পাকিস্তানে এই মুহূর্তে অনেক রকমের বাগাড়ম্বর। রাষ্ট্রপতির পুত্র তথা পাকিস্তান পিপল্স পার্টির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জ়ারদারি থেকে উপপ্রধানমন্ত্রী ইশাক দার, প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজ়া আসিফ থেকে রেলমন্ত্রী হানিফ আব্বাসি— প্রত্যেকে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। রক্ত-সিন্ধু বইয়ে দেওয়ার কথা বলছেন। ১৩০টি পরমাণু বোমা ভারতের দিকে তাক করে রাখা বলে মন্তব্য করছেন।
কিন্তু সে সব তর্জন-গর্জনে খুব একটা চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই তর্জন-গর্জন ছাড়া পাকিস্তানের ওই মন্ত্রীদের এখন অন্য কিছু আর করার নেই। ওঁরা ও সব এখন বলবেন। কার্যক্ষেত্রে কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু চিন্তিত হওয়ার অন্য কারণ রয়েছে। পাকিস্তান এ বারের সংঘাতে এমন এক তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা করছে, যার লক্ষ্য ভারতে অভ্যন্তরীণ সমস্যা তৈরি করা, ভারতের সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা। পাকিস্তানের এই নতুন কৌশলের মোকাবিলা খুব সতর্ক ভাবে করতে হবে ভারতকে।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে যে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে, আগেই লিখেছিলাম, তা হল পাকিস্তান পরিচালিত ‘অপ্রচলিত যুদ্ধে’র আরও একটা নমুনা। কিন্তু পাকিস্তানের সেই চেনা কৌশলও এ বার কিছুটা অচেনা। কারণ, তারা কৌশল বদলেছে। বদলটা ঠিক কোথায়, তা বুঝতে হলে আগের কৌশলটা জানা দরকার।
জু়লফিকর আলি ভুট্টো ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভাষণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান এক হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চালাবে।’’ যুদ্ধ তিনি চালিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় কোনও যুদ্ধে পাকিস্তানের জয় দেখে যেতে পারেননি। বরং ১৯৭১ সালে নিজের দেশকে দু’টুকরো হয়ে যেতে দেখেছেন। তাই ভুট্টোকে সরিয়ে সেনাপ্রধান জ়িয়া উল হক যখন পাকিস্তানের মসনদ দখল করলেন, তখন তিনি ভুট্টোর ‘সমর তত্ত্ব’ সামান্য বদলে নিলেন। বললেন, ‘‘উই উইল ব্লিড ইন্ডিয়া উইথ আ থাউজ়্যান্ড কাটস।’’ অর্থাৎ ‘‘আমরা ভারতকে রক্তাক্ত করব এক হাজার বার ক্ষতবিক্ষত করে।’’ সেই থেকেই ভারতকে ‘ক্ষতবিক্ষত’ করার চেষ্টা পাকিস্তান চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রথম পাকিস্তান এবং তার আশ্রিত লশকর-এ-ত্যায়বা হামলা চালিয়েও তার দায় অস্বীকার করছে।
পহেলগাঁওয়ে যে জঙ্গি সংগঠন হামলা চালিয়েছে, সেই টিআরএফ (দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট) আসলে ছদ্মবেশী লশকর। যেহেতু লশকর সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ একটি সংগঠন, তাই নিজেদের মাটি ব্যবহার করে প্রকাশ্যে লশকরকে কাজ করতে দেওয়া পাকিস্তানের পক্ষে কঠিন। কারণ, সে ক্ষেত্রে তাদের নানা রকম আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে। তাই লশকর বেনামে বিভিন্ন শাখা সংগঠন তৈরি করে রেখেছে। টিআরএফ তেমনই এক সংগঠন। এর আগেও জম্মু-কাশ্মীরে একাধিক হামলা টিআরএফ চালিয়েছে। সে সবের দায়ও স্বীকার করেছে। পহেলগাঁও হামলার দায়ও তারা স্বীকার করেই নিয়েছিল। কিন্তু পরে আবার বিবৃতি দিয়ে সে দায় অস্বীকার করল। এই অস্বীকার করার ঘটনাটাই ‘অন্য রকম’। এখানেই পাকিস্তানের কৌশল বদলের ইঙ্গিত। পাকিস্তান আসলে ভারতবাসীদের একাংশের মনে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দিতে চাইছে।
আরও পড়ুন:
পাকিস্তানের এক প্রাক্তন মন্ত্রী সে দেশের নিউজ চ্যানেলে বসে বলছেন, ভারতের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকে রয়েছেন। কারা ‘সহানুভূতিশীল’, সে সব নামও ওই পাক রাজনীতিকের মুখে শোনা গিয়েছে। সে তালিকায় মোদী সরকারের বিরোধী শিবিরে থাকা লেখিকা, রাজনীতিক এবং একাধিক রাজনৈতিক দলের নাম রয়েছে। প্রথমত, পাকিস্তান চায় ভারতের এই অংশকে কাজে লাগিয়ে ভারত সরকারকে দুর্বল করতে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান যেহেতু মনে করে, ভারতে পাকিস্তানের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ লোকজনের সংখ্যা নেহাত কম নয়, সেহেতু পাকিস্তান এখন সেই অংশের মধ্যে ভারত সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে একটা সংশয় তৈরি করতে চায়। পহেলগাঁওয়ে হামলা সত্যিই টিআরএফ তথা লশকর করেছে কি না, পাকিস্তান সে বিষয়েই সন্দেহ তৈরি করে দিতে চাইছে। সেই লক্ষ্যেই প্রথমে হামলার দায় নিয়েও পরে তা ঝেড়ে ফেলে টিআরএফ বলছে, ভারতীয় এজেন্সিগুলি কোনও কৌশলে তাদের ওয়েবসাইটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ওই দায় স্বীকারের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল।
সুতরাং, ভারতকে এ বারের লড়াই আরও অনেক সতর্ক হয়ে লড়তে হবে। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য যাতে সফল না হয়, দেশের মধ্যে যাতে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি না হয়, সে কথা মাথায় রেখে ভারতকে এগোতে হবে।
যে পর্যায়ের সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে, তাকে লঘু করে দেখার কোনও প্রশ্ন নেই। উপযুক্ত মাত্রাতেই জবাব দিতে হবে। উপযুক্ত মাত্রা বলতে কী, তা আগের দু’টি বড় হামলার প্রত্যুত্তরের ইতিহাস দেখলে কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে।
২০১৬ সালে উরিতে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়ে ভারতীয় বাহিনীর ১৯ জনের প্রাণ নিয়েছিল পাকিস্তান। তার জবাবে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে এক থেকে দেড় কিলোমিটার ভিতরে গিয়ে পাকিস্তানের অনেকগুলি জঙ্গি ‘লঞ্চ প্যাড’ ভারত ধ্বংস করে এসেছিল। ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় যে নাশকতা হয়, তাতে ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান শহিদ হন। তার প্রত্যাঘাত আরও বড় মাত্রায় হয়েছিল। বালাকোটে বিমানহানা করে ভারত জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছিল। সেই প্রশিক্ষণ শিবির পাকিস্তানের আরও অনেকটা ভিতরে ছিল। এ বার পাকিস্তানি জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এবং নিরীহ পর্যটকদের উপর। বিনা প্ররোচনায় এবং ঠান্ডা মাথায় ২৬ জন সাধারণ নাগরিককে গুলি করে হত্যা করেছে তারা। এর জবাব যে মাত্রায় দেওয়া উচিত, সেই মাত্রাতেই দেওয়া হবে। কিন্তু আরও অনেকগুলি বিষয়ের দিকে খেয়াল রেখে ভারতকে এগোতে হবে।
আরও পড়ুন:
অনেকে পাকিস্তানের পরমাণু হুমকি শুনে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। পাকিস্তানের এই সব হুমকিতে উদ্বিগ্ন হওয়া অপ্রয়োজনীয়। ভারতকে পরমাণু অস্ত্রের জুজু পাকিস্তান বহু বার দেখিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের নেতা-মন্ত্রীরা মুখে যা-ই বলুন, তাঁরাও জানেন কোনটা সম্ভব আর কোনটা নয়। পরমাণু যুদ্ধ সত্যিই হলে পাকিস্তানের জন্য তার ফলাফল কী হতে পারে, তা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রকদের অজানা নয়। ভারত সরকার বা ভারতের সশস্ত্র বাহিনী ওই সব হুমকি নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন নয়। কিন্তু ভারতকে সতর্ক হতে হবে পাকিস্তানের বদলে যাওয়া কৌশলের কথা মাথায় রেখে। যুদ্ধ এখন শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই। যুদ্ধ শুধু কোনও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ভূখণ্ডে হয় না। যে কোনও যুদ্ধ এ যুগে বিশ্বব্যাপী প্রচার-যুদ্ধের রূপ নিয়ে নেয়। সমাজমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে বা জনমানসে অন্য কোনও ভাবে প্রভাব তৈরি করে পাকিস্তান এ বার একটা সমান্তরাল যুদ্ধ লড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। ভারতকে সেই যুদ্ধের কথাও খেয়াল রাখতে হবে।
পাকিস্তানের সেনা-নেতৃত্ব সব সময় তাঁদের পছন্দের রাজনীতিকদের ইসলামাবাদের মসনদে দেখতে চান। বিরোধী শিবিরকে পাকিস্তানের সেনা বরাবর দমিয়ে রাখতে পছন্দ করে। এবং সে ভাবেই বরাবর পাকিস্তানের রাজনীতি চলে এসেছে। কিন্তু এই প্রথম বার পাকিস্তানে তার ব্যতিক্রম ঘটছে। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা বিরোধী দল পিটিআইয়ের নেতা ইমরান খানকে জেলে ভরে রেখেও জেনারেল মুনির তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারছেন না। ইমরানের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না পাক সেনা। চিনও জেনারেল মুনিরের ভূমিকায় খুশি নয়। কারণ, পাকিস্তানের মাটিতে মাঝেমধ্যেই যে সব সন্ত্রাসবাদী হামলা হচ্ছে, তাতে পাকিস্তানে নানা প্রকল্পে কর্মরত চিনা নাগরিকদের প্রাণও যাচ্ছে। সুতরাং জেনারেল মুনিরের নেতৃত্বাধীন বাহিনী যে চিনের স্বার্থও রক্ষা করতে পারবে না, তা বেজিং বুঝে গিয়েছে। ঘরে-বাইরে চাপের মুখে থাকা জেনারেল মুনির রাতারাতি এই পরিস্থিতি বদলে গোটা পাকিস্তানের জনমতকে নিজের দিকে নিতে চান। তার জন্য সবচেয়ে সহজ পথ ভারতকে রক্তাক্ত করা। নতুন রণকৌশল সাজিয়ে সেই লড়াই লড়তে চাইছে পাকিস্তান। নয়াদিল্লিকে এমন কৌশল নিতে হবে, যাতে ভারতের অন্দরে সন্দেহের বাতাবরণও পাকিস্তান তৈরি করতে না পারে। নিজের দেশের জনমতকেও জেনারেল মুনির নিজের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারেন।
(লেখক দেশের প্রাক্তন উপ-সেনাপ্রধান। বর্তমানে দেশের ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডে’র সদস্য। ২০১৪-২০১৫ সালে কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর ১৫ কোরের কম্যান্ডার ছিলেন। নিবন্ধটি তাঁর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)
- ২০১৬ সালে উরিতে জঙ্গিহানা। জবাবে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় জঙ্গিহানা। জবাবে ভারতের এয়ার স্ট্রাইক। ২০২৫ সালে পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহানার জবাব আগের আঘাতগুলির চেয়েও তীব্র হবে। আনন্দবাজার ডট কমে এই কথাই লিখেছিলেন ভারতের অবসরপ্রাপ্ত উপ-সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুব্রত সাহা।
- ভারত এবার জবাব দিল ‘প্রিসিশন স্ট্রাইক’ করে। পাকিস্তানের ন’টি জায়গায় একসঙ্গে আঘাত হানল ভারত। তার মধ্যে সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার ভিতরে থাকা এলাকাও রয়েছে। পাকিস্তানে জঙ্গি পরিকাঠামো ধ্বংস করতে ভারতের এই রকম আঘাত বেনজির। এর ফলে পাকিস্তানের বিপদ আরও বাড়ল বলে দাবি করছেন ভারতের প্রাক্তন উপ-সেনাপ্রধান।
-
চিনকে ডেকে এনে শিলিগুড়ি করিডরের গায়ে বিমানঘাঁটি তৈরি করতে চাইছেন ইউনূস, সংঘাত তৈরি হলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে
-
তিনটে ‘মিথ’ ভেঙে দিল ভারত, বিশ্বের সামনে চিনা অস্ত্রাগারের দুর্বলতাও প্রকট, দিল্লির নতুন ‘সমরতত্ত্ব’ বদলে দেবে ছবি
-
‘সিঁদুরের দাগ’ আর উঠছে না! দিশাহারা পাকিস্তান তাই বেপরোয়া হয়ে ভারতের সীমান্তে জনবসতিতে গোলা ছুড়ছে
-
কাশ্মীরে খুব বড় মাস্টারমাইন্ড সক্রিয় হয়েছে, নিঃশব্দে কমানো হয়েছে শিয়া-সুন্নি দূরত্ব, নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ নেই উপত্যকায়
-
জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকতে চাইছে চিন, ইতিহাস বলছে বাড়াতে চাইছে সীমানাও, শিমলা চুক্তি অগ্রাহ্য করার পাক হুমকি সেই লক্ষ্যেই