বিদ্রোহে বিদ্রোহে এখন তিনি বড় অসহায়! বিদ্রোহের আগুনে পাছে আরও ঘৃতাহুতি পড়ে! তাই দিল্লি পৌঁছে গিয়েও রাষ্ট্রপতি ভবনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সম্মানে নৈশভোজে যাওয়া হল না তৃণমূলের ‘যুবরাজে’র। বিপদ আশঙ্কা করে প্রায় শেষ মুহূর্তে ভাইপোকে ডিনার টেবল পর্যন্ত পৌঁছতে দিলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
যুবরাজকে সরিয়ে নিয়ে একেবারে ভোজসভা বয়কটের বার্তা অবশ্য তৃণমূল নেত্রী দিতে চাননি। সে কারণেই রাষ্ট্রপতি ভবনে তৃণমূলের তরফে প্রতিনিধি হিসাবে হাজির থাকার ভার পড়েছিল রাজ্যসভার সাংসদ, চিত্রকর যোগেন চৌধুরীর উপরে। কিন্তু যোগেন যে হেতু দলের রাজনৈতিক মুখ নন, তাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভোজসভা এড়িয়ে গিয়ে প্রায় সিপিএমের সঙ্গে এক পংক্তিতেই বসল তৃণমূল। পশ্চিমবঙ্গে যখন বিজেপি-র দ্রুত উত্থান ঘটছে, সে সময়ে সংখ্যালঘু আবেগের দৃষ্টিকোণ থেকে যার আবার ভিন্ন রাজনৈতিক তাৎপর্যও আছে!
কেন হঠাৎ রাইসিনা হিলসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে নিতে হল যুবরাজকে? তৃণমূলের অন্দরের ব্যাখ্যা, এর কারণ শাসক দলে ঘনীভূত হওয়া বিদ্রোহের নিম্নচাপ! দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও রাজ্যসভার নেতা মুকুল রায়, লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বা লোকসভায় তৃণমূলের সচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এঁরা সকলেই অভিষেকের চেয়ে অভিজ্ঞ এবং উপরের সারির নেতা। দলনেত্রীর বিশেষ সুনজরে না থাকলেও সৌগত রায়, দীনেশ ত্রিবেদীরা সংসদীয় রাজনীতিতে অভিজ্ঞ। এঁদের সকলকে বাদ দিয়ে অভিষেকের মতো প্রায় নবাগত নেতাকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সম্মানে আয়োজিত আসরে দেখা গেলে দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে পারত। বর্ষীয়ান নেতারা অভিমানী হওয়ার আরও সুযোগ পেতেন। তাই বিশদে ভাবনাচিন্তা করে ভাইপোকে নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাননি তৃণমূল নেত্রী। দলের এক সাংসদের কথায়, “এমন নয় যে, অভিষেক যেচে ওখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন! তাঁর জন্য আমন্ত্রণ এসেছিল। কিন্তু নানা কারণে বা অজুহাতে দলের অনেকেই এখন ভিন্ন সুরে কথা বলে ফেলছেন। এই স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে ভাইপোকে নিয়ে আর ভুল বোঝাবুঝি বাড়তে দিতে চাননি দলনেত্রী।”
সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের ফাঁস চেপে বসার পর থেকেই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে পিছনে ঠেলে দিয়ে সংগঠনের বেশ কিছু গুরুদায়িত্বে যুবরাজকে তুলে এনেছেন মমতা। সংগঠনের কর্তৃত্ব হাতে পেতে নতুন সদস্যপদ যাচাই করার কমিটিতেও এখন অভিষেক এসেছেন। কিন্তু শাসক দলের মধ্যে এই অভিষেক-পর্ব খুব মসৃণ হয়নি! হাতে-কলমে আন্দোলনের অভিজ্ঞতাহীন অভিষেককে আচমকা দলের প্রায় দ্বিতীয় ব্যক্তি করে দেওয়াকে অনেক বর্ষীয়ান নেতাই খুশি মনে নেননি। তবে সিদ্ধান্ত খোদ দলনেত্রীর বলেই তাঁরা প্রকাশ্যে এই নিয়ে মুখও খোলেননি। অস্থির সময়ে এই জটিলতা আরও বাড়তে দেবেন না বলেই ওবামা-আসরে যুবরাজের পদার্পণ দলনেত্রীর হস্তক্ষেপে আটকে গিয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা।
স্বয়ং অভিষেক অবশ্য এই নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে বিদ্রোহের বাতাবরণের উপরে পর্দা টানতে তৃণমূলের তরফে অন্য একটি কারণকে সামনে আনা হচ্ছে। দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের করে-যাওয়া পরমাণু চুক্তিকে এই ওবামা-সফরে আরও পরিণত রূপ দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। সব মিলিয়ে ভারত আরও বেশি করে আমেরিকার কৌশলগত মিত্র হয়ে উঠবে, দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করা হবে। তাই অভিষেকের মতো ‘গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক’ প্রতিনিধিকে মোদী-ওবামার আসরে পাঠানো হল না। তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনও প্রকাশ্যে এমন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। যা হুবহু মিলছে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের মতের সঙ্গে!
কিন্তু দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠছে, দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে এত চিন্তিত হয়ে প্রতীকী প্রতিবাদের চেষ্টা থাকলে যোগেনই বা যাবেন কেন? সিপিএম যেমন পলিটব্যুরোর সদস্য এবং রাজ্যসভার নেতা সীতারাম ইয়েচুরিকে আগে থেকেই বলে-কয়ে সরিয়ে নিয়েছে। ইয়েচুরির মন্তব্য, “ভারতকে যে ভাবে আমেরিকার জুনিয়র দোসর করে তোলা হচ্ছে, আমরা তার প্রতিবাদ করছি। সংসদেও প্রশ্ন তুলব। কিন্তু তৃণমূলের তো কোনও ব্যাপারেই কোনও নীতির ব্যাপার নেই!”
ওবামার কানে আদৌ কোনও বার্তা পৌঁছল কি না, তাতে অবশ্য সিপিএমের বয়েই গেল! তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে দেখাতে চায়, বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে দেশটাকে আমেরিকার কাছে সমর্পণ করা হচ্ছে! যে কারণে গাজায় ইজরায়েলি হানার প্রতিবাদে কলকাতায় প্রবল মিছিল হয়, সিপিএমের নৈশভোজ বয়কট এবং বিক্ষোভও সেই কারণে। শেষ প্রহরে মমতা দেখেছেন, বিজেপি-র বাজারে সংখ্যালঘু ভাবাবেগে বাতাস দেওয়ার এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা উচিত? অতএব, ভাইপোর যাত্রাভঙ্গ করে ঘরে বিদ্রোহ ও বাইরে ভুল বার্তা ঠেকানোর চেষ্টা। এক ভাইপোয় দুই পাখি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy