ছাতার আশ্রয়ে। সংসদের দরজায় ধর্না তৃণমূল সাংসদদের। মঙ্গলবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
কলকাতার পথে কাল তাঁর মিছিলে প্ল্যাকার্ড-আপ্রনে স্লোগান ছিল, ‘আমরা সবাই চোর আমাদের গ্রেফতার কর’। তাঁরই ছকে দেওয়া আন্দোলন করতে নেমে সংসদের ভিতরে-বাইরে কালো ছাতার তলায় দেখা দিলেন তৃণমূলের সাংসদরা!
সারদা থেকে খাগড়াগড় একের পর এক কাণ্ড ঘিরে যতই অস্বস্তি বাড়ছে, ততই হুঙ্কারে, ভাষার ব্যবহারে, আন্দোলনের চমকে রং চড়াচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই পথে হেঁটেই আজ সংসদে তাঁদের আন্দোলনকে কালোয় মুড়ে দিলেন তৃণমূল নেত্রী।
সকাল দশটা। জল নেই, ঝড় নেই, এমনকী কড়া রোদ্দুরও নেই। কুয়াশাভরা শীতের সকালে সংসদে ঢোকার মূল সিঁড়ি তবু কালো ছাতায় ছয়লাপ! তৃণমূলের যুক্তি, কথা দিয়েও কেন ১০০ দিনের মধ্যে বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা ফেরাতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী? তাই কালো ছাতা। আরও আছে। বিজেপিকে কালো তালিকাভুক্ত করার দাবিতে তৃণমূল সরব হয়েছিল আগেই। তৃণমূলের এই ‘ছাতা-আন্দোলন’ সে কারণেও। জানাচ্ছেন দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন।
পরে অধিবেশন শুরু হলে লোকসভাতেও তাঁরা ওয়েলে আসেন হাতে খোলা ছাতা নিয়েই। মুখের স্লোগান ছাতাতেও লেখা। সবুজ কালিতে। ‘কালা ধন ওয়াপস লাও।’
এটা অভিনব, মানছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও। অতীতে বহু রকম বিক্ষোভ-স্লোগানে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে সংসদের ভিতরে ও বাইরে। পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ার পর অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো নেতা সংসদে এসেছিলেন গরুর গাড়িতে। পেঁয়াজের দাম বাড়ার প্রতিবাদে সাংসদদের পেঁয়াজের মালা পরে আসতেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু সংসদে ছাতার আমদানি এই প্রথম।
দলীয় সূত্রের খবর, গোটাটাই ছকে দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। গত সপ্তাহে দলীয় কর্মিসভায় মমতা নির্দেশ দেন, কালো ছাতা খুলেই কালো টাকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে। ছাতা জোগাড়ের দায়িত্ব পড়ে রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও লোকসভার সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের উপরে। গত কাল সন্ধেতেই বেশির ভাগ সাংসদ দিল্লি পৌঁছেছেন। সন্ধেতেই তড়িঘড়ি শুরু হয় ছাতা জোগাড়ের পর্ব। ডেরেক চাঁদনি মার্কেট থেকে কিনে আনেন খান পনেরো ছাতা। তাঁর নির্দেশ মতো বাকি সাংসদরা যে যার বাড়ি থেকে কাকলিকে দিয়ে আসেন ছাতা। চব্বিশটি ছাতায় স্লোগান লেখা হয়। বারোটি হাতে নিয়ে ধর্নায় বসেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, রত্না দে নাগ, সুলতান আহমেদ, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেকরা। বারোটি থাকে ‘ব্যাক আপ’ হিসেবে।
সিঁড়িতে ধর্না-পর্ব চলে কিছু ক্ষণ। এর পরে লোকসভায় প্রশ্নোত্তর পর্ব চলার সময়েও ওয়েলে গিয়ে ছাতা মাথায় স্লোগান দিতে থাকেন তৃণমূল সদস্যরা। কিছু ক্ষণ পরে স্পিকার সুমিত্রা মহাজন বলেন, “সাংসদের কাছে আমার অনুরোধ, দয়া করে ছাতা বন্ধ করুন। ছাতা নিয়ে অধিবেশনে আসার অনুমতি নেই। দয়া করে আপনারা নিত্য-নতুন পন্থা বাছবেন না।” স্পিকারের অনুরোধে কান না দিয়েই চলতে থাকে ছাতা-আন্দোলন। সুলতান আহমেদ তো বনবন করে ঘোরাতে থাকেন ছাতা!
তবে সব সাংসদ ওয়েলে এলেও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এক জনই ছিলেন ব্যতিক্রম! তাপস পাল। গোটা সময়টা নিজের আসনে শান্ত ভাবে বসে ছিলেন তিনি। দেননি স্লোগানও। এমনকী, সকালের ধর্নায় শতাব্দী রায়, মুনমুন সেন, দেব-সহ প্রায় সব সাংসদ হাজির হলেও, যাননি চন্দননগরের এই অভিনেতা তথা কৃষ্ণনগরের সাংসদ। লোকসভা যখন স্লোগানে উত্তাল, তারই মধ্যে নিঃশব্দে সংসদ থেকে বেরিয়ে যান তাপস।
আন্দোলনের এত পথ থাকতে হঠাৎ ছাতা কেন? এর ব্যাখ্যা দিতে ডেরেক বলেন, “ছাতার রং সাধারণ ভাবে কালো। আমরা কালো টাকা ফিরিয়ে আনার দাবিতেই সরব হয়েছি। আমরা আগেও বলেছি, বিজেপিকে ব্ল্যাক লিস্টেড করার কথা। গোটা বিষয়টিকেই তাই একসূত্রে গাঁথার পরিকল্পনা করেছেন দলনেত্রী। আমরা একটা সর্বাত্মক কালো বার্তা দিতে চেয়েছিলাম।”
রাজনৈতিক সূত্রের খবর, সংসদ প্রথম বার মুলতুবি হওয়ার পর, লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে স্পিকার ছাতা প্রদর্শন বন্ধ করার নির্দেশ দেন। নয়তো, ছাতাধারীদের সাসপেন্ড করা হবে। এর পর তৃণমূল সাংসদরা ওয়েলে গিয়ে স্লোগান দিলেও ছাতা রাখেননি সঙ্গে। বিকেলে তৃণমূল-সহ সমস্ত বিরোধীই কক্ষত্যাগ করেন। সাধারণ ভাবে সংসদ চত্বরে ধর্নার রেওয়াজ হল গাঁধী মূর্তির পাদদেশে। মূল গেটের সিঁড়ির কাছে, যেখানে সাংসদদের গাড়ি এসে থামে, সেখানে ধর্না বড় একটা হয় না। ছাতার অভিনবত্বে শুধু নয়, এ ব্যাপারেও তৃণমূলের আন্দোলনে যেন ছক ভাঙার চেষ্টা। সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব গাড়ি থেকে নেমেই এই ধর্না দেখে দাঁড়িয়ে যান। তাঁকে হাত ধরে নিয়ে আসেন সুলতান আহমেদ, ইদ্রিস আলি। ইদ্রিস বলেন, “আপনিও এই ধর্নায় আমাদের সমর্থন করুন।” মিনিটখানেক সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলে ভিতরে ঢুকে যান মুলায়ম। পরে জেডি(ইউ)-এর কে সি ত্যাগী, শরদ যাদব তৃণমূল সাংসদদের পাশে গিয়ে বসেন। লোকসভার ওয়েলেও কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, জেডি(ইউ)-সহ বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা তৃণমূলের সঙ্গে কালো টাকা ফিরিয়ে আনার দাবিতে গলা মেলান। পরে একত্রে কক্ষত্যাগও করেন।
সরকারের তরফে বেঙ্কাইয়া নায়ডু বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও আলোচনার ধার দিয়েও যায়নি তৃণমূল। পরে মুকুল রায় বলেন, “সব দলই যখন বিরোধিতা করছে, আমরা কাল সব দলের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ করব।” অন্য বিরোধী দল তাঁদের স্বার্থ বুঝে পাশে থাকলেও, মূল প্রশ্ন দু’টি। এক, কাল কী করবে মমতার দল? সংসদ কি ঠিক মতো চলতে দেওয়া হবে? দুই, বিজেপি-বিরোধিতায় সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার এই চেষ্টা কি দলের অস্বস্তি ঢাকবে? দলের দুই সাংসদ ইতিমধ্যেই হাজতে। বিতর্ক কম নয় ছাতা-আন্দোলনে সামিল হওয়া কিছু মুখ নিয়েও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy