গৌরা মোড়। এখানেই নির্যাতিতার গায়ে আগুন লাগানো হয়। নিজস্ব চিত্র
রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ‘জ্বলতি চুড়েইল’! মাঝবয়সি লোকটি আতঙ্কে পালাতে গিয়েছিলেন ঝোপের আড়ালে। রান্নার গ্যাস স্টেশনের লাগোয়া দোকানটা। সেখানেই তাকিয়া পেতে ঘুমিয়েছেন রাতে। ভোর হব হব দেখে উঠে মাঠে গরুদের ছাড়তে গিয়েছেন। পিছন ফিরতেই...! পরনের কাপড়চোপড় জ্বলে গিয়েছে, ছুটে আসছে এক অগ্নিপিণ্ড। বলছে, ‘চিনতে পারছ না? আমি তো ...র মেয়ে!’
গ্যাস স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়েই শুনছি প্রত্যক্ষদর্শীর কথা। গত বৃহস্পতিবার ভোরে চুড়েইল বা ভূতই ভেবেছিলেন পাশের গ্রামের মেয়েকে। ওই অবস্থাতেই যে বলল, ‘শিগগির ১০০ নম্বরে ফোন করে খবর দাও। আমার মোবাইল জ্বলে গিয়েছে।’ দোকানির কাছেও মোবাইল ছিল না। পাশের দোকানে ডাকাডাকি করে মোবাইল নিয়ে মেয়ের মুখের কাছে ধরলেন। মেয়ে নিজে পুলিশকে বলল, ‘আমাকে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে ওরা।’
লখনউ থেকে উন্নাও। ‘জ্বলনেওয়ালি পীড়িতা’র কাহিনি সবার মুখে মুখে। আগুনে পুড়েছেন, আগুন জ্বেলেছেন।
আরও পড়ুন: জামিয়া মিলিয়ায় ছাত্র-বিক্ষোভে লাঠি, আহত ৬৩
মৃতার গ্রাম ভাটানখেড়ায় গত এক সপ্তাহ ধরে পুলিশ, ভিআইপি, মিডিয়ার মেলা। জেলায় পা দেওয়া ইস্তক রাস্তা চেনানোর লোকের অভাব হচ্ছে না। মোরাওয়া থেকে বিহার রোড ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে আসার পরে মাঠের ধারে খাকি উর্দির উপস্থিতিও বুঝিয়ে দেবে ভাটানখেড়া আর দূরে নয়। আরও আধ কিলোমিটার এগিয়ে ডান দিকে ঢুকলে গ্রামের মুখেই নতুন বাড়ি উঠছে ত্রিবেদীদের। এই পরিবারেরই দুই ছেলে শিবম আর শুভম এই মামলায় প্রধান অভিযুক্ত। বছরের পর বছর ধরে এই ত্রিবেদীরাই গ্রামের প্রধান। এমনিতেও এই এলাকায় ব্রাহ্মণেরা সংখ্যায় বেশি। ভাটানখেড়ায় যেমন নিহত মেয়েটির পরিবার গ্রামে একমাত্র লোহার। নিজেরা পরিচয় দেন বিশ্বকর্মা বলে। তাঁরা বাদে এক ঘর ডোম আর বেশ কয়েক ঘর লোধ। ব্রাহ্মণরা পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখেছেন সকলকেই। তাঁদের সব রকম ফাইফরমাস খেটে দিতে হবে মুখ বুজে। নইলেই মারধর, তেমন হলে খুনখারাপিও। প্রেমচন্দের গল্প তেমন পুরনো বলে মনেই হয় না এ সব জায়গায় পা দিলে।
ত্রিবেদীদের বাড়ির সামনে থেকে শুরু করে মেয়ের বাড়ি পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের গাড়ি। ‘পজিশন’ নেওয়া পুলিশ। বাড়ির সামনেই খাটিয়ার উপরে তহসিলদারের অফিসের লোক জন বসে সইসাবুদ করাচ্ছেন, আধার কার্ড সংগ্রহ করছেন। নিহতের পরিবার নতুন বাড়ি পাবে, ক্ষতিপূরণ পাবে। মেয়ের দিদি তিক্ত গলায় বললেন, ‘‘এত কাল ভাঙা বাড়িতে থেকেছি। বাকি জীবনটাও পারতাম। ঘরবাড়ি না দিয়ে বোনের চিকিৎসাটুকু যদি ঠিকমতো করাত পুলিশ!’’ ১০০ নম্বরে ফোন পেয়ে পুলিশ কিন্তু এসেছিল সময় মতোই। সেখান থেকে মেয়েকে নিয়ে প্রথমে যাওয়া হয়েছিল সুমেরপুর, তার পর উন্নাও, তার পর লখনউ। হইচই শুরু হওয়ার পর বিমানে দিল্লি। পরিবারের প্রশ্ন, দগ্ধ শরীরটাকে এত টানাহেঁচড়া না করিয়ে, সোজা লখনউ বা দিল্লি নিয়ে যাওয়া যেত না?
দিদির কথাবার্তায় সপ্রতিভতার ছাপ স্পষ্ট। আসার সময় রাস্তার বাঁ পাশে দেখে এসেছি বেসরকারি কলেজ। সেখান থেকেই স্নাতক হয়েছিলেন পিঠোপিঠি দুই বোন। চাকরির চেষ্টাও করছিলেন। বড় তিন দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুই দাদার এক জন মানসিক ভারসাম্যহীন। অন্য জনই পরিবারের অভিভাবকের মতো। তাঁর লেখাপড়া বেশি দূর হয়নি। গুজরাতের ভাবনগরে মজদুরের কাজ করেন। ভেবেছিলেন, বোনেরাই হয়তো বা সংসারে সুদিন আনবে। বিশেষ করে ছোট বোন। প্রায়ই যে দৃঢ় গলায় বলত, ‘আমাকে ওরা ধর্ষণ করে চুপ করাতে পারবে না। গোটা রাজ্যে এমন হচ্ছে। আমি পুলিশের চাকরি নেব।’ পুড়ে খাক হয়ে বোন এখন মাঠের মধ্যিখানে মাটির নীচে শুয়ে। কান্নার দমকে ভেঙে যাচ্ছে দাদার কথাগুলো। ‘‘পাশে দেখুন, আর একটা সমাধি রয়েছে। ওটা আমাদের ঠাকুরদার। বাবার কাছে শুনেছি, ওঁকেও গুলি করেছিল উঁচু জাত। ওঁর পাশেই শুয়ে থাকুক বোন আমার।’’
পরম্পরা!
খুন করা আর খুন হওয়ার পরম্পরা। এই মেয়ের মৃত্যুর পিছনেও এমন ঘটনার কথা শোনালেন মেয়ের দিদি। তাঁর অভিযোগ, বছর দু’য়েক আগে ত্রিবেদীরা অন্য একটি নিচু জাতের যুবককে গুমখুন করেছিল। পুলিশকে পয়সা দিয়ে সে মামলা ধামাচাপা দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ যেদিন গ্রামে এসেছিল, সে দিন ছোট বোন পুলিশকে বলে আসে, ওরা খুন করেছে! তারই শাস্তি, ধর্ষণ। পুলিশকে বার বার জানিয়ে কাজ হয়নি। মার্চ মাসে আদালতের নির্দেশে তবে এফআইআর হয়।
সারা গ্রাম আগেও ভয়ে চুপ ছিল, আজও তাই। ঠিক চুপও নয়। এলাকা জুড়ে মুখে মুখে, হাতে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘আসল ঘটনা’র হোয়াটসঅ্যাপীয় ব্যাখ্যান। কেউ বলছেন, আত্মহত্যা। কেউ বলছেন, বিয়ের রফা ভেস্তে যাওয়ার প্রতিশোধ, কেউ বলছেন। উকিলের সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ পাতিয়ে ব্ল্যাকমেল করার ছক।
ফাটল ধরা মাটির ঘরদোরে টাকাপয়সা আসার চিহ্ন চোখে পড়ে না যদিও। ‘‘ওরা তো শাসাচ্ছিলই।’’ ধীর গলায় বললেন বাবা। দু’মাস আগে শিবম জামিন পেল। তার পর থেকেই শাসাচ্ছিল। ঘটনার আগের দিন, বুধবার বাড়িতে ওরা দু’বোনই ছিল একা। ফের এসে শাসিয়ে যায়। বাড়ি ফিরে শুনে মেয়েকে বললাম, চল পুলিশের কাছে যাই। মেয়ে রেগেমেগে বলল, পুলিশের কাছে গিয়ে লাভ হবে না। কাল ভোর হলেই রায়বরেলী কোর্টে যাব। একাই যাব। জিজ্ঞেস করব, ওরা জামিন পেল কেন?’’
ভাটানখেড়া থেকে বেরিয়ে রায়বরেলীর দিকে যেতে হলে পরের গ্রাম গৌরা। একটা সুনসান মোড়। দু’পাশের মাঠের মধ্য দিয়ে পিচ রাস্তা। ওই মোড়েই মেয়ের গায়ে আগুন দেয় ‘ওরা’। সেখান থেকে গ্যাস স্টেশন পর্যন্ত জ্বলতে জ্বলতে দৌড়েছিল মেয়ে। ‘‘বাড়িতে বলে গিয়েছিল, তোমরা তো কিছু করতে পারলে না। পারলে আমিই পারব।’’
দাওয়ার এক ধারে চৌকির উপরে বসে শাক দিয়ে ভাত খাচ্ছেন বৃদ্ধ। অন্য ধারে মাটিতে রাখা শিল-নোড়ায় সদ্য বাটা সেই শাকের আস্তর।
অপ্রবাসে, অঋণের শাকান্নে এত খানি হাহাকার মাখা থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy