মোদী ক্ষমা চেয়ে কৃষকদের দাবি যে দিন মেনে নিলেন, তার ঠিক ১৮ মাস আগে এই সিঙ্ঘু সীমানায় চোখের সামনে গড়ে উঠেছিল এক জনপদ। ছবি রয়টার্স।
গত ১৮ মাস ওই তক্তপোশই ছিল আন্দোলন। বিদ্রোহের নিশান। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর তাদের জিরোনোর সময় হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমা চেয়ে কৃষকদের দাবি যেদিন মেনে নিলেন, তার ঠিক ১৮ মাস আগে এই সিঙ্ঘু সীমানায় চোখের সামনে গড়ে উঠেছিল কার্যত এক জনপদ। কুয়াশা-সকালে ট্রলির পর্দা সরিয়ে গ্লাসভর্তি মহিষের দুধ আগন্তুকের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন পাঞ্জাবি আম্মা— ‘‘পি লে বেটা। ফির কাম করনা।’’
সারা রাত ট্রলিতে ঘুমিয়ে আমি তখন প্রথম দিনের কৃষক আন্দোলনের কপি ফাইল করছি। প্রথম প্যারাগ্রাফটা এখনও মনে আছে— ‘আন্দোলন নয়, এ এক কার্নিভাল। এখানে রাজনীতির ঝান্ডা নেই। রাজনীতিবিদদের ছবি নেই। দলতন্ত্রের শৃঙ্খলা নেই। স্বতঃস্ফূর্ত লড়াই হাইওয়ের উপর ঝুলনের মতো গ্রাম সাজিয়ে ফেলেছে। পঞ্জাব এবং হরিয়ানার গ্রামে পাশাপাশি ঠিকানার মানুষরা, এখন পাশাপাশি ট্রলি-যাপনে ব্যস্ত।’
১৮ মাস আগের সেই কপিতে সাংবাদিকতার শর্ত মেনে ‘পালানোর পথ’ও তৈরি করে রাখা ছিল একেবারে শেষ লাইনে। মূলস্রোতের রাজনীতি-বর্জিত এই আন্দোলন কতদিন টিকবে, ‘সিঙ্ঘু ট্যুরিজমে’ যাওয়া প্রায় সমস্ত সাংবাদিক বন্ধুর বুম এবং নোটবুকেই সে প্রশ্ন ধরা ছিল।
ধরা তো থাকবেই। এর আগে আরেক আম্মার সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছিল দিল্লি-নয়ডা হাইওয়ের উপর। পরবর্তীকালে বিদেশি সাময়িকীতে যাঁর ছবি ছাপা হয়েছিল সিএএ বিরোধী আন্দোলনের মুখ হিসেবে। সেই প্রথম দিল্লি দেখেছিল হাজার হাজার মুসলিম মহিলার রাস্তার উপর রাতযাপন। একদিন নয়, দিনের পর দিন। রাজনীতির কারবারিরা তখন নিয়মিত ভ্রমণে যাচ্ছেন শাহিনবাগ। যাচ্ছেন, তবে ভিড়তে পারছেন না। মঞ্চে তাঁদের ডাকা হচ্ছে বটে, কিন্তু আন্দোলনের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
দিল্লি দাঙ্গার আগুনও শাহিনবাগকে তুলতে পারেনি। কিন্তু করোনা পেরেছিল। মাসকয়েকের আন্দোলন ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ফিরতে পারেনি। সংসদে সিএএ নিয়ে আর কোনও আলোচনা হয়নি।
কৃষক আন্দোলনও নিশ্চয় কালের সেই প্রথাই অনুসরণ করবে? লালকেল্লার ঘটনার পর দিল্লি প্রেস ক্লাবে এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক টেবিলে গ্লাস ঠুকে কৃষক আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা করতে গিয়ে নিজেই নিজেকে রক্তাক্ত করেছিলেন মনে পড়ে। মনে পড়ে এডিটোরিয়াল মিটিংয়ে কৃষক আন্দোলন নিয়ে কথা বলার সময় অগ্রজ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন খবরের গুরুত্ব বোঝার ঐকিক নিয়ম।
অঙ্ক আসলে সিঁড়ি ভাঙার। কার্যত সমস্ত মিডিয়া থেকে কৃষক আন্দোলন যখন ভ্যানিশ, সকলে ধরেই নিয়েছেন সিঙ্ঘু সীমানায় গড়ে ওঠা জনপদে ‘দুর্গাপুজো’ শেষ, এখন কেবল খালি মণ্ডপে ঘটের সামনে প্রদীপ জ্বলছে, ম্যাকলিয়ড গঞ্জে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে পৌঁছেছিলাম। হোটেলের সর্দার ম্যানেজারের সঙ্গে আড্ডা পৌঁছল সিঙ্ঘু। পা’জি জানালেন, প্রতি দেড় মাসে দশদিন সিঙ্ঘু-যাপনের ডিউটির কথা। গ্রামের সকলে— আশি থেকে দশ এভাবেই রোটেশনে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। চাল, গম, দুধ, সব্জিও রোটেশনের নিয়মে পৌঁছচ্ছে সিঙ্ঘুর খোলা লঙ্গরে। অঙ্কের ফলাফল সেদিনও স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন সর্দার— ‘‘হম লেকে রহেঙ্গে...।’’
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের সময় কলকাতা প্রেস ক্লাবে কৃষক আন্দোলনের কিছু প্রতিনিধি হাজির হয়েছিলেন। কলকাতার এক সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভিড় কেমন? তাঁর সহাস্য জবাব ছিল, ‘‘মেরুকরণের বাজারে এ সব আর খাবে না। মানুষের স্মৃতি থেকে কৃষক আন্দোলন মুছতে শুরু করেছে।’’ প্রায় একই কথা বলেছিলেন দিল্লির এক বিজেপি নেতাও। সাংবাদিক বৈঠকে কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘‘রাস্তা বন্ধ। মানুষ কেবল ওই দুর্ভোগের জন্যই এখনও কৃষক আন্দোলন মনে রেখেছে। যারা ওখানে বসে আছেন, তাঁরা আর যা-ই হোক কৃষক নন।’’ তার কিছুদিনের মধ্যেই কংগ্রেসের এক সাংবাদিক বৈঠকেও কৃষক আান্দোলনের প্রসঙ্গ উঠেছিল। নেতা মহাশয় উত্তর দিতে পুরো এক মিনিটও ব্যয় করেননি। দলমতনির্বিশেষে সংসদের অধিবেশনে যোগ দিতে আসা কলকাতার নেতানেত্রীদের কাছেও সিঙ্ঘু ঘুরে আসার বাসনা তখন আর শোনা যাচ্ছে না। সাংবাদিক এবং মূলস্রোতের রাজনীতির কাছে কৃষক আন্দোলন তখন কার্যত মৃত।
এই সেই মৃতপ্রায় জনপদ।
প্রথম দিনের মতোই হুঁকোর তামাক গোল গোল ঘুরছে এর-ওর হাতে। স্বাস্থ্যশিবিরের পাশে দশ ফুট বাই দশ ফুটের মেকশিফট লাইব্রেরির বাইরে পিঠে রোদ নিয়ে ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ছেন বৃদ্ধ সর্দার। লঙ্গরে আটা মাখছেন সেই আম্মা, প্রথম দিন ট্রলির পর্দা সরিয়ে যিনি হাতে দুধের গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছিলেন। নির্দিষ্ট কিছু সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে লেখা পোস্টারটি খানিক ম্লান। গ্রন্থসাহিব সাজানো ট্রলির গুরুদ্বারে ‘জো বোলে সো নিহাল’। ভগৎ সিংহের ছবি মুছছেন এক তরুণী। ইন্টার্নশিপ থেকে সিঙ্ঘুতে ফেরা নিয়ম করে ফেলেছেন গত ১৮ মাসে। দাড়িতে ওয়্যাক্স লাগিয়ে জুতো পালিশ করছেন এক মাল্টি ন্যাশনাল সংস্থার প্রাক্তন জিএম। খানিক দূরে ট্রাক্টরে বাজছে ইয়ো ইয়ো হানি সিংহ।
নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণার পরেও কারও কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। তফাত বলতে কেবল মাঝে মাঝে থালাভর্তি মিঠাই ঘুরছে এদিক সেদিক। বাকি ছবি আরও একটা দিনের মতোই গ্রামীণ। কোলাহলবর্জিত। চাতালে বৈঠক করছেন নেতারা। আশি থেকে দশ যে কোনও প্রশ্নের মুখে একই জবাব দিচ্ছেন— ‘‘আন্দোলনের নেতারা বলবেন। ওঁরা উঠতে বললে সব ফাঁকা করে স্যানিটাইজ করে দিয়ে যাব। শহরের মানুষকে ১৮ মাসের বর্জ্য দেখতে হবে না।’’
ভারত সম্ভবত এই প্রথম একটি আন্দোলন দেখল, যেখানে কোনও মূলস্রোতের রাজনৈতিক দল এসে নেতৃত্ব হাতে নিল না। আসলে নিতে দেওয়া হল না। উল্টে কৃষকদের আন্দোলনের সঙ্গে মিশে গেল তারা। কেউ যুক্ত হল। কেউ বিযুক্ত হল সেই ঝান্ডাহীন আন্দোলন থেকে। কিন্তু সিঙ্ঘু সীমানার কৃষকদের ঠাঁইনাড়া করা গেল না।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার দিনও তাঁবু গুটিয়ে উঠে যাননি আন্দোলনকারীরা। সংসদে কৃষি আইন বাতিল এবং সরকারের লিখিত প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরেই তাঁরা উঠেছেন। বৃহস্পতিবার। ইয়ো ইয়ো হানি সিংহ, গীতাঞ্জলি, ভগত সিংহের ছবি পাশাপাশি নিয়েই গ্রামের পথে পাড়ি জমিয়েছে জাদুবাস্তবের সেই জনপদ। নিস্তরঙ্গ। নির্ঝঞ্ঝাট। পতাকাহীন। স্লোগানহীন। তফাত কেবল একটাই। ট্রাক্টরের ট্রলিতে ১৮ মাসের জয় বোঝাই করে গ্রামে ফিরছেন কৃষকরা। সেখানেই খেতের বিচালি চাপিয়ে দেওয়া হবে, মহিষকে খাওয়ানোর জন্য।
১৮ মাসের জনপদ আবার হাইওয়ের চেহারা নেবে। হাইওয়ে। মহাসড়ক। মুক্তির মহাসড়ক। জয়ের মহাসড়ক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy