দ্বেষ নয়: বর্ষশেষের রাতে প্রতিবাদমুখর শাহিনবাগ। নয়াদিল্লিতে। ছবি: রয়টার্স।
গরম জামা নেওয়া হয়েছে। খাবার নেওয়া হয়েছে। জলের বোতলও নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু মা কেবল একটার পর একটা গরম জামা কেন পরাচ্ছে, কিছুতেই বুঝতে পারছিল না বছর আটেকের ফতেমা। বর্ষশেষের পিকনিক-পার্টি তো কতই করেছে। কিন্তু এ বারের ছবিটা যেন আলাদা। মায়ের একটাই চিন্তা, খোলা জায়গায় মেয়েটার ঠান্ডা না-লেগে যায়।
রাতের শাহিনবাগ! রাত দশটায় ভিড়ে-ভিড়াক্কার গোটা এলাকা। ফতেমার ছোট্ট চোখে বিস্ময়। নিউ ইয়ারের পার্টি তো বাড়িতে হয়, এ তো খোলা আকাশের নীচে! এত লোকের সঙ্গে! ছোট্ট ফতেমা খুঁজে নিল তারই বয়সি নাম-না জানা খেলার সঙ্গীদের।
গত কালই কুড়ি দিনের শিশুকন্যা হাবিবাকে নিয়ে শাহিনবাগে বসেছিলেন রেহানা খাতুন। কী করে ঠান্ডায় এই খুদেকে নিয়ে বসে আছেন? মায়ের জবাব, ‘‘হাবিবা বড় হয়ে বলবে, আমাদের উপরে যখন অন্যায় হচ্ছিল, তুমি কী করছিলে আম্মি? ওকে কী বলব তখন? সংবিধান বাঁচাতে হবে। বসতেই হবে।’’
আরও পড়ুন: সব বুলেটের লক্ষ্য সংবিধান: আজাদ
দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশি তাণ্ডবের পর থেকেই নয়া নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ জানিয়ে শাহিনবাগে অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন স্থানীয় মুসলিম মহিলারা। ধীরে ধীরে আড়ে-বহরে বাড়তে থাকে ভিড়। মুসলিমদের পাশাপাশি যোগ দিতে থাকেন অন্য ধর্মের মানুষ। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে। বছর শেষে যা সরকার বিরোধিতাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।
আগামীর দিকে তাকিয়ে। মঙ্গলবার দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
শাহিনবাগে আজ নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পার্টি। ‘‘নাচ-গান, আবৃত্তির মাধ্যমে নতুন বছরকে আহ্বানের পাশাপাশি এ হল গণতন্ত্র ও সংবিধানকে বাঁচানোর লড়াই’’, বললেন জামিয়ার ছাত্রী রুকসানা। রুকসানার সঙ্গেই আজ এখানে নববর্ষ পালনে এসেছেন বন্ধু আঁচল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বললেন, ‘‘আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের রাজনীতি মানা যায় না। তাই নতুন বছরের শুরুটা সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই করতে চাই।’’ মহম্মদ শামিউল্লার সঙ্গে এখানে চায়ের কাপ বিলোচ্ছেন অভিষেক যাদবও। শাহিনবাগের মতো খোলা আকাশের নীচে মোদী সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নববর্ষ পালনের আয়োজন হয়েছে ইন্ডিয়া গেট থেকে জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। মধ্যরাতে সেখানেই হাজারো কণ্ঠের সম্মিলিত জাতীয় সঙ্গীতের উষ্ণতা আর ‘ভারত মাতা কি জয়’ গর্জনের সামনে মাথা নোয়ালো রাজধানীর হাড়কাঁপানো ঠান্ডা।
নব্বই বছরের এক বৃদ্ধা ছিলেন আজ শাহিনবাগের নতুন মুখ। দিল্লির প্রবল ঠান্ডা তাঁকে কাবু করতে পারেনি। ঠায় বসে রয়েছেন গত কয়েক দিনের মতোই। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘‘আমি ভারতীয় কি না, তার প্রমাণ কাউকে দিতে যাব কেন? এই দেশ আমার। মোদী ও তাঁর দলবল আসুক জানতে, আমি বুঝিয়ে দেব।’’
শাহিনবাগের অবরোধে ব্যবসা লাটে উঠেছে স্থানীয় শপিং মলের দোকানদারদের। তবুও বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন ক্ষতি। শাহিনবাগের ঝুপড়িতে থাকেন কৌসর বেগম। সকালে খাবার করে দিতে বাড়ি যান। তার পরে বসে পড়েন ধর্নায়। আপনাদের খাওয়াদাওয়া? হেসে বললেন, ‘‘ঠিক কেউ না কেউ পাঠিয়ে দেয়। অনেক মানুষ দূর থেকে এসে খাবার দিয়ে যান। এক জন পকোড়া-বিক্রেতা রোজ বেচাকেনা সেরে বেঁচে যাওয়া পকোড়া খাইয়ে যান।’’ স্থানীয় বিক্ষোভকারীরা তো বটেই, ভাগ পায় পুলিশও। এরই মধ্যে হাজির ভিড়ের মুখ চেনা এক পঞ্জাবি পরিবার। যাকে দেখে মহিলাদের তারস্বরে প্রশ্ন, ‘‘পাপাজি আজ কী এনেছেন?’’ দূরের সাথী, অচেনা মুখ দেখে আগে বসিয়ে একপ্রস্ত গরম চা। তার পরেই এগিয়ে আসে খাবার। সমস্বরে অনুরোধ, ‘‘আরে আমরা তো বসেই আছি। আপনারা কত দূর থেকে এসেছেন আমাদের জন্য। নিন, নিন আগে চা খান।’’
পার্টির বদলে প্রতিবাদ দিয়েই বর্ষবরণে মাতল রাজধানী। জামিয়া চত্বরে মশালের মতো জ্বলল সারি সারি মোবাইল। ইন্ডিয়া গেটের সামনে সমবেত জনতা। কাল নতুন বছরে তারা গণশপথ নেবে, নাগরিকত্ব আইন রুখে দেওয়ার।
রাত যত বাড়ছে, তাপমাত্রা নামছে রাজধানীতে। খেলতে খেলতে অজান্তে ফতেমার মাথার স্কার্ফটা টেনে নেয় বছর ছয়েকের সায়ন। শাহিনবাগের উষ্ণতার কাছে হেরে ভূত দিল্লির ঠান্ডা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy