অনেক ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে রামলীলা ময়দান। আজ সেই তালিকায় যুক্ত হল আরও একটি দিন। অণ্ণা হজারে-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যৌথ সভায় কার্যত কোনও লোক হল না। তারই জেরে সভায় এলেন না অণ্ণা। একাই বক্তৃতা করলেন তৃণমূল নেত্রী।
তৃণমূল শিবিরের দাবি, লোক না-হওয়ার দায় তাদের নয়। কারণ, সভার আয়োজক তৃণমূল নয়, টিম অণ্ণা। তৃণমূল আমন্ত্রিত মাত্র। বস্তুত, সোমবারই ফেসবুকে মমতা লিখেছিলেন, “রামলীলা ময়দানে অণ্ণাজি বক্ততা দেবেন। সকলকে অনুরোধ, সময় পেলে আসুন। আমিও হয়তো বক্তৃতা দিতে পারি।” সুতরাং উদ্যোগটা যে মূলত অণ্ণার তরফে, তা গোড়া থেকেই জানিয়ে রেখেছিল তৃণমূল।
কিন্তু, দু’বছর আগে তাঁর অনশন উপলক্ষে উপচে পড়েছিল যে রামলীলা ময়দান, আজ সেখানে কয়েক হাজার লোক টানতেও কেন ব্যর্থ অণ্ণা হজারে! দিল্লির রাজনীতিকরা বলছেন, আসলে সংগঠক হয়ে ওঠার লড়াইয়ে শিষ্যের কাছে গো-হারা হারলেন অণ্ণা। তাঁদের মতে, অণ্ণার অনশনের সময় রামলীলা ভরানোর যাবতীয় কৃতিত্বই ছিল দক্ষ সংগঠক অরবিন্দ কেজরীবালের। তার পরেই গুরু-শিষ্যে মতপার্থক্য। কেজরীবালের আমআদমি পার্টি গঠন এবং দিল্লির বিধানসভা ভোটে বাজিমাত। অবাধ্য শিষ্যের এই সাফল্যে রুষ্ট অণ্ণা মমতার হাত ধরে সেই রামলীলা ময়দান থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন কেজরীবালকে শিক্ষা দিতে। কিন্তু সাংগঠনিক দক্ষতার অভাবে পড়লেন মুখ থুবড়ে। ঘটনাচক্রে এ দিনই মুম্বইয়ে জনসভা করেছেন কেজরীবাল। এবং সফল ভাবেই।
তবে অণ্ণার ব্যর্থতায় মমতার জাতীয় রাজনীতিতে দাগ কাটার স্বপ্ন যে কিছুটা হলেও ধাক্কা খেল, তাতে সন্দেহ নেই। ফেডেরাল ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার পরে অণ্ণাকে অবলম্বন করে গোটা দেশে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছিলেন মমতা। আজকের ব্যর্থ সভা সেই চেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল। যদিও সেই হতাশাকে প্রকাশ্যে আসতে দিতে চাননি তৃণমূল নেত্রী। বরং পরিচয় দিয়েছেন রাজনৈতিক পরিপক্কতার। অণ্ণার অনুপস্থিতির জেরে রামলীলার আবহ যখন উত্তপ্ত, তৃণমূল নেতারা যখন ক্ষোভে ফুঁসছেন, তখন এক বারের জন্যও তাঁকে আক্রমণ করলেন না তৃণমূল নেত্রী। পরে ফেসবুকে রামলীলার সভা নিয়ে নিজের বক্তব্যে অণ্ণার নামোল্লেখ করেননি। বলেছেন, দেশের দু’টি বড় দল মানুষের নয়, শুধু নিজেদের ভাল চায়। রাজনীতির এই বিপজ্জনক প্রবণতার বিরুদ্ধেই তাঁর লড়াই। মমতার কথায়, “আমরা ছোট দল। আমাদের সীমাবদ্ধতা জানি। তবু একাই লড়াই করব।” রাতে দিল্লি-সহ বিভিন্ন রাজ্যের ৩০টি আসনে তৃণমূল প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেও বুঝিয়ে দিয়েছেন, অণ্ণার অসহযোগিতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। একা লড়ার জন্য তিনি প্রস্তুত।
কিন্তু রামলীলায় কী ঘটল আজ?
কেজরীবালের পালের হাওয়া কাড়তে তাঁর সঙ্গীসাথীদের এক মাসের লড়াই যে জলে গিয়েছে, তা অবশেষে বুঝতে পারলেন অণ্ণা। তবে বেশ একটু দেরিতে। আজ বেলা একটু গড়াতেই দিল্লিতে অণ্ণার ঠিকানা মহারাষ্ট্র নিবাসে খবর পৌঁছয়, রামলীলায় ভিড়ের হাল মোটেই ভাল নয়। তখনও অবশ্য ক্ষীণ আশা ছিল যে, দুপুর নাগাদ খানিক লোক হবে। কিন্তু দু’টোর সময় জানা গেল, লাখখানেক লোক ধরে যে মাঠে, সেখানে ভিড় মেরেকেটে হাজার দুয়েক। তখনই রামলীলামুখো না-হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন অণ্ণা।
আর কোন্দল শুরু হয়ে যায় তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে। গত এক মাসে অণ্ণা-মমতার সেতু এবং প্রার্থী বাছাইয়ের প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হিসেবে উঠে এসেছিলেন সন্তোষ ভারতী। টিম-অণ্ণার ভিতরে গড়ে উঠেছিল তার বিরোধী পক্ষও। এই দু’তরফের মধ্যে দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়। প্রকাশ্যে অবশ্য সন্তোষের বিপক্ষ শিবিরের নেত্রী সুনীতা গোদারা এই বলে টুইট করেন, অণ্ণার শরীর খারাপ। তাই তিনি যেতে পারছেন না। তার একটু পরেই তিনি পরোক্ষে তৃণমূলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বলেন, “এটা তৃণমূলের ভুল পরিকল্পনার ফসল। চড়া রোদে সভা না-করে সন্ধ্যায় বা ছুটির দিনে বা সপ্তাহান্তে করা যেত।”
রামলীলা ভরানোর দায় তাদের ছিল, সেটা অবশ্য মানতে নারাজ তৃণমূল নেতৃত্ব। উল্টে তাঁদের বক্তব্য, টিম অণ্ণা মাঠ ভরাতে পারবে কিনা, তা নিয়ে দিল্লিতে পা দিয়েই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন মমতা। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি এ-ও বলেন যে, অণ্ণা ভুল করছেন। তালকাটোরা স্টেডিয়ামে সভা করলেই বোধহয় ভাল হতো।
তবে ভিড় হয়নি বলে অণ্ণা যে সভায় মুখই দেখাবেন না, সেটা ভাবতে পারেননি মমতা। সভায় যাওয়ার পথে সংবাদমাধ্যমেই তিনি খবর পান, অণ্ণা না-ও আসতে পারেন। উদ্বিগ্ন মমতা খোঁজ নেন, অণ্ণার শরীর কেমন আছে। রামলীলায় পৌঁছেও অপেক্ষা করেন।
ওই সময়টুকুতে যাতে কোনও অস্বস্তি তৈরি না হয়, তাই তাঁর নির্দেশে মঞ্চে গান ধরেন নচিকেতা থেকে বিশ্বজিৎ। সৌগত রায়ও হিন্দিতে তৃণমূলের বার্তা পৌঁছতে থাকেন জনতাকে। এর মধ্যে অণ্ণাকে আনতে মুকুল রায় চলে যান মহারাষ্ট্র নিবাসে। কিন্তু গলায় ব্যথা এবং বুকে কফের কারণ দেখিয়ে অণ্ণা তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দেন। বার্তা পৌঁছয় মমতার কাছে। তিনি আর অপেক্ষা না-করে মঞ্চে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। বক্তৃতা শুরু করেন ‘ম্যায় অণ্ণা হুঁ’ লেখা টুপি পরা হাজার দুয়েক শ্রোতার সামনে।
এবং গোড়াতেই বলে দেন, “এটা অণ্ণা হজারের সভা। তৃণমূলের নয়। আমি খুশি হয়েই আমন্ত্রিত হিসেবে এসেছি। কাউকে দোষ দিচ্ছি না। ওঁর হয়তো শরীর ভাল নেই।’’ সভায় লোক না-হওয়ার দায় অণ্ণা শিবির যে ভাবে প্রকারান্তরে তৃণমূলের ঘাড়ে ঠেলার চেষ্টা করেছিল তারও জবাব দেন তিনি। বলেন, “রামলীলা ময়দান ভরাতে হলে আমি ট্রেনে করে রাজ্য থেকে লোক নিয়ে আসতে পারতাম। সবাই তা-ই করে। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই, কারণ নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। তা ছাড়া, এটি রাজনৈতিক নয়, সামাজিক মঞ্চ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ডাক দেওয়ার মঞ্চ। আমি কথা দিয়েছিলাম আসব। রাজ্যে অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও আমি সেই কথা রেখে দিল্লি এসেছি।”
এর পরেই তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে একলা চলার ডাক দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, “তৃণমূল সর্বত্র একা লড়ছে। পঞ্চায়েত ভোটের মতো লোকসভাতে আমরা একলা লড়ব। কেউ থাকুন, বা না থাকুন, আমরা আমআদমির জন্য লড়ে যাব।” ওই সভা থেকেই দিল্লি (দক্ষিণ)-এর প্রার্থী হিসেবে অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের নাম ঘোষণা করে মমতা বুঝিয়ে দেন, আর টিম অণ্ণার ধার ধারতে তিনি রাজি নন।
এখন প্রশ্ন হল, অণ্ণার অনুপস্থিতির কারণ কি শুধুই ভিড়ের অভাব, নাকি পিছনে রাজনৈতিক প্ররোচনা রয়েছে? সাংবাদিক বৈঠকে কৌশলে সেই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, “আমি সামান্য ব্যক্তি। এটা আমি বলতে পারব না। ওঁদের কাছেই জানতে চান।”
এটা ঘটনা যে কংগ্রেস এবং বিজেপি, উভয় পক্ষের তরফেই অণ্ণার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। অণ্ণাকে মমতার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে কংগ্রেসেরই লাভ বেশি। কেননা, কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের ধারণা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত মমতা-অণ্ণা যদি দেশে শক্তিশালী হন, তা হলে বেশ কিছু আসনে তাঁদের দল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কাল গভীর রাতে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অণ্ণার সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়। আজ কংগ্রেস মুখপাত্র শাকিল আহমেদ কিছুটা তির্যক ভাবে জানিয়েছেন, “জানি না কেন অণ্ণা যাননি। তবে দেখে মনে হচ্ছে তিনি শেষ মুহূর্তে মান বাঁচালেন।” এত দিন মমতার সঙ্গে অণ্ণার যোগাযোগ ঘটানোর পরে শেষ মুহূর্তে বিজেপি তাঁকে টেনে ধরেছে, এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন শাকিল। কেননা, মমতাকে অণ্ণাকে সঙ্গে নিয়ে গুজরাতে গিয়ে মোদীকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিলেন।
মমতা-অণ্ণা যোগসূত্রের নেপথ্য কারিগর বিজেপি, এই গুঞ্জন গত কয়েক দিন ধরেই ছিল। বস্তুত, বিজেপি নেতাদের অনেকের সঙ্গেই অণ্ণার যোগাযোগ রয়েছে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন খোদ বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ। আজ রামলীলায় না-গেলেও ঠিক সেই সময় সদ্য বিজেপি-তে যোগ দেওয়া ভি কে সিংহের সঙ্গে দেখা করেন অণ্ণা। এর পরই জল্পনা তুঙ্গে ওঠে যে, মমতা মোদী-বিরোধী সুর চড়ানোর কারণেই কি বিজেপি অণ্ণাকে সভায় যাওয়া থেকে বিরত করল? যদিও সেই সম্ভাবনা অস্বীকার করে মমতার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ নেতা শাহনওয়াজ হুসেন আজ বলেন, “অণ্ণা কেন সভায় যাননি, তা তিনিই বলতে পারবেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy