বেঙ্গালুরুর বৈঠকে কংগ্রেসনেত্রী সনিয়া গান্ধীর পাশে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার। ছবি: পিটিআই।
বিজেপি বিরোধী জোটে কোনও বিভেদ বা বিভাজন চাইছেন না কংগ্রেস হাইকমান্ড। তাই বেঙ্গালুরুতে বিরোধী দলগুলির সম্মেলনে কংগ্রেসের তরফে কাউকে বিরোধী জোটের চেয়ারপার্সন বা আহ্বায়ক পদে বসানোর দাবি তোলা হবে না। এই বিরোধী জোটের নাম যদি ইউপিএ-র বদলে অন্য কিছু রাখা হয়, তাতেও সনিয়া-রাহুল গান্ধীর আপত্তি নেই। কংগ্রেস সূত্রের বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধী শিবিরের কাউকে খাড়া না করে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটকে ‘মোদী বনাম আমজনতা’-র লড়াই হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হবে।
আর আজ সন্ধ্যায় যে নৈশভোজ-বৈঠকের মাধ্যমে বেঙ্গালুরুর বিরোধীদের সম্মেলন শুরু হল, তাতে প্রাথমিক ভাবে ঠিক হল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির মতো সাধারণ মানুষের সমস্যা, গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত, কেন্দ্রীয় সংস্থার অপব্যবহারকে সামনে রেখে লোকসভা ভোটে প্রচার হবে। মণিপুরেও পাঠানো হবে দল। এ দিন গোটা সম্মেলন কক্ষ যে বিরাট ব্যানারে মুড়ে দেওয়া হল, লেখা ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড’! একতাই উত্থানের পথ। রেস কোর্স রোডের যে পাঁচতারা হোটেলে সম্মেলনের আয়োজন, তার বাইরের ব্যানারে বেঙ্গালুরু সম্মেলনে হাজির ২৬টি দলের শীর্ষ নেতানেত্রীদের ছবি। এবং লেখা, ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড’। পরের কথাগুলো উহ্য থাকল—‘ডিভাইডেড উই ফল।’ বিভেদে পতন।
সেটাই যে আসল চিন্তা, তা টের পাওয়া গেল। আজ দুপুর থেকে বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের বিমান একে একে বেঙ্গালুরুর মাটি ছোঁয়ার পরে সকলেই বার্তা দিলেন, তাঁরা এখন যাবতীয় মতভেদ পাশে সরিয়ে রেখে বিজেপির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে লড়তে চাইছেন। তাঁদের বক্তব্য, বিজেপি বিরোধীদের জোট দেখে আতঙ্কিত, তাই এখন এনডিএ-র বৈঠক ডাকতে হচ্ছে।
শরদ পওয়ার বা তাঁর এনসিপি-র কেউ সোমবার নৈশভোজ-বৈঠকে যোগ দেননি। তবে তাঁর শিবির থেকে জানানো হয়েছে, শরদ পওয়ার, সুপ্রিয়া সুলে মঙ্গলবার সকালেই বেঙ্গালুরু পৌঁছবেন। এ নিয়ে যাতে কোনও ভুল বার্তা না যায়, তার জন্য কংগ্রেস বলেছে, মূল বৈঠক মঙ্গলবারই। আম আদমি পার্টিও শরদ পওয়ারের হয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে, নিজের দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক রয়েছে বলেই পওয়ার এ দিন বৈঠকে আসতে পারেননি।
২৩ জুন পটনায় বিরোধীদের প্রথম সম্মেলনের পরে বেঙ্গালুরুতে ১৭-১৮ জুলাই দ্বিতীয় সম্মেলনে দিন ঘোষণার পরেই বিজেপিও ১৮ জুলাইয়েই দিল্লিতে এনডিএ-র বৈঠক ডাকে। মঙ্গলবার বেঙ্গালুরুতে যখন ২৬টি বিরোধী দল বৈঠক করবে, সে সময় দিল্লিতে বিজেপি-সহ ৩৮টি দল এনডিএ-র বৈঠকে যোগ দেবে। এ নিয়ে কটাক্ষ করে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘এক অকেলা সব পে ভারী’-র দাপট কোথায় গেল? মোদী সংসদে দাঁড়িয়ে দাবি করেছিলেন, তিনি একাই না কি সব বিরোধীদের পক্ষে যথেষ্ট! তা হলে এখন কেন এনডিএ-র বৈঠক ডাকতে হচ্ছে? খড়্গে বলেন, “বিরোধী শিবিরের ঐক্য দেখে বিজেপি ঘাবড়ে গিয়েছে। বিভিন্ন ভাঙা দল নিয়ে এনডিএ-র সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। বেঙ্গালুরুতে যাঁরা যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই সংসদেও একসঙ্গে লড়াই করছেন।” কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশও এ দিন বলেছেন, এত দিন বিজেপি এনডিএ নামক জোটের নামই উচ্চারণ করত না। এখন তাতে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা হচ্ছে। বিজেপির ঘুম ছুটে গিয়েছে বলে একই সুরে কটাক্ষ করছেন আম আদমি পার্টির রাঘব চাড্ডা।
এই ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’-য় যাতে কোনও ছন্দপতন না হয়, কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব তা নিশ্চিত করতে চাইছেন। তাই সনিয়া নিজে বেঙ্গালুরুর বিরোধী সম্মেলনে হাজির থাকলেও, বিরোধী জোটের নাম ইউপিএ থাকবে বা তার চেয়ারপার্সন কংগ্রেসের কেউ হবেন, এমন কোনও জোরাজুরি কংগ্রেস করতে চাইছে না। কংগ্রেসের সাংগঠনিক সম্পাদক কে সি বেণুগোপাল বলেন, “ইউপিএ-র শরিক ছাড়াও আরও অনেকে এই বিরোধী জোটে যোগ দিচ্ছেন। মঙ্গলবার বৈঠক হবে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে, এই জোটের নাম ইউপিএ থাকবে না কি অন্য কিছু হবে, নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে কি না।” জোটের নেতা কে, তা নিয়ে প্রশ্নে বেণুগোপালের জবাব, অনেক নেতানেত্রী রয়েছেন। নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অনেকের মধ্যে রয়েছে। সূত্রের বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধী দলের প্রধানমন্ত্রীর মুখ হিসেবে কাউকে তুলে না ধরে ‘মোদী বনাম আমজনতা’-র লড়াই হিসেবে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটকে তুলে ধরার চেষ্টা হবে। বিজেপি বিরোধী বৈঠককে কটাক্ষ করে বলছে, বিরোধী শিবিরের সবাই প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন। বিরোধীদের পাল্টা বক্তব্য, ক্ষমতা নয়, তাঁরা গণতন্ত্র বাঁচাতে, মানুষের সমস্যা নিয়ে লড়ছেন।
কংগ্রেস সূত্রের বক্তব্য, ইউপিএ গঠন, সনিয়া গান্ধীকে তার চেয়ারপার্সন নিয়োগ—সবই হয়েছিল ২০০৪-এর ভোটের পরে। এখনই নতুন জোটের চেয়ারপার্সন নিয়োগের প্রয়োজন না-ও হতে পারে। পটনায় অনেকে নীতীশ কুমারকে জোটের আহ্বায়ক করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে কংগ্রেসের আপত্তি নেই। মঙ্গলবার বৈঠকে দুই থেকে তিনটি ছোট কমিটি তৈরি হতে পারে। নিয়মিত ২৬টি দলের শীর্ষনেতাদের বৈঠক সম্ভব নয় বলে প্রতি দিনের সমন্বয়ের জন্য একটি কমিটি কাজ করবে। রাজ্যস্তরে আসন সমঝোতা নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হতে পারে। সকলেই মানছেন, একটি বৈঠকে সব ফয়সালা হবে না। আরও বৈঠক করতে হবে। বেঙ্গালুরুতে যে সব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, তা নিয়ে পরের বৈঠকে আলোচনা হবে। তবে আজ সন্ধ্যার বৈঠকে যে বিষয়ে সকলেই একমত হলেন, ‘বিরোধীদের জোট’ বলে নয়, নতুন একটি নামে তাঁরা পরিচিত হতে চান। এবং তাতে ‘ইউনাইটেড’ এবং ইন্ডিয়া থাকা প্রয়োজন।
পটনার বৈঠকে ১৫টি দল যোগ দিয়েছিল। বেঙ্গালুরুতে তা বেড়ে ২৬টি হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে পটনায় শুধুমাত্র অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি হাজির ছিল। এ বার তাঁর সঙ্গে আরএলডি-র জয়ন্ত চৌধরি, আপনা দল (কমেরাওয়াড়ী)-ও হাজির। জয়ন্তের বক্তব্য, “আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকবে। কিন্তু মাঝের রাস্তা ঠিক খুঁজে নেব।” এই জোট থেকে দূরত্ব রেখে চলা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের বিআরএস, এইচ ডি দেবগৌড়ার জেডিএস-কে বার্তা দিয়ে কংগ্রেসের বক্তব্য, যাঁরা এখনও ন যযৌ, ন তস্থৌ অবস্থায় রয়েছেন, তাঁদের আর ত্রিশঙ্কু হয়ে থাকার পরিস্থিতি নেই। প্রসঙ্গত, কর্নাটকে সদ্য ক্ষমতায় আসা কংগ্রেসই বেঙ্গালুরুর সম্মেলনের আয়োজকের ভূমিকায়। তাই কংগ্রেসের কারণে কোনও ফাটল না হয়, তা নিয়ে দলের নেতারা বাড়তি সতর্ক। আতিথেয়তার যাতে ত্রুটি না থাকে, তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া, উপমুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার ও বেণুগোপাল সন্ধ্যায় নৈশভোজ-বৈঠকের সময় দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে স্বাগত জানিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy