যোগীর বুলডোজারের নীচে ভাঙা পড়েছে অখিলেশ যাদবের সাইকেল গ্রাফিক : শৌভিক দেবনাথ
সোজা কথাটা প্রথমেই সোজা ভাবে বলে ফেলা যাক। দেশে নতুন ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ এসে গিয়েছেন। খুব অলৌকিক কিছু না-ঘটলে ২০২৯ সালে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রীর মুখ হতে চলেছেন যোগী আদিত্যনাথ। যদি না তার আগে তার চেয়েও অলৌকিকতর কিছু ঘটে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী আর প্রধানমন্ত্রী না-থাকেন!
ভনিতা না-করে আরও একটা কথা এখনই বলে ফেলা যাক। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোট কভারেজের করার শুরুতে ‘উত্তরপ্রদেশের ভোট-বুক’ সিরিজে লিখেছিলাম, বিজেপি ক্ষমতায় ফিরবে। কিন্তু যোগী ফিরবেন তো? বৃহস্পতিবার সেই কূট সন্দেহেরও সর্বাত্মকরণে নিরসন হয়েছে। বস্তুত, দানবীয় বুলডোজারের চাকার তলায় যাবতীয় অভিযোগ এবং বিরোধিতাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে এখনও ৫০ না-পেরোন যোগী আদিত্যনাথ যে উচ্চতায় নিজেকে তুলে নিয়ে গিয়েছেন, তার সঙ্গে এক এবং একমাত্র তুলনীয় হতে পারেন মোদী স্বয়ং। যদিও ভোটে জেতার পর যোগী নিজে মোদীকেই যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়েছেন। সরাসরিই বলেছেন, ‘‘চার রাজ্যে জয় এসেছে মোদী’জির নেতৃত্বের জন্যই।’’
যোগীর বুলডোজারের নীচে ভাঙা পড়েছে অখিলেশ যাদবের সাইকেল। পিষ্ট হয়েছে মায়াবতীর হাতি। কাটা পড়েছে প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর হাত। পাশাপাশিই যোগীর এই জয় (প্রাপ্ত আসনসংখ্যার নিরিখে ‘বিপুল’ জয় বলা যাচ্ছে না। কারণ, যোগী নিজেই পাঁচ বছর আগে ৩১২টি আসন জিতে অদ্যাবধি রেকর্ড গড়ে বসে আছেন) কয়েকটি বিষয় নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে ছেড়েছে।
প্রথমত, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি। পুলিশ-প্রশাসনকে যথাসম্ভব স্বাধীনতা দিয়ে যোগী রাজ্যকে মির্জাপুর-মার্কা ওয়েবসিরিজের দুনিয়া থেকে বার করে এনেছেন। সমাজবাদী পার্টির শাসনে যে দুষ্কৃতীরা রাজত্ব করত, যোগী প্রশাসন তাদের অধিকাংশকে নিকেশ করেছে। বাকিদের নিরামিষ বানিয়ে ছেড়েছে। ফলে মহিলা ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপি-র পক্ষে গিয়েছে। যোগী নিজে যাকে বলছেন ‘সুশাসন।’ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন প্রকাশ্যে জনসভায় দাঁড়িয়ে দুষ্কৃতীদের উদ্দেশে বলেন ‘‘ঠোক দেঙ্গে!’’ তখন উত্তরপ্রদেশের মতো অপরাধপ্রবণ রাজ্যে তা বাড়তি তাৎপর্য এবং বার্তা বহন করে।
দ্বিতীয়ত, প্রশাসনকে কাজ করার স্বাধীনতা। উত্তরপ্রদেশ সরকারে কর্মরত আমলাদের মুখ্যমন্ত্রীর তরফে একটিই নির্দেশ ছিল— তাঁরা যেন উন্নয়নের বিষয়ে নীতি প্রণয়নে এবং তা এগিয়ে নিয়ে যেতে কোনও বাধার সম্মুখীন না-হন। হলে যেন সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কারণ, আমলারা সরকার চালান। রাজনীতির কারবারিরা তাঁদের স্বার্থ দেখেন।
তৃতীয়ত, উন্নয়নের বুলডোজার চালানো। পরিকাঠামোর উন্নতিসাধনের পথে কোনও বাধাই মানেননি যোগী। অযোধ্যার মতো শহরে রাস্তা চওড়া করার জন্য ভক্তকুলের দোকানও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ, উত্তরপ্রদেশকে তিনি আক্ষরিক অর্থেই ‘উত্তমপ্রদেশ’ বানাতে চান।
চতুর্থত, করোনার সময় প্রতিটি পরিবারকে বিনাপয়সার আনাজ, খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল সরবরাহ করা। যদিও বিরোধীরা বলছিলেন, মার্চ মাস শেষ হয়ে গেলে ওই সরবরাহ আর জারি থাকবে না। আর বিজেপি বলেছিল, যতদিন না করোনার অভিঘাত পুরোপুরি যাচ্ছে, ততদিন ওই পরিষেবা জারি থাকবে। মহিলা ভোটাররা যে কারণে যোগীর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন।
পঞ্চমত, হিজাব-বিতর্কে তাঁর দল এবং সরকারের অবস্থান। ভোটমুখী রাজ্যে হিজাব-বিতর্কের কোনও ছায়া পড়তে দেননি যোগী। সেই কারণেও মুসলিম মহিলাদের ভোট তাঁর পক্ষে যেতে পারে বলে ধারণা ভোট-পণ্ডিতদের।
ষষ্ঠত, যোগীর ব্যক্তিগত সততা। দাপুটে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পাঁচ বছরের শাসনকালে যোগীর বিরুদ্ধে কোনও ভাবে কখনও স্বজনপোষণ বা দুনীতির অভিযোগ ওঠেনি। যোগী-পূর্ব আমলে যে সমস্ত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে যেমন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তেমনই উঠেছে নিজেদের ‘ভাই-ভাতিজা’-দের সরকারি উচ্চপদে বসিয়ে দেওয়ার অভিযোগও। যোগী প্রথম থেকেই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী। গোরক্ষপুরের মঠই তাঁর আবাস। তিনি পূর্বাশ্রমের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেন না। করোনার সময় তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু তিনি যাননি। জাগতিক সমস্ত আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে তিনি স্বজনপোষণের রাস্তা বন্ধ করার বার্তা দিয়েছেন এবং ফলিত স্তরে তা করে দেখিয়েছেন, এমনই বলেন তাঁর ভক্তেরা। রসিকতা করে তাঁরা আরও বলেন, ‘‘যোগীবাবার তো আত্মীয় বলতে মঠের গোশালার গরুরা। ওদের তো আর সরকারি চাকরি দেওয়া যায় না!’’
এই বিভিন্ন বিষয়ের সামনে ধোপে টেকেনি হাথরস, উন্নাও বা লখিমপুর খেড়ির ঘটনা। বিরোধীরা বলবেন, উত্তরপ্রদেশে মেরুকরণের রাজনীতি করেছেন যোগী। ভোটের ময়দানেও সেই মেরুকরণই ছিল তাঁর হাতিয়ার। একথা অনস্বীকার্য যে, ভোটের আগে তাঁর আশি-বিশের ফর্মুলা (উত্তরপ্রদেশের ২৫ কোটি লোকসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দু এবং ২০ শতাংশ মুসলিম) ধর্মীয় মেরুকরণকে যে প্রকট করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু একইসঙ্গে যোগীর সরকারকে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এনেছে প্রথমে উল্লিখিত ছ’টি বিষয়ও।
প্রাচীন রাজনৈতিক প্রবাদ হল— উত্তরপ্রদেশ কখনও একই মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমতায় ফেরায় না। অন্তত গত সাড়ে তিন দশক ফেরায়নি। যোগী সেদিক দিয়েও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। পাঁচ বছর আগের চেয়ে তাঁর আসনসংখ্যা কমেছে ঠিকই। কিন্তু তার জন্য দায়ী খানিকটা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। যা তৈরি হয়েছিল বিজেপি-র বিধায়ক এবং মন্ত্রীদের একাংশের জনসংযোগ এবং জনপরিষেবা দিতে অনীহার কারণে। বস্তুত, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি-র তৃণমূল স্তরের কর্মীদের অনেকেই মনে করেছিলেন, গতবার জয়ী অন্তত ১০০ বিধায়কের টিকিট কাটা উচিত ছিল।
আসন কমে যাওয়ার অন্য কারণ হতে পারে রাজ্যে বেকারত্ব এবং কর্মহীনতা। বস্তুত, বিধানসভা ভোট কভার করতে গিয়ে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে ঘোরার সময় ট্র্যাফিক সিগনালে যে পরিমাণ ভিক্ষাজীবীর দেখা পেয়েছি, তা কম করে বলেও উদ্বেগজনক। সাধারণ ভাবে বলা হয়, কোনও শহরের রাস্তায় ভিক্ষান্নজীবীর সংখ্যা সে রাজ্যে অর্থনীতির সূচক। কিন্তু করোনার আবহে সেই কর্মহীনতার ‘দায়’ যোগী সরকারের উপরে বর্তায়নি। অন্তত ভোটের ফলাফল দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। নইলে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে কর্মহীনতা নিয়ে যে হতাশা তৈরি হয়েছিল, তার তেমন প্রতিফলন ভোটের যন্ত্রে পড়ল না কেন!
অতএব বৃহস্পতিবার বারবেলায় উত্তরপ্রদেশের ফলাফলের অস্যার্থ কী? যা বলেছেন যোগী, ‘‘এই রায় উন্নয়ন, সুশাসন, রাষ্ট্রবাদ, বিকাশ এবং সুরক্ষার পক্ষে।’’ আর গোটা দেশ বলবে, যাবতীয় অভিযোগ আর বিরোধিতা গুঁড়িয়ে দিয়ে ‘বুলডোজার যোগী’ই উত্তরপ্রদেশের ‘সিকন্দর’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy