প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে গুজরাতি শিল্পপতি গৌতম আদানির সম্পর্ক ঠিক কী, তা নিয়ে মঙ্গলবার লোকসভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। ছবি: পিটিআই।
যতক্ষণ তিনি বললেন, টানা বিরোধী বেঞ্চ থেকে চিৎকার ভেসে এল— ‘আদানি! আদানি!’ অর্থাৎ, গৌতম আদানি নিয়ে কিছু বলুন। যা শুনে নিজের কণ্ঠস্বর আরও উচ্চগ্রামে তুললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঝাড়া ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট সেই স্বরেই ভাষণ দিয়ে গেলেন লোকসভায়। কিন্তু ‘আদানি’ শব্দটি এক বারের জন্যও উচ্চারণ করলেন না। উল্টে ‘দুর্নীতি’র তির ঘুরিয়ে দিলেন কেন্দ্রের কংগ্রেসের নেতৃত্বেধীন ইউপিএ সরকারের দিকে।
আদানি বিতর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান স্পষ্ট। ওই শিল্পগোষ্ঠী সম্পর্কে যা পদক্ষেপ করার তা করবে ‘নিয়ামক সংস্থা’। বিজেপির দলগত অবস্থানও তাই। কিন্তু বিরোধীদের আক্রমণ চলছেই। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে গুজরাতি শিল্পপতি গৌতম আদানির সম্পর্ক ঠিক কী, তা নিয়ে মঙ্গলবার লোকসভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। বুধবার লোকসভায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর ধন্যবাদজ্ঞাপন ভাষণ দিতে প্রধানমন্ত্রী যখন উঠলেন, তখনই বিরোধী বেঞ্চ থেকে আওয়াজ উঠতে শুরু করল, ‘আদানি! আদানি!’ কিন্তু এক বারের জন্যও টসকালেন না মোদী। তাঁর ভাষণ শেষের পর বিরোধী বেঞ্চে বসে-থাকা রাহুলকেও টেবিল চাপড়াতে দেখা গেল। মুখে মৃদু হাসি। সমবেত আদানি-দাবির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়ায় রাহুলের সে হাসি ব্যঙ্গাত্মক নাকি প্রশংসাসূচক, তা রাহুল ছাড়া আর কারওরই বোঝার সাধ্য নেই অব্শ্য।
বুধবার বিকেল ৪টেয় ভাষণ শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। তার মধ্যে কয়েক বার বিরোধীদের কোলাহলের মধ্যে বলতে গিয়ে হোঁচট খেলেন, কখনও নিজেই কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকলেন। বক্তব্য শেষ করলেন বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে। ৭৫ মিনিটের ভাষণে নিজের শাসনকালে উন্নয়ন নিয়ে বললেন। স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বিরোধীদের খোঁচাও দিলেন। কিন্তু এক বারও আদানির নাম উচ্চারণ করলেন না। ঘুরিয়ে মোদী-জবাবে উঠে এল কংগ্রেস জমানায় ‘দুর্নীতি’র কথা।
মোদী এবং আদানিকে নিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্ন ছুড়ে মঙ্গলবার আক্রমণ শানিয়েছিলেন রাহুল। শিল্পপতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়ন, কী ভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশের কিছু দিনের মধ্যে তিনি সফল, কী ভাবে অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও একের পর এক বিমানবন্দর পরিচালনার বরাত পেয়ে যায় তাঁর গোষ্ঠী— এমনই সব প্রশ্ন করেছিলেন কংগ্রেসের ওয়ানাডের সাংসদ। তাঁর হাতে ছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘বিতর্কিত’ শিল্পোদ্যোগীর ছবিও। সেই সময় অবশ্য অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না মোদী। তবে শোনা গিয়েছে, সংসদে নিজের ঘরেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নজর ছিল টিভি-তে। যা থেকে অনুমেয় ছিল, বুধবার তিনি বিরোধীদের ‘প্রত্যাঘাত’ করবেন। কৌশলী ভাষণ এবং বাগ্মিতায় পাল্টা খোঁচা দেবেন বিরোধীদের। বুধবার প্রায় ৭৫ মিনিট তা-ই করলেন। তবে সন্তর্পণে এড়িয়ে গেলেন আদানি-প্রশ্ন।
বিরোধীরা যখন মোদী-আদানি ‘ঘনিষ্ঠতা’ নিয়ে সরব, তখন প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘বড় বড় দুর্নীতি থেকে মুক্তি খুঁজছিল দেশ। আজ সেই সব দুর্নীতি থেকে দেশ মুক্ত।’’ তার পর কটাক্ষের সুরে বললেন, ‘‘লোকসভায় গতকাল (মঙ্গলবার) কয়েক জনের মন্তব্যের পর পুরো ‘ইকো সিস্টেম’ যেন নড়ে গিয়েছে। তাঁদের সমর্থকেরাও উল্লসিত। আমিও গতকাল দেখছিলাম। কয়েক জনের বক্তৃতার পর কিছু লোক খুশি হয়ে বলছেন, ‘ইয়ে হুয়ি না বাত’। হয়তো তাঁরা রাতে ভাল ঘুমিয়েছেন এবং আজ (সময় মতো) ঘুম থেকে উঠতে পারেননি।’’ কারও নাম না করলেও এই খোঁচা যে রাহুলের উদ্দেশে, তা স্পষ্ট।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি, গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক উন্নয়ন হয়েছে দেশে। করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের অর্থনীতির যখন কোমর ভেঙে যাওয়ার জোগাড়, সেই সময়েও ভারত পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে উঠে এসেছে। মোদীর কথায়, ‘‘এটা কি গৌরবের নয়?’’ তার পর আবার আক্রমণের রাস্তায়, ‘‘আসলে কিছু মানুষ এমন ভাবে নিরাশায় ডুবে থাকেন যে, দেশের প্রগতির কোনও কিছুই তাঁদের চোখে পড়়ে না।’’
কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের ‘আদানি-আদানি’ রবের মধ্যে মোদীর সংযোজন, ‘‘ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট)-কে ধন্যবাদ। ভোটাররা যা পারেননি, তা তারা করে দেখিয়েছে। তাদের জন্যই আজ বিরোধীরা এক মঞ্চে জড়ো হয়েছেন।’’ প্রধানমন্ত্রীর আরও সংযোজন, ‘‘‘ইউপিএ আমলের শেষ ১০ বছর কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত শুধু সন্ত্রাসবাদী হামলা হত। সবাই ভয়ে ভয়ে থাকতেন। জম্মু-কাশ্মীর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত, সর্বত্র কেবল হিংসা আর হিংসার ঘটনা। আর ভারতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত।’’ অর্থাৎ, যে সময়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল।
ওই মন্তব্যের পরেই মোদীর সমালোচনায় সরব হন কংগ্রেসের সাংসদ অধীর চৌধুরী। খানিক থেমে মোদী আবার বলতে শুরু করেন, ‘‘গণতন্ত্রে সমালোচনা জরুরি। এবং তা গঠনমূলক হওয়াই অভিপ্রেত। কিন্তু এখানে শুধু সেনাকে গালি, কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে গালি, আরবিআইকে গালি (দিচ্ছেন বিরোধীরা)। শুনুন, মোদীর উপর দেশবাসীর ভরসা টিভি চ্যানেলে বসে হয়নি। খবর ছাপিয়েও হয়নি। দেশের জন্য তিনি লড়েছেন। দেশবাসীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য নিংড়ে দিয়েছেন নিজেকে। তাঁর উপর যে ভাবে দেশবাসী ভরসা করেন, তা এদের (বিরোধীদের) চিন্তাভাবনার বাইরে।’’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলতে থাকেন, ‘‘যে গরিব মানুষ প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি পেয়েছেন, তিনি আপনাদের মিথ্যা কেমন করে বিশ্বাস করবেন? ১৪০ কোটি মানুষের আশীর্বাদ মোদীর মাথায় রয়েছে। ওটাই আমার সুরক্ষাকবচ।’’ সেই সময় আর এক বার কংগ্রেসকে বিঁধে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘শুধু হার্ভার্ড নয়, বিশ্বের সমস্ত বড় বিশ্ববিদ্যালয় কংগ্রেসকে নিয়ে পড়াশোনা করবে।’’
তাঁকে নিয়ে সমালোচনার জবাবও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, ‘‘কখনও ঠাট্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ কেমন প্রধানমন্ত্রী, যাঁর মুখে কেবল শৌচাগারের কথা! হ্যাঁ, ইনি এমনই প্রধানমন্ত্রী, যিনি মা-বোনদের সম্ভ্রমের কথা ভাবেন। তাই স্যানিটারি প্যাডের কথাও বলেন। গরিব মা-বোনদের জীবনরক্ষার কাজ করেন।’’
ভাষণের শেষ লগ্নে আবারও বিজেপি জমানায় পরিবহণ, কৃষি এবং শিল্পের উন্নতির কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার পর বিরোধীদের ঠেস দিয়ে বলেন, ‘‘যাঁরা স্বপ্ন দেখছেন, ভাবছেন এক সময় এখানে (সরকার পক্ষের ট্রেজারি বেঞ্চে) বসতেন, আবার কবে বসবেন, তাঁরা আত্মনিরীক্ষা করুন। আপনাদের চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে।’’ বিরোধীদের ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ করতে বলে ৭৫ মিনিটের ভাষণ যখন শেষ করেন মোদী। ততক্ষণে সুকৌশলে আদানি ঢেউ মাথারা উপর দিয়ে বইয়ে দিয়েছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy