আজমল কসাব এবং দেবিকা নটবরলাল রোটাওয়ান। ছবি সংগৃহীত।
নয় বছরের ছোট্ট মেয়েটি সেই রাতে বাবার হাত ধরে স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল পরিবারের অন্যরাও। মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস থেকে ছাড়বে ট্রেন। সেই ট্রেনে চেপে ওরা সবাই যাবে পুণেতে।
বেড়াতে যাওয়ার উচ্ছ্বাস ঘুরপাক খাচ্ছিল শিশুটির মনে। বাবার হাত ধরে স্টেশনেও পৌঁছেছিল ওরা। আচমকাই সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। চোখের সামনে মেয়েটি দেখল একটা লোক আশপাশের মানুষগুলির উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিল মেয়েটি। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি এসে লাগল ছোট্ট মেয়েটার পায়ে। আর্তনাদ করে উঠল সে। তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। কিছু ক্ষণ পর রক্তাক্ত অবস্থায় ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। ছয়-ছয়টি অস্ত্রোপচার। কিন্তু বেঁচে গেল মেয়েটি।
২৬/১১, ২০০৮। সেই রাতের ভয়ঙ্কর ঘটনার চোদ্দো বছর পর, দেবিকা নটবরলাল রোটাওয়ান এখন মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কমিটির প্রতিনিধিদের দেবিকা আজ জানাল, ওই ঘটনার পর মুম্বই পুলিশের থেকে তাঁর বাড়িতে টেলিফোন এসেছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল, জঙ্গিদের শনাক্ত করতে দেবিকা রাজি আছে কি না । ভয় পায়নি সে। আজমল কসাবের মতো জঙ্গিদের শনাক্ত করেছে। মুম্বইয়ে আজ থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কমিটির বৈঠক শুরু হয়েছে। দু’দিনের বৈঠকে যোগ দিতে এসেছেন কমিটির সদস্যরা। তাঁদের উদ্দেশে মুম্বইয়ের যুবতী জানিয়ে দিয়েছে, সন্ত্রাসের মূল চক্রীদের শেষ করতে ব্যবস্থা নিতেই হবে। আর তিনি ব্যক্তিগত ভাবে স্বপ্ন দেখছেন আইএএস হওয়ার, যাতে ভারতের প্রশাসনের ভিতরে থেকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে পারেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জের কমিটির বৈঠকটিও বসেছে সেই তাজমহল প্যালেস হোটেলে, যেখানে চার জন জঙ্গির এলোপাথাড়ি গুলি ও বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল দেশি-বিদেশি অসংখ্য নাগরিকের। বৈঠকের শুরুতে মুম্বই হামলায় বেঁচে যাওয়া মানুষজনের বক্তব্য আর সেই দিনের ফুটেজ-সহ একটি ভিডিয়ো প্রতিনিধিদের দেখানোর পরেই নিজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শোনান হোটেলের সেই সময়ের জেনারেল ম্যানেজার কে এস কাং। তাঁর কথায়, ‘‘২০০৮-এর ২৬ নভেম্বরের সেই সন্ধেতে আমাদের হোটেলে দু’হাজার জন অতিথি। দেশ-বিদেশ থেকে মুম্বইয়ে এসেছেন তাঁরা। আচমকাই হোটেলে ঢুকে পড়ল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চার জঙ্গি। সেই হামলায় কিচেন, রেস্তরাঁ, করিডরে দাঁড়িয়ে প্রাণ দিয়েছেন হোটেলের কর্মীরা। কিন্তু ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কেউ। জীবন বিপন্ন করে অতিথিদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। দুনিয়ার সামনে দেখিয়ে দিয়েছেন, ‘অতিথিদেবো ভব’ শুধু স্লোগান নয়। কাজের মধ্যে দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন তাজ হোটেলের কর্মীরা।’’
তাজ হোটেলে হামলার পর কতটা প্রতিরোধের মধ্যে পড়তে হয়েছিল জঙ্গিদের, সেকথা উঠে এসেছে আজকের বৈঠকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের কমিটির সদস্যদের সেই রাতের কথা শুনিয়েছেন কাং যেখানে জঙ্গিদের বুলেটের সামনে মানববন্ধন করে দাঁড়িয়েছেন কর্মীরা। আর মুম্বই পুলিশের সেই গুটিকতক কর্মী, এনএসজি এসে পৌঁছনোর আগে যাঁরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সশস্ত্র জঙ্গিদের সামনে।
ভারত যে সন্ত্রাসবাদের শিকার, আর তা যে সীমান্ত পেরিয়ে আসছে, সেকথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেই রাষ্ট্রপুঞ্জের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কমিটির বৈঠকটি মুম্বইয়ে করানোর পরিকল্পনা মোদী সরকারের। তবে বৈঠকের শুরুতেই রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিনিধিদের সামনে ভারতের ক্ষোভের কথা জানিয়ে দিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ২৬/১১-র হামলায় মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদেশমন্ত্রী বলেন, ‘‘চারদিন ধরে চলা হামলায় ১৪০ জন ভারতীয়, ২৩টি দেশের আরও ২৬ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন। সীমান্ত পেরিয়ে আসা জঙ্গিরা ওই চার দিন ধরে গোটা মুম্বইয়ের দখল নিতে চেয়েছিল। কিন্তু হামলার চক্রীরা এখনও হাতের বাইরে। তাদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি।’’
রাষ্ট্রপুঞ্জের কমিটির প্রতিনিধিদের জয়শঙ্কর আজ শুনিয়ে দিয়েছেন— ‘‘কখনও কখনও রাজনৈতিক ভাবনাকে প্রধান্য দিতে গিয়ে সন্ত্রাসের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মঞ্চ পদক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা খুবই দুর্ভাগ্যের।’’ বিদেশমন্ত্রীর এই সমালোচনা বা দেবিকাদের অভিজ্ঞতা শোনার পরে মুম্বই হামলার চক্রীদের বিরুদ্ধে কমিটি কী পদক্ষেপ করে, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy