ভিরার-চার্চগেট লোকাল ট্রেনের লাইনচ্যুত কামরাগুলি পরীক্ষা করেছেন রেলকর্মীরা। মঙ্গলবার মুম্বইয়ের আন্ধেরিতে। ছবি: রয়টার্স।
মন্ত্রী আসেন, মন্ত্রী যান। রেলে কিন্তু যাত্রী-নিরাপত্তার হাল ফেরে না। এমনকী প্রভু আসার পরেও রেলে বিশেষ করে সুরক্ষা-মান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ধারা অব্যাহত।
অথচ রেলমন্ত্রিত্ব পেয়েই সুরেশ প্রভু তেড়েফুঁড়ে ‘রেল পক্ষ’ উদ্যাপন করে যাত্রী-নিরাপত্তার হাল বদল করতে ময়দানে নেমেছিলেন। রেলের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক, ধমকচমক তো ছিলই। তা ছাড়াও নিজে চলন্ত ট্রেনে যাত্রীদের মুখোমুখি হয়ে তাঁদের ক্ষোভ, অভাব-অভিযোগ শুনে প্রতিকারের পথ খুঁজছিলেন তিনি। স্বয়ং প্রভুর সেই তৎপরতা দেখে অনেকেরই আশা জেগেছিল, এ বার হয়তো ট্রেনে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্তে সফর করা যাবে। কিন্তু কোথায় কী? ‘ট্র্যাডিশন’ বদলের লক্ষণ নেই। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। মৃত-আহতের সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। দুর্ঘটনার দাপটে যাত্রীরা এখন বাধ্য হয়েই প্রাণ হাতে নিয়ে উঠছেন ট্রেনে।
রেলেরই হিসেব অনুযায়ী অন্যান্য দুর্ঘটনা ছাড়াও গত ন’মাসে একটি ঐতিহ্যবাহী টয়ট্রেন এবং আটটি এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। তাতে মৃত্যু হয় ৮৪ জন যাত্রীর। আহতের সংখ্যা প্রায় ৪১৬। প্রাথমিক তদন্ত বলছে, প্রতিটি দুর্ঘটনারই মূলে আছে রেলের ত্রুটি বা গাফিলতি।
রেলমন্ত্রী গত সপ্তাহে জাপান গিয়েছিলেন। রেলে বিনিয়োগ টানা এবং রেল প্রযুক্তি উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ও-দেশের রেলকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক ছিল তাঁর। তার মধ্যেই শনিবার শিমলার ঐতিহ্যবাহী টয়ট্রেন মাঝপথে লাইনচ্যুত হয়। ওই ট্রেনের কামরা সংরক্ষণ করে পর্যটকেরা আনন্দসফরে বেরিয়েছিলেন। অন্যান্য কামরায় ছিলেন ভ্রমণার্থীরাই। সে-দিনের দুর্ঘটনায় দুই ব্রিটিশ পর্যটকের মৃত্যু হয়। ওই দিনই কর্নাটকে লাইনচ্যুত হয় মুম্বইগামী সেকেন্দরাবাদ দুরন্ত এক্সপ্রেস। তাতেও দুই যাত্রীর মৃত্যু হয়। আহত ন’জন।
পরপর দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ থেকে ফিরেই দিল্লিতে রেলের সব ক’টি জোনের জেনারেল ম্যানেজারদের (জিএম) নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন প্রভু। সেই বৈঠক শুরুর আগেই আবার মঙ্গলবার সকালে খোদ রেলমন্ত্রীর এলাকা মুম্বইয়ে আন্ধেরির কাছে একটি লোকাল ট্রেনের চারটি কামরা লাইনচ্যুত হয়। খবর পেয়ে প্রভু এ দিন বৈঠকের শুরুতেই বারবার দুর্ঘটনার জন্য তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রেল সূত্রের খবর, যাত্রী-সুরক্ষা ও সময়মতো ট্রেন চালানো নিশ্চিত করার জন্য জেনারেল ম্যানেজারদের আরও কঠোর হাতে রাশ ধরার পরামর্শ দিয়েছেন মন্ত্রী। ওই বৈঠকে প্রভু পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, কোথাও কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে কার বা কাদের গাফিলতিতে এবং কেন সেটা ঘটল, দ্রুত তদন্ত চালিয়ে সেই সব কর্মী ও কারণ চিহ্নিত করতে হবে। যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ যথাসম্ভব নির্মূল করতে হবে।
দফায় দফায় প্রযুক্তি বদলের দাবি সত্ত্বেও বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে কেন?
রেলের পরিচালন ব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন অফিসারদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, যতই আধুনিক প্রযুক্তির কথা বলা হোক, গত ১০-১৫ বছরে রেলের পরিকাঠামো উন্নয়নের কোনও ব্যবস্থাই করেনি রেল বোর্ড। বাড়ানো হয়নি লোকবলও। অথচ আদ্যিকালের পরিকাঠামোর (বিশেষ করে রেললাইন ও সিগন্যালিং ব্যবস্থা) উপরে নির্ভর করেই একের পর এক ট্রেন বাড়ানো হয়েছে। পুরনো পরিকাঠামো এবং কর্মীর অভাবে রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি— এই দুইয়ের জেরে এখন আর যথোচিত সুরক্ষা-সহ ট্রেন চালানোর কার্যত কোনও উপায়ই নেই। তাই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন ওই রেলকর্তারা।
এই দু’টি মূল কারণ ছাড়াও দুর্ঘটনা বেড়ে চলার পিছনে আরও একটি কারণ দেখছেন রেলকর্তাদের অন্য এক অংশ। তাঁদের বক্তব্য, রেল বোর্ড আচমকাই মালগাড়ির কামরাগুলিতে বাড়তি মালপত্র নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। আগে মালগাড়ির একটি কামরায় ৫৮ থেকে ৬০ টন পর্যন্ত পণ্য নেওয়া হতো। কিন্তু রেলের আয় বাড়াতে বছরখানেক আগে ৬৬ থেকে ৬৮ টন পর্যন্ত মালপত্র নেওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত মালপত্র নেওয়ার বন্দোবস্ত হলেও সেই অনুযায়ী রেললাইনের ক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। ফলে সেই পুরনো লাইনের উপর দিয়ে আচমকা বেশি ওজনের মালগাড়ি চলাচল করায় মাঝেমধ্যেই লাইনে ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। আর ত্রুটিপূর্ণ লাইনের উপর দিয়ে জোরে ছুটতে গিয়েই যাত্রিবাহী ট্রেন যখন-তখন বেলাইন হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন ওই রেলকর্তারা। একই সঙ্গে তাঁরা জানাচ্ছেন, রক্ষণাবেক্ষণের হালও যে ভাল নয়, ওই সব দুর্ঘটনা থেকেই সেটা স্পষ্ট। কারণ, রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক ভাবে করা হলে ওই সব ত্রুটি আগেই ধরা পড়ত। দুর্ঘটনাও এড়ানো সম্ভব হতো।
কী ব্যবস্থা নিচ্ছে রেল?
রেল বোর্ড সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিনের বৈঠকে ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়ার সমস্যার মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে আছে: রেললাইনে নতুন ধরনের স্লিপার বসানো। রেললাইনের লোহার ক্ষমতার মান পরিবর্তন করা। লাইন জোড়ার জন্য উন্নত ঝালাইয়ের ব্যবস্থা। লাইনে ফাটল ধরার জন্য বিশেষ ধরনের পরীক্ষার বন্দোবস্ত।
কিন্তু রেলকর্তারাই বলছেন, এই সব ব্যবস্থা নিতে কমপক্ষে আরও পাঁচ বছর লাগবে। তা হলে এই পাঁচ বছর যাত্রী-সুরক্ষার কী হবে?
এর ধরনের প্রশ্নের উত্তরে মৌন থাকার রাস্তাই নিচ্ছেন রেলকর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy