প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আধডজন প্রশ্নের মুখে পড়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। প্রতীকী ছবি।
২০১৭ সালের মে মাসে বেশ কিছু টেট-পরীক্ষার্থীর মোবাইলে আচমকাই এসএমএস পাঠিয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। ওই পরীক্ষার্থীদের কেউই টেট-এ পাশ করেননি। অথচ তাঁদের জানানো হয়েছিল, সব নথি ঠিক মতো না থাকার কারণে তাঁদের নাম আটকে রয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্র নিয়ে বিকাশ ভবনে দেখা করতে হবে। টেট-উত্তীর্ণ নন বলে তাঁদের কেউই চাকরির জন্য আবেদন করেননি। তা সত্ত্বেও ডিসেম্বর মাসে তাঁদের কাছে জেলা প্রাথমিক পর্ষদ থেকে ফোন করে জানানো হয়েছিল, যাবতীয় নথি যাচাই করা হবে। এর পরে তাঁরা কোনও ইন্টারভিউ, অ্যাপ্টিচুড টেস্ট ছাড়া চাকরিও পেয়ে গেলেন।
সুপ্রিম কোর্ট আজ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে প্রশ্ন করল, কেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ তাঁদের এসএমএস পাঠিয়েছিল? কেন তাঁদের ফোন করা হল? টেট পরীক্ষায় একটি প্রশ্নে ভুল ছিল বলে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ পরীক্ষার্থীদের এক নম্বর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারা সেই নম্বরের ভিত্তিতে টেট-উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করছেন, সেই তালিকা তখনও তৈরি হয়নি। তা হলে কেন বাছাই করা কয়েক জনকে নথিপত্র নিয়ে আসতে বলা হল?
এখানেই অবশ্য শেষ নয়। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আজ সুপ্রিম কোর্টের আধডজন প্রশ্নের মুখে পড়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু ও বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়ার বেঞ্চের প্রশ্ন, কেন প্রাথমিক শিক্ষক পদে ৪২ হাজারের বেশি শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও ২ হাজারের বেশি পদ খালি রেখে দেওয়া হল? এই ২ হাজার পদ বিক্রির জন্য রেখে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। আদালতের প্রশ্ন, কেন টেট পরীক্ষার্থীদের উত্তর সংবলিত ওএমআর শিট নষ্ট করে ফেলা হল? পরীক্ষায় অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরেই ওএমআর শিট নষ্ট করে ফেলা হয় বলে অভিযোগ উঠেছিল। আদালতের প্রশ্ন, একটি প্রশ্নে ভুল ছিল বলে কী ভাবে বাড়তি এক নম্বর দিয়ে চাকরি দেওয়ার জন্য ২৬৯ জনকে বেছে নেওয়া হল? অভিযোগ ছিল, এই ২৬৯ জনকে আগে থেকে বেছে নিয়ে পরে তাঁদের এক নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে চাকরি দেওয়া হয়। আদালতের আরও প্রশ্ন, টেট-এ পাশ করতে হলে দেড়শো নম্বরের পরীক্ষায় জেনারেল ক্যাটেগরির প্রার্থীদের নব্বই পেতে হত। কী ভাবে আটষট্টি, একাশি, পঁচাশি, পেয়েও অনেকে চাকরি পেয়ে গেলেন? তাঁদের এক নম্বর বাড়তি পেলেও টেট-এ পাশ করার কথা নয়। শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে এক জন ১৪১ নম্বর পেয়ে আগে চাকরি পাননি? নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে মামলাকারীদের হয়ে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য শেষের ঘটনাগুলি তুলে ধরার পরে বিচারপতিরাও চমকে ওঠেন।
পর্ষদের আইনজীবী জয়দীপ গুপ্ত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বাকি প্রশ্নের উত্তর তিনি পর্ষদের কর্তাদের থেকে জেনে বলবেন বলে জানিয়েছেন। আগামী মঙ্গলবার শুনানিতে সেই উত্তর শোনা হবে। বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু মজা করে জয়দীপকে বলেছেন, ‘‘আপনার জুনিয়র আইনজীবীকে বলুন, পর্ষদের অফিসারদের সঙ্গে হটলাইনে যোগাযোগ রাখতে।’’ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের আইনজীবী আজ ফের স্বীকার করে নিয়েছেন, ২৬৯ জনের মধ্যে ১৮ জনের চাকরি পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাঁদের মধ্যে চার জন সত্যিই টেট-উত্তীর্ণ নন। বাকি তিন জন প্রথমে জেনারেল ক্যাটেগরির ছিলেন। পরে তাঁরা শংসাপত্র দেখিয়ে ওবিসি শ্রেণিতে চলে যান। তাই তাঁদের পরীক্ষার যোগ্যতামান কমে যায়। বাকিদের ক্ষেত্রে তিনি আগামী সপ্তাহে উত্তর দেবেন। বিচারপতি ধুলিয়া তাঁকে হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘একশোর বেশি নম্বর পেয়েও প্রথমে চাকরি না পাওয়ার উত্তরও জানা দরকার।’’
কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে ২৬৯ জন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের চাকরি গিয়েছিল। তাঁরাই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এই সব শিক্ষকদের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদও সুপ্রিম কোর্টে যুক্তি দিয়েছে, ওই ২৬৯ জন প্রশ্নে ভুল ছিল বলে এক নম্বর বাড়তি পেয়ে চাকরি পেয়েছেন।
নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ শুনে আজ সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলেছে, যদি পর্ষদ গাফিলতি করে থাকে, তা হলে চাকরিপ্রার্থীদের কী দোষ? নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মামলাকারী যোগ্য প্রার্থীদের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেছেন, নিয়োগে যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, তারই ফায়দা পেয়েছেন এই ২৬৯ জন। এঁদের অনেকেই টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। কেউ ১০ লক্ষ, কেউ ৭ লক্ষ, কেউ ৫ লক্ষ টাকা। ইডি জানিয়েছে, মোট ২৫০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। চাকরিহারাদের হয়ে পি এস পাটওয়ালিয়া ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের হয়ে জয়দীপ গুপ্ত আবার যুক্তি দিয়েছেন, তাঁদের দিক থেকে দেখলে ২৬৯ জন নিয়ম মেনেই চাকরি পেয়েছিলেন। সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট দিলেও মানিক ভট্টাচার্যের গ্রেফতারি নিয়ে ইডি-র রিপোর্ট এখানে বিচার্য বিষয় নয় বলেও পাটওয়ালিয়া জোরালো আপত্তি তুলেছেন। বিকাশ বলেছেন, শুধু নিয়োগে অনিয়মের মাপকাঠিতেই ২৬৯ জনের চাকরি যাওয়া উচিত। এই সওয়াল-জবাব শুনে বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু সবাইকে আকিরা কুরোসাওয়ার ছবি ‘রশোমন’ দেখতে বলেছেন। বিচারপতি বসু বলেন, ওই সিনেমায় একই খুনের ঘটনার ছয় জন ছয় রকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণনা দিয়েছিলেন।
পর্ষদ জানিয়েছে, কলকাতা হাই কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশে সবাইকে বাড়তি ছয় নম্বর দিতে বলা হয়েছে। ফলে এই বাড়তি এক নম্বরের বিতর্কই আর ধোপে টেকে না। চাকরিহারাদের বক্তব্য, এক নম্বর বাড়তি পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ছয় নম্বর বাড়তি পেলে তাঁদের সকলে এমনিতেই চাকরি পেয়ে যাবেন। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগকারীদের হয়ে বিকাশরঞ্জন যুক্তি দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে আরও অনেককেই চাকরি দিতে হবে। তাঁর বক্তব্য, ২৬৯ জন বেআইনি ভাবে চাকরি পেয়েছেন। তাঁদের চাকরি খারিজের রায় ঠিক। ছয় নম্বর বেশি পাওয়ার জন্য তাঁদের কেউ চাকরি পাওয়ার যোগ্য হলে তাঁদের ফের চাকরিতে নিয়োগ করা হয়। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে এমন এক জনের ক্ষেত্রে তা হয়েছে।
তা শুনে আজ বিচারপতি ধুলিয়া মন্তব্য করেছেন, এঁরা পাঁচ বছর চাকরি করে ফেলেছেন। সেই পাঁচ বছর তো গেল! বিকাশ বলেছেন, তাতে কিছু যায় আসে না। সেটাই আইন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy