Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Vikas Dubey

‘গাড়ি না-ওল্টালে তো উল্টে যেত সরকারটাই’

বিরোধীরা বলছেন, উত্তরপ্রদেশের গদিতে বসেই অপরাধীদের ‘ঠোক দুঙ্গা’ নীতি নিয়েছিলেন আদিত্যনাথ।

বিকাশ দুবের এনকাউন্টার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা।

বিকাশ দুবের এনকাউন্টার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২০ ০৬:০৭
Share: Save:

‘আসলে গাড়িটা ওল্টায়নি! রহস্য ফাঁস হলে সরকার উল্টে যেত। সেটা আটকানো হল।’

উত্তরপ্রদেশের গ্যাংস্টার বিকাশ দুবের ‘এনকাউন্টারে’র কয়েক ঘণ্টা বাদে টুইটারে এমন প্রতিক্রিয়াই জানালেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব। ‘এনকাউন্টার’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রায় একই ভাবে সুর চড়াল কংগ্রেস, তৃণমূল। সমালোচনার সুর এমনকি মায়াবতীর গলাতেও।

বিরোধীরা বলছেন, উত্তরপ্রদেশের গদিতে বসেই অপরাধীদের ‘ঠোক দুঙ্গা’ নীতি নিয়েছিলেন আদিত্যনাথ। পরবর্তী সাড়ে তিন বছরে একের পর এক অপরাধীকে আক্ষরিক অর্থেই ‘ঠুকে’ দিয়েছে তাঁর পুলিশ। কিন্তু আঁচ লাগেনি বিকাশ দুবে ও তার দলবলের গায়ে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত রাজ্যের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধী’দের তালিকায় প্রথম ২৫ জনেও জায়গা পায়নি সে! এই সময়ে বরং তার যোগাযোগ বেড়েছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে। যার প্রমাণ হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে যোগী সরকারের এক মন্ত্রীর সঙ্গে বিকাশ ও তার ছায়াসঙ্গী অমর দুবের ছবি। এ দিন প্রশ্ন উঠেছে, বিকাশের ভাঁড়ার থেকে এমন আরও অনেক প্রমাণ বেরিয়ে আসা আটকাতেই কি এ ভাবে মারা হল তাকে?

যোগীর রাজ্যে

• ১৬ মাসের মধ্যে ৩ হাজার ২০০টি এনকাউন্টার চালানো হয়েছে। মৃত ৬৯ অপরাধী। গ্রেফতার ৭ হাজার ৪৩ জন। গুরুতর আহত ৮৩৮ জন অপরাধী।
মুখ্যসচিবের চিঠি, জানুয়ারি, ২০১৯

• গত দু’বছরের বেশি সময়ে পুলিশের সঙ্গে ৫ হাজার ১৭৮টি সংঘর্ষে ১০৩ জন অপরাধীর মৃত্যু হয়েছে। জখম হয়েছে ১ হাজার ৮৫৯ জন। আত্মসমর্পণ এবং জামিন বাতিল হওয়ায় জেলে ১ লক্ষ ৭৭ হাজার ৪৫ অপরাধী।
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের টুইট, ডিসেম্বর, ২০১৯

এই রাজনৈতিক যোগাযোগই কি শেষ পর্যন্ত কাল হল বিকাশের? এই প্রশ্নটা আজ বারেবারে উঠেছে। যে নেতারা তাকে বারবার আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁরাই তাকে সরানোর কলকাঠি নাড়লেন? ৮ পুলিশকে খুন করে উধাও হয়ে যাওয়া বিকাশকে গত কাল বিজেপি শাসিত রাজ্য মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে মহাকাল মন্দির থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার আগের দিনই তাকে ধরার জন্য পুলিশ হানা দিয়েছিল আর এক বিজেপি শাসিত রাজ্য হরিয়ানায়। মহাকাল মন্দির থেকে বিকাশকে ধরার পরে অনেকেই দাবি করেছেন, ওটা গ্রেফতার না, পুলিশের ‘এনকাউন্টার’ থেকে বাঁচতে অনেক অঙ্ক কষে আত্মসমর্পণ করেছিল গ্যাংস্টার। কারণ গত ক’দিনে বিকাশের সঙ্গীদের যে ভাবে ‘এনকাউন্টারে’ মেরেছে পুলিশ, নাগালে পেলে তাকেও যে একই ভাবে মারবে, সেটা বুঝেই আত্মসমর্পণ করেছিল সে। এবং সেখানেও ছিল রাজনীতির হাত। একটি সূত্রের বক্তব্য, মধ্যপ্রদেশ এবং বিহারের দুই প্রভাবশালী নেতার ভূমিকা ছিল এই আত্মসমর্পণে। সব মিলিয়ে স্পষ্ট হচ্ছিল বিকাশের গেরুয়া-যোগ। সেটা ধামাচাপা দিতেই কি ‘এনকাউন্টার’?

সেই প্রশ্নটাই মোটামুটি একসুরে তুলেছেন বিরোধীরা। যোগী-রাজকে নিশানা করে রাহুল গাঁধী টুইটারে লিখেছেন, ‘কই জবাবো সে অচ্ছি হ্যায় খামোশি উসকি, না জানে কিতনে সওয়ালো সে আবরু রাখ লি’ (কিছু জবাবের থেকে ওর নীরবতাই ভাল, কত প্রশ্ন যে আড়াল পেল!)।গত কদিন ধরে বিকাশ দুবের ব্যাপারে সিবিআই তদন্তের দাবি করা প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা বলেছেন, ‘অপরাধী তো শেষ হল, কিন্তু অপরাধ ও অপরাধীকে যারা নিরাপত্তা দিত, তাদের কী হবে?’ বিকাশের ‘এনকাউন্টার’ নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেসের রণদীপ সুরজেওয়ালা। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র টুইটারে লেখেন, ‘যোগীজির ‘এনকাউন্টার’-রাজে মৃত্যু হয় শুধু বিচারব্যবস্থার’। বিএসপি নেত্রী আবার ৮ পুলিশ খুন এবং বিকাশের ‘এনকাউন্টার’ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন।

উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে নেতা-মাফিয়া যোগাযোগের ইতিহাস নতুন নয়। বিকাশ দুবেও তার ব্যতিক্রম নয়। ১৯৯০-এর মাঝামাঝি রাজনীতিতে পা দেয় মধ্য কুড়ির বিকাশ। সুযোগ বুঝে কখনও জনতা দল, কখনও বিজেপি, কখনও বিএসপি-তে যাওয়া চৌবেপুরের বিধায়ক হরিকিষেণ শ্রীবাস্তব ছিল তার রাজনীতির ‘গুরু’। সেই সূত্রেই নিজের গ্রাম বিকরু এবং লাগোয়া বেশ কিছু এলাকায় অখণ্ড দাপট ছিল তার। সেটাকে কাজে লাগিয়েছে রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলগুলি। যে কারণে থানায় ঢুকে বিজেপির মন্ত্রীকে খুন করার পরেও তার বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী দেয়নি! নিজে এক সময় বিকরু লাগোয়া ঘিমাউ থেকে জেলা পঞ্চায়েত ভোটে জিতেছিল বন্দুকের জোরে। সেই জোর কাজে লাগিয়েই বিকরু এবং লাগোয়া একাধিক পঞ্চায়েতে কে জিতবে, তা ঠিক করত বিকাশ। নিজের স্ত্রী রিচা দুবেকেও ওই বন্দুকের জোরেই জিতিয়েছিল জেলা পঞ্চায়েত আসনে।

বিতর্কিত এনকাউন্টার

জুন, ২০০৪
ইশরাত জহান এনকাউন্টার
• ইশরাত-সহ চার জনকে মারে গুজরাত পুলিশ
• অভিযোগ: তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্র
নভেম্বর, ২০০৫
গুজরাত পুলিশের সোহরাবুদ্দিন শেখ এনকাউন্টার
• অভিযোগ: জঙ্গি ও আইএসআইয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো, এক নেতাকে হত্যার ছক
ডিসেম্বর, ২০০৬
তুলসীরাম প্রজাপতি এনকাউন্টার
• অভিযোগ: গুজরাত পুলিশের হেফাজত থেকে পালানোর চেষ্টা
নভেম্বর, ২০০৬
• মুম্বইয়ে হত গ্যাংস্টার ছোটা রাজনের ছায়াসঙ্গী রামনারায়ণ গুপ্ত
সেপ্টেম্বর, ২০০৮
বাটলা হাউস এনকাউন্টার
• অভিযোগ: ২০০৮ দিল্লি বিস্ফোরণে যুক্ত জঙ্গিরা ওই বাড়িতে লুকিয়ে ছিল
ডিসেম্বর, ২০০৮
ওয়ারাঙ্গল এনকাউন্টার
• অ্যাসিড হামলায় তিন অভিযুক্তকে হত্যা।
• অভিযোগ: কলেজ ছাত্রী এবং পুলিশের উপর হামলা
জুলাই, ২০১০
• মহারাষ্ট্রের জোগাপুল জঙ্গলে তল্লাশির সময়ে এনকাউন্টারে হত মাওবাদী নেতা চেরাকুরি রাজকুমার।
এপ্রিল, ২০১৫
হত ৫ সিমি সদস্য
• পাঁচ জনকে কোর্টে নিয়ে যাচ্ছিল তেলঙ্গানা পুলিশ। তখনই পালানোর উদ্দেশে পুলিশের উপরই হামলা করে তারা
সেপ্টেম্বর, ২০১৮
নিহত অ্যাপল সংস্থার কর্মী বিবেক তিওয়ারি
• অভিযোগ: পুলিশ গাড়ি দাঁড় করাতে বললেও তিনি তা করেননি
ডিসেম্বর, ২০১৯
তেলঙ্গানা এনকাউন্টার
• চিকিৎসককে গণধর্ষণে অভিযুক্ত চার জনকে হত্যা
• অভিযোগ: তদন্তের জন্য ঘটনাস্থলে নিয়ে গেলে তারা পালানোর চেষ্টা করেছিল

কানপুরের ত্রাস হয়ে ওঠা বিকাশের দাপটের কথা জানত সব দলই। রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের হাত বহু বছর ধরে মাথার উপর থাকায় কখনও, কোনও মামলায় জামিন পেতে অসুবিধা হয়নি বিকাশের। সেই জোরেই ২০১৮ সালে, যোগী জমানায় শেষ বার জামিন পেয়েছিল বিকাশ। গত কয়েক বছর ধরে বিজেপিতে নাম লেখানোর চেষ্টা করছিল।

আরও পড়ুন: ‘সংঘর্ষে’ নিহত উত্তরপ্রদেশের বাহুবলী বিকাশ, হুবহু মিলে গেল ‘ভবিষ্যদ্বাণী’

আরও পড়ুন: হাসছেন সাইবারাবাদের ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’

চৌবেপুর আসনটি লুপ্ত হয়ে যাওয়ায় রানিয়া বিধানসভা কেন্দ্রে দাঁড়ানোর অঙ্কও কষছিল বিকাশ। একাধিক সূত্রে বলা হচ্ছে, ২০২২ সালে রানিয়া কেন্দ্রে দাঁড়ানো এক রকম নিশ্চিত ছিল বিকাশের। বিজেপির টিকিট না পেলে বিএসপি-র হয়ে। যে কারণে এ দিন বিকাশের মৃত্যুর খবরে অনেকেই কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘উত্তরপ্রদেশের পরবর্তী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর হওয়া হল না বিকাশ দুবের!’

আরও একটি প্রশ্ন। প্রতিবার উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন দলের নিবার্চনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম থাকে ‘জঙ্গলরাজ খতমে’র প্রতিশ্রুতি। সেই জঙ্গলরাজ খতম কবে হবে? নাকি জন্ম নেবে আরও অনেক বিকাশ? ঠিক এই আশঙ্কাই করেছেন বিকাশের হাতে নিহত এক পুলিশকর্মীর বাবা। এ দিন তিনি বলেছেন, ‘‘এক বিকাশ মারা গিয়েছে, ওর জায়গায় দশ বিকাশ উঠে আসবে!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE