্যাদির জন্য। তিন বছর আগে জলপাইগুড়ির সাই শিবিরে ডাক পান। তবে করোনার ধাক্কায় তা বছরখানেক পর থেকেই বন্ধ। প্রশিক্ষণ চলছে সঞ্জিতের কাছেই। ‘দাদা’র প্রসঙ্গ উঠতেই একরাশ আক্ষেপ, “আমাদের এত জনের জন্য এত কিছু করছেন, দাদা তো কিছু পাচ্ছেন না। একটা পয়সা আমাদের দিতে হয় না এখানে। আমরা জিতলে আমাদের নাম হয়। দাদার নাম কেউ জানে না।” সরস্বতী খেলাধুলো করে একটা চাকরি চান। অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে। কিন্তু দাদার সংসার নিয়েও একই রকম চিন্তা সরস্বতীদের। দাদার ‘ফ্রি কোচিং সেন্টার’ নিয়েও।
এখন মাঝে মাঝে ভয় পান সঞ্জিতও। পারবেন তো, ক্যাম্পটা চালিয়ে নিয়ে যেতে! একটা মোটরসাইকেল হলে তো সুবিধা হত! কথাটা পাড়তেই সঞ্জিতের মন্তব্য, ‘‘কোনও রকমে খেয়েপরে বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে তো খাবারও জোটে না ভাল করে। কত টাকাই বা মাইনে পাই! ওতে জল গরম হয় না আজকের দিনে।’’ আর দুধের ব্যবসা? ‘‘খোল, ভুষি, খড়ের যা দাম! ওদের খাওয়াতেই তো অনেক খরচ। দুধ বেচে আর ক’টাকাই বা হয়! কত দিন এই ক্যাম্প চালাতে পারব কে জানে!’’
আফসোসের কথা বলতে গিয়ে আরও একটা হতাশা ঝরে পড়ে রায়গঞ্জের ‘ক্ষিদ্দা’র মুখে— ‘‘প্রশিক্ষণ শেষে এখন মাঝে মাঝেই হয়, ওদের আর ছোলা ভেজানো খেতে দিতে পারি না। কোথায় টাকা পাব! কষ্ট হয়। বুকটা ফেটে যায়। ওদের অনেকেরই সুষম-পুষ্টিকর খাবারের অভাব। আমার চেয়েও গরিব তো। মাঝে মাঝে বাড়ির দুধ চুরি করে এনে খাওয়াই। বিক্রি করতেও কষ্ট হয়। ওদের মুখটা মনে পড়ে।’’ তার পরেই স্বগতোক্তি, ‘‘স্ত্রী রাগারাগি করেন বটে। তবে শেষে মেনেও নেন। ওরাও তো আমার সন্তানই।’’
সেই ‘সন্তান’দের অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের অনেকে দিতে চাইলেও ব্যক্তিগত কোনও সাহায্য চান না সঞ্জিত। কী চান তবে বছর ৪২-এর ‘দ্রোণাচার্য’? তাঁর শিবিরটা ভাল করে গড়ে তোলার জন্য একটু সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য। জেলাকে বা রাজ্যকে বছরের পর বছর তিনি কৃতী অ্যাথলিট উপহার দিয়ে চলেছেন। কিন্তু এই ভাবে, একার পক্ষে চালিয়ে যাওয়া বোধহয় আর বেশি দিন পারবেন না। তার উপর সেনার এলাকায় প্রশিক্ষণ শিবির চালাতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই বাধার মুখে পড়তে হয়। এরও একটা সমাধান চান তিনি। আর চান নিজের একটা মোটামুটি ভদ্রস্থ আয়ের ব্যবস্থা, যাতে কাল কী হবে এই দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের গড়েপিঠে তুলতে আরও ভাল করে মনোযোগ দিতে পারেন মাঠে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy