বাবার সঙ্গে সোমদত্তা। নিজস্ব চিত্র
মেয়ের আচরণে সে দিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন তনুশ্রী-সুশান্ত নায়ক।
নিরন্তর ভারী বর্ষণের মধ্যে বিকেলের বদলে রাত আটটায় পৌঁছেছেন কেদারনাথে। হোটেলে উঠে আগে বাজার থেকে নতুন পোশাক কিনে আনতে হয়েছে তিন জনের। রাত বেড়েছে, বৃষ্টিও। এর পরে রাত দুটোর সময়ে ধাক্কা দিয়ে বাবা-মাকে তুলে দিয়েছিল সোমদত্তা, চোখেমুখে আতঙ্ক। সঙ্গে চিৎকার, ‘এক্ষুনি বেরিয়ে চলো। এক মুহূর্ত থাকব না এখানে। সব ডুবে যাবে!’
পথশ্রমে ক্লান্ত সোমদত্তা সে দিন চোখের পাতা বুজতেই দুঃস্বপ্ন— জানলা-দরজা সপাটে খুলে ঘরে ঢুকে আসছে জলস্রোত। সব্বাই পাক খেতে খেতে তলিয়ে যাচ্ছে তাতে, বাবা-মা-সে! ঘুম ভেঙে শুরু করেছিল চিৎকার। “পাহাড়ে বৃষ্টি অনেক দেখেছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত বোধ জীবনে হয়নি।” সোমবার বলছিলেন সোমদত্তা নায়ক।
রবিবার ভিডিয়োয় চামোলীতে জল-দানবের ধেয়ে আসা দেখে ২০১৩-র ১৬ জুনের কথা কি মনে পড়ে গিয়েছে তনুশ্রীদের? কণ্ঠে বিহ্বলতা, বললেন— “আট বছরে একটা দিনও নেই, যে দিন ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা মনে পড়ে না।’’ সে রাতে মেয়ের আতঙ্ক দেখে গোছগাছ শুরু করেন তাঁরা। আলো ফুটতেই কেদারনাথ ছেড়ে নামা শুরু করেন।
কেদারনাথে জুনের ১৬ তারিখ রাতে চোরাবারি তাল ফেটে গিয়ে নেমেছিল হড়পা বান। তার আগে হয়েছিল মেঘপুঞ্জ ভাঙা বর্ষণ। ১৬ তারিখ ভোরে তনুশ্রীরা যখন নেমে আসা শুরু করেন, রাস্তার উপর গোড়ালি ভেজানো জলস্রোত। চোখের সামনে বিশাল একটা পাথর মাথায় পড়ায় ছটফট করে মারা গেল একটা ঘোড়া। খানিক পরে ফের বৃষ্টি, তার মধ্যেই চলা।
সকাল ১০টায় রামওয়াড়ায় গিয়ে থমকে যেতে হল। সামনে রাস্তা ভেঙে নেমে গিয়েছে। ছিঁড়ে ঝুলছে ১০ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তার। শ’খানেক মানুষ আটকে ছটফট করছেন সেখানে। উপর থেকে নেমে আসছে পাথরের সারি আর কাদাগোলা জল। রাজস্থানের দেহাত থেকে আসা লাঠিধারী দীর্ঘদেহী এক বৃদ্ধ প্রথম সগর্জন ঘোষণা করেছিলেন— ‘যো ভি হো যায়ে, হম উতর যায়েঙ্গে! কোই যায়েঙ্গে মেরা সাথ?’
সোমদত্তা হাত ধরেছিল বৃদ্ধের। পিছনে তনুশ্রী-সুশান্ত। চার জনকে এগোতে দেখে উঠে পড়েন বাকিরাও। না-হলে রামওয়াড়ার সঙ্গে সে দিন মুছে যেতে হত সবাইকে। শুরু হল গৌরীকুণ্ড অভিমুখে চলা। তনুশ্রীর কথায়, “স্থানীয় কিছু ছেলে হাত ধরে পার করে না-দিলে রাস্তার ওই ভাঙা অংশ আমরা পেরোতেই পারতাম না। একটু এগোতেই কাদায় পিছলে চোখের সামনে আরোহী-সমেত খাদে তলিয়ে গেলেন চার ডুলি বাহক!” রাস্তার কাদাজল বাড়তে বাড়তে কোমর ছুঁয়েছে। পথের পাশে মানুষ আর ঘোড়ার দেহ।
গৌরীকুণ্ডের তিন কিলোমিটার আগে পৌঁছে তনুশ্রীদের মনে হয়েছিল, সব আশা শেষ। ছোট সেতুটিকে ধুয়ে নামিয়ে দিয়েছে জলের তোড়। নীচে পাক খেয়ে ফুঁসছে মন্দাকিনী। এক পিট্টু সাহস করে এক দৌড়ে পেরিয়ে গেল ইঞ্চি ছয়েক বেরিয়ে থাকা প্রায় চার ফুটের একটি পাথরকে। দুই প্রৌঢ়া বেমালুম তলিয়ে গেলেন ফুলে ওঠা জলের মধ্যে। সোমদত্তার কথায়, “মুষড়ে পড়া বাবা-মাকে বোঝালাম, চলো আমরা ঠিক পারব। আর কী ভাবে যেন, আমরা পেরিয়ে গেলাম সেই ভাঙা সেতু! সন্ধ্যা ছ’টায় গৌরীকুণ্ডে যখন পৌঁছলাম, মন্দাকিনীর জল উঠে আসছে রাস্তায়। বেশ খানিকটা নীচে সীতাপুরে আছে আমাদের গাড়ি। ফের হাঁটা সোনমার্গ সেতু পেরিয়ে সীতাপুরের দিকে।’’ সেতুর ঠিক আগে মিলল একটি গাড়ি, যে তনুশ্রীদের সীতাপুরে পৌঁছে দেবে। সে গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে সোনমার্গ সেতু পেরিয়ে যাওয়া মাত্র পিছনে প্রচণ্ড শব্দ। ভেঙে পড়ল সেই সেতু!
রাত দশটা নাগাদ একের পর এক জনপদ ধ্বংস করে সেই হড়পা বান যখন নেমে এসেছিল, তনুশ্রী-সুশান্ত-সোমদত্তা তখন সীতাপুরের হোটেলে। বহু নীচের মন্দাকিনী উঠে এসে হোটেলকে ঘিরে ফেলেছিল, ফিরে গিয়েছিল কয়েকটা গাড়িকে ভাসিয়ে নিয়ে। পাঁচ দিন সেখানে আটকে থেকে ২১ জুন বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন ওঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy