রাজধানী থেকে ফিরছি। ঘরে ফেরার, নিজের শহরে ফেরার অনুভূতি আচ্ছন্ন করে অন্য আর এক ভাবনা খালি উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলেছে। বিষয়টির মধ্যে নতুনত্ব নেই কিছু, তবু। কেননা, আজন্ম শহর-লালিত আমি কত দূর ভাল আছি। ভাল থাকবই বা আর কত দূর। সময়ের হিসাবে কত দিন মাস বছর। একটা খ্যাপামো যেন পেয়ে বসেছে প্রকৃতিকে। আর প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ অংশ বলে গর্ব করা আমরা, আমাদের পরিবেশ আবহাওয়ার মতিগতি বুঝতে ক্রমে হিমসিম। ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে নায়াগ্রা জলপ্রপাত। একের পর এক বন্যায় ভেসে যাচ্ছে বড়দিনের ইউরোপ। কলকাতায় দিল্লির মতো লু বইছে। শান্তি নেই শহরে। এক একটা বাড়ি যে এক একটা তাপ-প্রকোষ্ঠ। হট চেম্বার। ইট পাথর অ্যাসফল্ট লোহা কাচের দেওয়াল যে তাপ ধরে রাখছে, তা সহ্যসীমা অতিক্রম করে করে আর কি? ভাল থাকার গ্যাজেটের বর্ম দিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে চাইছি আমরা। ফলত, আরও শক্তি উৎপাদন, আরও ফসিল জ্বালানি, আরও উত্তাপ, আরও বিষবাষ্প।
এই নগরায়ণ, উন্নয়নের ঢক্কানিনাদ, আরও আরও উৎপাদন.....এই নগর-সভ্যতা, নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা কত দূর টেকসই, কত দূর সুদূরপ্রসারী— তা নিয়েই এক ভাবনাচিন্তা, আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের আসর বসেছিল দিল্লিতে। উদ্যোক্তা ছিল সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট। আর আমরা লাদাখ থেকে কেরলের জনা তিরিশেক সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী গিয়েছিলাম পাঠ নিতে। পাঠ শেষে তার রেশ নিয়েই চেপে বসেছি উড়োজাহাজে। পাইলটের ঘোষণায় সম্বিৎ ফিরল। প্রায় পৌঁছে গিয়েছি নিজের শহরে। কোমর বন্ধনিটি কষে বেঁধে জানালা দিয়ে তাকিয়ে জড়িয়ে গেল চোখ। মরূদ্যান দেখলে মরুভূমি পেরিয়ে আসা পথিকের নিশ্চয় এমনই মনে হয়। সামনের আসনে জানালার ধারে বসা মহিলাটি প্রায় উপচে পড়ে দেখতে লাগল ভূমিরূপ। পাশের সঙ্গীটিকেও দেখাল নাছোড়বান্দা ভাব নিয়ে। উষর দিল্লির পর সজল কলকাতা, সুখ এনে দিল বুঝি। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি এবং আরও পূর্বের ছোট বড় ভেড়ি। পাখির চোখে দেখছি আর মনটা আশা-আশঙ্কার ভাঙাগড়ার দোলায় দুলছে। বিমান থেকে পাখির চোখেই দেখতে পাচ্ছি আগ্রাসী শহর ক্রমে তার বুকের উপর উঠে এসেছে। বেশ বুঝতে পারছি দীঘল দিঘিতে ছায়া পড়ছে আকাশচুম্বি অট্টালিকার। যতটুকু তাল সুপুরি আম বটের ছায়া রয়েছে, তা বোধহয় থাকবে না আর বছর দশ বিশ পরে। কালীদহের জলে নয়, উদ্ধত কাচের দেওয়ালে মেঘের ছায়ার লুকোচুরি দেখবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। শুরু হয়ে গিয়েছে সেই স্থাপত্যের নির্মাণ, শুধু সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠার অপেক্ষা। সর্বনাশের অপেক্ষা।
কেন বললাম এ কথা। বললাম এ কারণে যে বিশ্বের মাত্র ৪০০টি শহরে বসবাস করে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। আর এই জনসংখ্যা পৃথিবীতে উৎপাদিত মোট শক্তির তিন ভাগের দু’ ভাগ ভোগ করে। আর এই শহরই পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি কার্বনডাইঅক্সাইড। শতকরা হিসেবে তা মোট কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গমনের ৭০ শতাংশ। হিসাব বলছে ২০৩০ সালে বিশ্বের শহরগুলি মোট উৎপাদিত শক্তির ৭৩ শতাংশই ভোগদখল করবে। ২০৩০ সালের দিকে লাগামহীন গতিতে ছুটছি আমরা। ওই সময় যত অট্টালিকা গড়ে ওঠার কথা তার তিন ভাগের দু’ভাগ তো এখনও গড়েই ওঠেনি। এমনই বলছে ম্যাকিনসে অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিবেদন। অন্য দিকে এখনই সেই চরম মাত্রা ছুঁয়ে ফেলেছে পশ্চিমের দেশগুলি। ভবিষ্যতের জন্য ৭০ শতাংশ বাড়ি-ঘরে এক মজুত ভাণ্ডার গড়ে ফেলছে তারা। সেই পথেই ছুটছি আমরা। পিছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই। তবু, দু’দণ্ড অবকাশ দিলে বলি, দেশের ৬৭ শতাংশ গৃহস্থের বাড়ি আজও বিদ্যুৎহীন। হাতে গোনা কয়েকটি বাড়িতে ২৪×৭ বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। ২০০৪-০৫ সালের সমীক্ষা বলছে, মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের অর্ধেকের বেশি ভোগ করে উচ্চবিত্ত ২০ শতাংশ মানুষ।
খাদের ধারে দাঁড়িয়ে পশ্চিমি দেশগুলি ভাবছে কী ভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনা যায়। লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে ফেলেছে তারা। যেমন লন্ডন ঠিক করেছে ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গমনের মাত্রা ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনবে। ২০২০ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনার কথা বলছে প্যারিস। ৩০ শতাংশ বলছে টরেন্টো। আমাদের সেখানে কোনও লক্ষ্যমাত্রা তো তৈরিই হয়নি, বরঞ্চ বড়লোকের বাউন্ডুলে বখাটে ছেলের মতো উড়িয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছি মহামূল্য শক্তি। কেমন তা?
একটু ভাবলেই বোঝা সম্ভব, একটু চোখ মেললেই দেখতে পাব শক্তির কী অসম্ভব অপচয় চলছে চারপাশে। রাজধানী শহর জুড়ে প্রবল লু বইছিল কয়েক দিন আগেও। ইন্ডিয়া হ্যাবিটেট সেন্টারে অতি আরামদায়ক পরিবেশে তখন পরিবেশ আলোচনা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এলসিডি প্রজেক্টরে ভেসে উঠল মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, গুড়গাঁও-এর আধুনিক স্থাপত্যের নমুনা। আশ্চর্য সমতা সেখানে। হংকং, সাংহাই, নিউইয়র্ক, শিকাগোর স্কাইলাইনের সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল আমাদের। পুঁজির দাপট কি এ ভাবেই মুছে ফেলে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের গৃহ-ভাবনা, গৃহ-সংস্কৃতির অপার বৈচিত্র। কাচের প্রাসাদে ঢাকা পড়ে যায় ভারতীয় বৈচিত্রের মুখ। মুম্বই আর কলকাতার আর কোনও পার্থক্য থাকে না।
আমাদের শেখানো হতে থাকে ইটের চেয়ে কাচ ঢের বেশি পরিবেশবান্ধব। অনেক বেশি নাকি নান্দনিক, টেকসই, সহনশীল, কম খরুচে ইত্যাদি। পশ্চিম দুনিয়া তাই বহু বছর আগে কাচের ব্যবহার করে মাতিয়ে দিয়েছে। বহু বিচিত্র আবহাওয়ার এই দেশে আমরা কি নিজেরাই গড়ে তুলিনি পরিবেশবান্ধব প্রাসাদ থেকে কুটির? শীতল মরুভূমি লাদাখ থেকে উত্তপ্ত বালির দেশ জয়পুর। বরফ ঢাকা পাহাড়ি রাজ্য থেকে সূর্যস্নাত সমুদ্র লাঞ্ছিত কেরল— আমাদের পরিবেশ সংস্কৃতি থেকেই তো গড়ে তুলেছি আমাদের বাসযোগ্য পরিবেশ। এত আলো হাওয়া রোদের দেশে কেনই বা প্রয়োজন একমাত্রিক কাচের স্বর্গ? একটু খুঁটিয়েই দেখা যাক তবে।
কাচ প্রস্তুতকারকদের যুক্তিটা শুনলাম। উল্টো দিকের কথাটা হল, এই উপমহাদেশে ঘর-বাড়ি তৈরির জন্য কাচের অতি ব্যবহার— বাইরের দেওয়ালে বিশেষ করে— বিদ্যুৎ খরচ বহু মাত্রায় বাড়িয়ে তুলছে। সূর্যালোক থেকে আসা উত্তাপ ঘরবন্দি করছে ওই দেওয়াল। এ কথা সত্যি বড় বড় কাচের দেওয়ালের ভিতর দিয়ে আসা আলোর জন্য কৃত্রিম আলো জ্বালানোর খরচ কমে। কিন্তু, বাড়তি উত্তাপের জন্য ঘর শীতল রাখার বাড়তি খরচ অর্থাৎ শীতাতপযন্ত্রের বাড়তি ব্যবহার সব হিসাবই গুলিয়ে দেয়। পশ্চিমি শীতের দেশের গৃহ-স্থাপত্যের অন্ধ অনুকরণ করে বসলাম আমরা আমাদের ক্রান্তীয় অঞ্চলে। কাচের দেওয়াল ফুঁড়ে আসা উত্তাপ সামলাতে প্রবল ভাবে এসি-র ব্যবহার করতে হল। এই জাতীয় বিশালাকায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিতে সাধারণ ভাবে এসি চলে ২২.৫ (+/-১ডিগ্রি) সেন্টিগ্রেডে। ৪০-৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ২১-২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে তাপমাত্রা নামিয়ে আনতে যে বিপুল শক্তির অপচয় চলছে, কে আর তা মাথায় রাখে। আর এই কনকনে পরিবেশে আমাদের পোশাক-আশাকও হয়ে উঠেছে পশ্চিমি ধাঁচে গড়া। মনে রাখতে হবে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সাহায্যে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি কমাতে গেলে শক্তি খরচ বাড়ে ৫ শতাংশ।
কিন্তু আমাদের নীতিহীনতা এই বেআক্কেলে খরচের মাত্রা ক্রমে বাড়িয়েই চলেছে। কাচের ব্যবহার সীমিত করে, বাড়ির যে অংশে রোদের তীব্রতা কম, সে অংশে কাচ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট উপভোগ্য মাত্রায় এসি-র ব্যবহার, পরিবেশ উপযোগী পোশাক বাবহার করে এই খরচ আমরা অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে পারি। যেমন করেছে পাকিস্তান। প্রবল গ্রীষ্মের দিনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সুপারিশ, হালকা রঙের ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। মোজা ও ফিতেওয়ালা জুতো না পরলেও চলবে। জাপানও পরিবেশ ও ঋতু অনুযায়ী স্কুল-কলেজ-অফিস-ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পোশাক পরা একরকম বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। প্রবল গরমে স্যুট-টাই পরা একদম বাতিল। এসি চলবে ২৬ডিগ্রি সেন্টেগ্রেডের আশেপাশে। মনে রাখতে হবে জাপানের তীব্র গরম মানে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
এক বিপুল পরিমাণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার নগরায়ণের মাত্রার বেগ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। নগরায়ণের এই চাহিদার আশি শতাংশই দেশের সাতটি প্রধান শহরকে ঘিরে। যার মধ্যে রয়েছে রাজধানী দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদ ও পুণে। আর এই নগরসভ্যতার এক একটি গৃহস্থ বাড়ি ভোগ করবে দেশের উৎপাদিত মোট শক্তির ৪০ শতাংশ, কাঁচামালের ৩০ শতাংশ, পানীয় জলের ২০ শতাংশ। বদলে দেশের মোট কার্বন নির্গমনের ৪০ শতাংশ, কঠিন বর্জ্যের ৩০ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ নোংরা জল উৎপাদন করবে।
আর মাথাব্যথার কারণটা এখানেই যে এর পর আমাদের শহরকে আমরা কেমন করে সহনশীল করে তুলতে পারি। আমাদের ঘর-বাড়ি, আমাদের জীবনযাপন, ভোগের ইচ্ছা, পরিবেশকে লালন-পালন করব কী ভাবে!
পরিবেশবান্ধব শহর গড়ে তোলার জন্য তৈরি হয়েছে ‘এনার্জি কনজারভেশন বিল্ডিং কোড’ (ইসিবিসি)। প্রত্যেক রাজ্য তার মতো করে ভাবছে এই বিল্ডিং কোড কী ভাবে উপযোগী করে তোলা যায়। শক্তির অতি ব্যবহার বা অপচয় রোধ করা অর্থাৎ শক্তি সংরক্ষণ করার উপরই জোর দেওয়া হচ্ছে। সৌর আলোর বেশি বেশি ব্যবহার। কোথাও কোথাও বিশেষ করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, হোটেল, হাসপাতালের মতো জায়গায় সৌর বিদ্যুতের সাহায্যে জলগরমের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির নির্দিষ্ট মান নিশ্চিত করা— এমনই কতগুলো পদক্ষেপ।
এর বাইরেও কোথাও কোথাও বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা ফের রিজার্ভ করে মাটিতে নীচে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো পদক্ষেপও নিয়েছে কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান। এমনকী রান্নাঘর, বাথরুমের নোংরা জল চিরাচরিত পদ্ধতি অনুযায়ী শোধন করে বাগানে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি সহনশীল শহর, যাকে আমরা বলতে পারি ‘গ্রিন সিটি’, পরিবেশের পরিভাষায় ‘সাসটেনেবল সিটি’ বলি যাকে সে পথে এ এক ছোট ছোট পদক্ষেপ মাত্র। কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নগরায়ণের প্রবল আগ্রাসী রূপের আতঙ্কের পাশাপাশি এমন কিছু কিছু প্রচেষ্টা আমাদের আশান্বিত করে তোলে বই কী!
এ তো গেল একটা দিক। এ বার বলি আরেকটা দিকের কথা। যার শিরোনাম হওয়া উচিত ‘ছি ছি এত্তা জঞ্জাল’। এই জঞ্জাল বা বর্জ্য যাই বলি না কেন— নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে তার বিপুল পরিমাণ ভার পরিবেশ দূষণে একটা অতিরিক্ত মাত্রা নিয়েছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সংসদে তাঁর ভাষণে জানিয়ে দিয়েছেন দেশে আরও এক হাজারটি শহর গড়ে তোলা হবে। সংখ্যাতত্ত্ব বলছে, দেশের নির্মাণ শিল্প গত ১০ বছরে ১০ শতাংশ হারে বেড়ে চলেছে। যেখানে বিশ্বের গড় হচ্ছে ৫.৫ শতাংশ। ২০০৫ সালে নির্মাণ এলাকা ছিল ২১ বিলিয়ন স্কোয়ার ফুট। সেখানে ধরা হচ্ছে ২০৩০ সালে তা পাঁচ গুণ বেড়ে হবে ১০৪ বিলিয়ন স্কোয়ার ফুট। এর উপর রাস্তা, সেতু, ফ্লাইওভার তো রয়েইছে।
এই নির্মাণ কাজের জন্য বা নয়া নির্মাণের জন্য পুরনো নির্মাণ ভাঙা হলে এক জাতীয় কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। পরিভাষায় যাকে বলা যায় নির্মাণ ও ধ্বংসের বর্জ্য। ২০১২ সালের ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, প্রতি বছর বিশ্বের শহরগুলি এমনই ১.৩ বিলিয়ন কঠিন বর্জ্য উৎপাদন করে। ২০২৫-এ যার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ২.২ বিলিয়ন টন। এর মধ্যে নির্মাণ শিল্প থেকে উৎপাদিত বর্জ্যের ভাগ মোট উৎপাদিত বর্জ্যের প্রায় অর্ধেক। আমাদের দেশে তার পরিমাণ কত? কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ দফতরের স্বীকারোক্তি এই জাতীয় বর্জ্য উৎপাদনের কোনও যথাযথ তথ্য ভাণ্ডারে নেই। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা তথ্যের ভিত্তিতে জানাচ্ছে ২০১৩ সালে ভারত ৫০ মিলিয়ন টন এই জাতীয় বর্জ্য উৎপাদন করেছে। গত আট বছরে যার সম্ভাব্য পরিমাণ হবে ২৮৭ মিলিয়ন টন।
এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য কোথায় যায়? একটু অবাক হবেন না যদি দেখা যায় এই বর্জ্য মুম্বইয়ে নিকাশি নালার ধারে জমা হচ্ছে এবং প্রবল বৃষ্টিতে ধুয়ে নালা বুজিয়ে দিচ্ছে। শহরের পাশে খোলা জায়গায় ডাঁই করে রাখা হচ্ছে। বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে নিচু জমি, জলাভূমি। দিল্লির যমুনা নদী কিংবা কলকাতার জলাভূমি, ভিআইপি রোডের পাশের নয়ানজুলি, বেহালা-যাদবপুর-পূর্ব কলকাতার অসংখ্য পুকুর বুজিয়ে ফেলা হয়েছে এই বর্জ্য দিয়েই।
এমনটা কিন্তু অন্য দেশে হয় না। যেমন ধরুন হংকং। নির্মাণ কাজ সংক্রান্ত বর্জ্যেরও উপর সে দেশের নির্মাণ সংস্থাকে পুনর্ব্যবহার বা পুনর্নবীকরণের জন্য বাধ্য করা হয়। বর্জ্য দিয়ে জমি ভরাট করলে দিতে হবে অর্থদণ্ড যতই তা প্রয়োজনীয় হোক না কেন। সিঙ্গাপুরের মতো দেশ ৯৮ শতাংশ এই জাতীয় বর্জ্য পুনর্নবীকরণ করে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে কিংবা আমেরিকায় বিশেষ করে নিউইয়র্কে এই জাতীয় বর্জ্যের ব্যবহার, পুনর্ব্যবহার বিষয়ে কঠিন আইন ও নীতি রয়েছে। স্কটল্যান্ড, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড কিংবা জাপানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ২০০০ সালের হিসেব বলছে স্কটল্যান্ড ৬৩ শতাংশ বর্জ্য পুনর্ব্যবহার যোগ্য করে তুলেছিল। নেদারল্যান্ড ৮০ শতাংশ এই জাতীয় নির্মাণ বর্জ্য দিয়ে ইট ও কংক্রিট তৈরি করেছে। জাপান ওই সময়ে ৯৫ শতাংশ এই বর্জ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেছে।
সমস্যা হল আমাদের দেশে এমন কোনও নীতি বা আইন আজও প্রণয়ন করা যায়নি। জাতীয় নির্মাণ সংস্থা সিপিডবলিউডি-র মতে, আমাদের দেশে ব্যুরো অব ইন্ডিয়ার স্ট্যান্ডার্ডের (বি আই এস) নিয়ম অনুযায়ী শুধুমাত্র আই এস ছাপ মারা (আই সি: ৩২৩-১৯৭০) কংক্রিট ব্যবহার যোগ্য। স্বাভাবিক ভাবেই কোনও নির্মাণ সংস্থাই বর্জ্য থেকে তৈরি নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করতে চাইবে না। এটা এক রকম অজুহাতও বলা চলে। কেননা বিআইএস-এর ডিরেক্টর জেনারেল সুনীল সোনির মতে, ওই সংস্থা নতুন জাতীয় নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। যে কোনও কর্তৃপক্ষই বর্জ্য থেকে ব্যবহার যোগ্য সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ কাজে অনুমতি দিতেই পারে। সে সামগ্রীর মান যথাযথ কিনা তা দেখে নিলেই হল।
আমাদের দেশে দিল্লিতে ২০০৯ সালে নির্মাণ বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার একটি প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার কিংবা পুরসভাগুলির কোনও নীতি না থাকার জন্য তার প্রকৃত ব্যবহার শুরু করা যায়নি। দিল্লি পুরসভা ও এনভায়রনমেন্টাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএইআইএসএল)-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয় একটা প্ল্যান্ট। সাত একর জমি দেয় পুরসভা। প্রতিদিন ৫০০ টন বর্জ্য পুনর্ব্যবহার যোগ্য করে তুলে তৈরি হচ্ছে রেডিমিক্স কংক্রিট, পেডমেন্ট ব্লক, কংক্রিটের ইট। বিভিন্ন ভাবে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করে তা যে যথেষ্ট উচ্চমানের তাও দেখা গেছে। পাঁচ বছর পরে এই সংস্থা যে লাভের মুখ দেখল না কিংবা আরও এমন উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ল না, তার জন্য সরকারকেই দায়ী করতে হয়। আমাদের পরিবেশ-বান্ধব শহর গড়ে তোলার ইচ্ছেগুলি আসলে আইন প্রণয়নকারীদের চার দেওয়ালে ঘোরে ফেরে। প্রকৃতিতে বাস করার, চার পাশ বাসযোগ্য করার উদ্যোগের সঙ্গী হতে পারল না। আমরা বাঁচব তো? প্রশ্নটা কিন্তু উঠছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy