নাথিং! নাথিং!
প্রশ্নটা ছিল, বাংলায় কংগ্রেস-সিপিএম হাত মেলানোয় কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াইয়ে তাঁর কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না।
সপাটে জবাব এল। যে যুক্তিতে কেরল-লবি আলিমুদ্দিনের জোট প্রস্তাবে বাগড়া দিয়েছিল, তা এক শব্দে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ওপারে ফেলে দিলেন।
রোদ পড়তেই পথে নামেন। কনভয়ের সামনে লাউডস্পিকার জানান দেয়, ‘সখাভ’ (কমরেড) ভি এস চলেছেন। পিছনে লাল ঝান্ডার বাইক বাহিনী। পালাক্কাড় শহর থেকে বেরিয়ে মালমপুঢ়ার কোট্টেকাড নদীর ধারের ছোট্ট গ্রামে গাড়ি থামে। বহু দিনের সহকারী কুনহিকান্ননের হাতে ভর দিয়ে নেমে চেয়ারে বসেন তিনি। পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আট থেকে আশি। ভি এস-এর পা ছুঁতে পেরে আবেগে চোখ ছলছল সত্তরোর্ধ্ব সীমা দেবীর। ঘিরে ধরে গোটা গ্রাম, যেন কুটুম এসেছে।
বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ভাই-বোনেদের ‘সহোদরন, সহোদরি’ ডাকে বক্তৃতা শুরু হয়। মিনিট দুয়েক, ব্যাস। ‘সাম্প্রদায়িক’ মোদী সরকার ও কেরলের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ উমেন চান্ডি সরকারের বিরুদ্ধে তোপ এবং ভোটের আর্জি। হাত জোড় করে ‘অভিবন্দনম’। এতেই উত্তাল জনতা। গলার শিরা ফুলিয়ে ‘কমরেড ভি এস জিন্দাবাদ’-এর মধ্যেই গাড়িতে ওঠেন তিনি। তখন আর কারও হাত ধরার প্রয়োজন পড়ে না। এই আবেগ, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, জয়ধ্বনি—সব যেন ‘এনার্জি ড্রিঙ্ক’-এর মতো শুষে নিয়েছেন। ঠিক যেমন রোজ সকালে যোগাসনের পরে খালি গায়ে রোদে দাঁড়িয়ে সূর্যের তেজ টেনে নেন। গ্রামের পর গ্রাম, একের পর এক পথসভায় গলার তেজ, বক্তৃতার দাপট বাড়তে থাকে। বিজেপি-কংগ্রেসকে একসঙ্গে নিশানা করেন ভি এস অচ্যুতানন্দন। তখন কে বলবে, অক্টোবরে ৯৩-এ পা দেবেন তিনি।
দিনের শুরু ভোর সাড়ে চারটেয়। তার পর শুরু হয়ে যায় ভোটের ঝোড়ো প্রচার। সকালে ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা, ফের বিকেল সাড়ে ৪টে থেকে রাত ৯টা— গ্রামেগঞ্জে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছেন ভি এস। ২০ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত রাজ্য জুড়ে অন্তত ৬৪টি জনসভা করেছেন। তার পর থেকে নিজের কেন্দ্র মালমপুঢ়ায় প্রতিদিন অন্তত ২০ থেকে ২৫টি সভা করে চলেছেন তিনি। কেরলের ভোটে কংগ্রেসকে হটিয়ে বাম জোটকে ক্ষমতায় ফেরানোর দায়িত্ব তাঁরই কাঁধে। তিনিই সেনাপতি। রাজ্য জুড়ে বাম প্রার্থীদের ছবির পাশে তাঁরই হাসিমুখ। ক্যারিশমা, চুম্বক আকর্ষণে তাঁর ধারেকাছে কেউ নেই।
মালমপুঢ়ায় তাঁর উল্টো দিকে কংগ্রেসের ছাত্র নেতা ভি এস জয়। ৯২ বছরের মানুষটির সঙ্গে লড়াইয়ে নামা ২৯-এর যুবকের লক্ষ্য, গত বারের ব্যবধান কমানো। তা-ই বলে অচ্যুতানন্দনের অভিধানে সন্তুষ্টির জায়গা নেই। ভোটের প্রচারই হোক বা খাওয়াদাওয়া, শরীরচর্চা—সবটাই রুটিনে বাঁধা। কোথাও কোনও ফাঁকি নেই। নিন্দুকেরা বলছেন, ভি এস জানেন, তিনি মালমপুঢ়ায় বাইরের লোক। গত দশ বছরে প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী, তার পর বিরোধী দলনেতা হিসেবে তিরুঅনন্তপুরমেই বেশি সময় কেটেছে তাঁর। এলাকার উন্নয়ন নিয়েও অভাব-অভিযোগ রয়েছে। তাই মালমপুঢ়ায় মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন তিনি। ভি এস-এর মিডিয়া সচিব ভি সুধাকরন হেসে বলেন, ‘‘একেবারে প্রান্তিক মানুষের কাছে, বিশেষ করে গ্রামের মহিলাদের কাছে উনি পৌঁছতে চান। ওঁদের দাবিদাওয়া, সমস্যা নিয়ে বারবার আন্দোলন করেছেন তিনি।’’
ভোটের কাজে এসে নিজস্বী তোলার হিড়িক। শুক্রবার কোভালামে। ছবি: পিটিআই।
ভি এস নিজেও মানেন, মানুষের আবেগই তাঁর শক্তিবর্ধক। ২০ বছর ধরে যোগাসন, মেপে খাওয়াদাওয়া করেন বলেই ৯২ বছরেও ২৯-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন। সিপিএম পার্টিতে দীর্ঘজীবী নেতাদের তালিকাটা দীর্ঘ। জ্যোতি বসু, সুরজিত, ইএমএস, ই কে নায়ানার, নৃপেন চক্রবর্তী। কিন্তু ভি এস-র মতো এই বয়সেও সক্রিয় থাকতে পারেননি কেউ। সেই ১৯৬৪ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদ থেকে যে ৩২ জন বেরিয়ে এসে সিপিএম তৈরি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র ভি এস-ই এখনও ‘নটআউট’। যত বারই ঘরে-বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভাবেন এটাই তাঁর শেষ ইনিংস, তত বারই নতুন করে ফিরে আসেন তিনি। মানুষের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেই শরীরে যেন নতুন রক্ত আমদানি হয়। আমজনতার রুটিরুজির সমস্যা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। তত্ত্বকথনের প্রয়োজন পড়ে না।
এ বারও তা-ই। গোটা কেরল-লবি যখন বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বিরোধিতা করছে, পার্টি কংগ্রেসের দলিল দেখিয়ে আদর্শের প্রশ্ন তুলছে, তখন জোটের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন ভি এস। এখনও তাঁর যুক্তি, ‘‘বাংলা আর কেরলের পরিস্থিতি আলাদা। আলিমুদ্দিনের নেতারা তাঁদের রাজ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাতে আমার কংগ্রেসের সঙ্গে লড়তে কোনও অসুবিধা নেই।’’
মোদী প্রচারে এসে ‘বাংলায় কুস্তি, কেরলে দোস্তি’-র কথা বলে সিপিএমের মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। ভি এস-এর কথা, ‘‘সিপিএম তো কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাতে যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিপিএমের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি একজোট হয়েছে।’’
দলের মধ্যে তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী পিনারাই বিজয়ন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু কংগ্রেসকে সরিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে গোটা রাজ্যে দলের বাজি ভি এস-ই। দলের সংগঠন পিনারাইয়ের হাতের মুঠোয় থাকলেও ভি এস মানুষের নেতা। পিনারাই নিজেও মেনে নিয়েছেন, বিজেপির ভোট কাটা সামলে, কংগ্রেসকে হটাতে ভি এস ছাড়া উপায় নেই। মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে কে বসবেন, পরে বুঝে নেওয়া যাবে। কিন্তু মালমপুঢ়ার ভি এস-ভক্তরা মনে করেন, তাঁরা ভাবী মুখ্যমন্ত্রীকেই ভোট দিয়ে জেতাবেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামীরা জানেন, দলকে ক্ষমতায় জিতিয়ে আনলে ভি এস ফের মুখ্যমন্ত্রীর গদির দাবি জানাবেন। বয়স ও পিনারাইয়ের তোয়াক্কা না করেই।
ভেলিক্কাকাথু শঙ্করন অচ্যুতানন্দনের জন্য বুড়ো হাড়ে ভেল্কি বিশেষণও বড্ড ক্লিশে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy