এখানেই ছিল অ্যালবার্ট এক্কার সমাধি, দেখাচ্ছেন ভুবন দাস। শুক্রবার আগরতলার শ্রীপল্লিতে। — নিজস্ব চিত্র।
ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাসের হাতে ধরা মাটি ভর্তি পিতলের কলস দেখে এক্কা পরিবার তার প্রামাণ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। টিভিতে সেই খবর দেখে সেই প্রশ্নকে যথাযথ বলেই মনে করছেন কয়েকশো কিলোমিটার দূরে, পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার ডুকলির শ্রীপল্লির বাসিন্দা ভুবন দাস। কারণ তিনি তো সে দিনের ঘটনার সাক্ষী। সাক্ষী আজকের বদলে যাওয়া শ্রীপল্লিরও। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কোথায় সমাধি? সেখানে তো এখন বাড়িঘর তৈরি হয়ে গিয়েছে!’’
তা হলে ওই মাটি কোথাকার? একই প্রশ্ন ত্রিপুরা প্রশাসনের অন্দরেও ঘুরছে। ঝাড়খণ্ড প্রশাসনের কর্তারা এসে মাটি সংগ্রহ করলেন। আর ত্রিপুরা সরকার তা জানলই না! সদর মহকুমা শাসক মানিকলাল দাস জানান, ‘‘আমার কাছে এই ব্যাপারে খবর নেই। ঝাড়খণ্ড থেকে সরকারি স্তরে যদি কেউ আসতেন, তা হলে আমার তো তা জানার কথা!’’ তাঁর মতে, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে কারও চিতাভস্ম বা সমাধির মাটি নিয়ে যাওয়া হলে সাধারণত প্রশাসনের কাছে খবর থাকে।
যাঁকে ঘিরে এই বিতর্ক, সেই অ্যালবার্ট এক্কা ৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ল্যান্সনায়েক। তাঁকে মরণোত্তর সর্ব্বোচ্চ সেনাপদক ‘পরমবীর চক্র’ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৪ গার্ড রেজিমেন্টের এই ল্যান্সনায়েক বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবেড়িয়া জেলার গঙ্গা সাগরের কাছে একটি পাকিস্তানি বাঙ্কারে হামলা
করার সময় শহিদ হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে মারা গিয়েছিল আরও ১২ ভারতীয় জওয়ান। রাঁচির জনবহুল একটি মোড়ের নামকরণ করা হয়েছে তাঁরই নামে, ‘অ্যালবার্ট এক্কা চক’। মোদ্দা কথায় আধুনিক ঝাড়খণ্ডে ‘পরমবীর’ অ্যালবার্ট এক্কা শহিদ হিসেবেই পূজিত হন।
কাল ছিল তাঁর মৃত্যুদিন। সকাল থেকেই রাঁচির অ্যালবার্ট এক্কা চকে ছিল নানা অনুষ্ঠান। এক্কার পরিবারের দীর্ঘ দিনের দাবি, তাঁর সমাধির মাটি এনে ঝাড়খণ্ডে একটি স্মৃতিসৌধ করা হোক। সব রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কিছুই হয়নি। শেষ পর্যন্ত আদিবাসী ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখেই কাল সকালের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শেষে দুপুর একটা নাগাদ হেলিকপ্টারে করে মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস এক্কার গ্রাম, গুমলার জারিতে পৌঁছন। সঙ্গে ছিল কলস-ভর্তি এক্কার সমাধির মাটি। ঝাড়খণ্ড সরকারের দাবি, ওই মাটি তারা এনেছে আগরতলার অ্যালবার্ট এক্কার সমাধিস্থল থেকে। এক্কার ছেলে ভিনসেন্ট মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে সেই মাটি নিতে অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, তিনি এখনও পর্যন্ত তাঁর বাবার সমাধি দেখেননি। তার পরিবারের কেউই দেখেননি। যে মাটি নিয়ে আসা হয়েছে সেই মাটি ওই সমাধিরই মাটি কি না তারও পরীক্ষা দরকার। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী গুমলার জেলাশাসককে দশ দিনের মধ্যে এক্কার পরিবারের সদস্যদের আগরতলায় নিয়ে গিয়ে মাটি সংগ্রহের নির্দেশ দেন।
সেই বিতর্ক আজ ফের উস্কেছেন ত্রিপুরার ভুবন দাস। ৭১ বছরের ভুবনবাবু তখন ছাব্বিশের যুবক। সে দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়: তখন যুদ্ধ চলছে। হঠাত্ একদিন শুনলাম গার্ড রেজিমেন্টের ১৩ জন জওয়ান মারা গিয়েছে। বসু সাহেব ভুবন-সহ স্থানীয়দের ডাকলেন। বললেন, ‘তোরা অভিযোগ করতিস, জওয়ানরা বাঁশ কেটে নিয়ে যায়। এই দেখ তাদের ১৩ জন শুয়ে আছে।’ ভুবনের কথায়, ‘‘বসু সাহেব তাঁদের ছেলের মতোই দেখতেন। আমাকেই বললেন সত্কারের ব্যবস্থা করতে।’’ আজকের ঘনবসতিপূর্ণ শ্রীপল্লির দিকে তাকিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরাই ১১ জনকে দাহ করার ব্যবস্থা করি। অ্যালবার্ট এক্কা ও আরও এক জনের সমাধির ব্যবস্থা করি।’’ নিখিল বসুর উদ্যোগে ও স্থানীয়দের সহায়তায় তৈরি হয় শহিদ বেদি।
সেই শহিদ বেদি আজও আছে। কিন্তু সমাধিক্ষেত্রে তো এখন বাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে। ১১জনকে যেখানে দাহ করা হয়েছিল সেই জমি খালি থাকলেও তা বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সেখানেও বাড়ি উঠবে শীঘ্রই। তাহলে মাটি কোথা থেকে নিল ঝাড়খণ্ড সরকার? কবেই বা নিল? ভুবনবাবুদের বক্তব্য, ‘‘এক মাস কেন, গত ছ’মাসের মধ্যেও তো কোনও সরকারি কর্তা এখানে মাটি নিতে আসেনি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy