সুনীল রাস্তোগি
লাল জ্যাকেট আর বিজোড় দিন ছিল তার কাছে পয়া। এক বিশেষ লাল জ্যাকেট চাপিয়েই বিনা বাধায় একের পর এক কুকর্ম করেছে সে। গত ১২ বছরে তার লালসার শিকার হয়েছে শ’পাঁচেক কিশোরী! বাচ্চা মেয়েরা কাকুতি মিনতি করলে আরও বাড়ত তার মজা। শেষ বারেও গায়ে ছিল সেই ‘পয়া’ জ্যাকেট। তবে এ বারে সে দিল্লিতে এসেছিল জোড় সংখ্যার দিনে। ভাগ্য সঙ্গ ছেড়েছে ধর্ষক সুনীল রাস্তোগির। লাল জ্যাকেটের সূত্রেই গ্রেফতার হয়েছে সে।
পুলিশের দাবি, শনিবার রাতে ধরা পড়ার পর কুকীর্তির কথা স্বীকার করে নিয়েছে সুনীল। জানিয়েছে, ১২ বছরে অন্তত পাঁচশো কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে সে। পুলিশ এও মনে করছে, পাঁচ সন্তানের বাবা বছর আটত্রিশের ওই যুবক নিজের দুই মেয়ের দিকেও হাত বাড়িয়েছিল।
আদতে উত্তরপ্রদেশের রামপুরের বাসিন্দা পেশায় দর্জি সুনীল এক সময় থাকত পূর্ব দিল্লির কল্যাণপুরীতে। ২০০৪ সালে এক প্রতিবেশীর মেয়েকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সামাজিক দুর্নামের ভয়ে মেয়েটির পরিবার পুলিশে না যাওয়ায় পার পেয়ে যায় সুনীল। এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ফের আর একটি বাচ্চা মেয়ের শ্লীলতাহানি করে সে। এ বারও পুলিশে যায়নি পরিবার। ফলে ফের বেঁচে যায় সুনীল। তবে পড়শিদের চাপে কল্যাণপুরী ছাড়তে বাধ্য হয় সে। উত্তরপ্রদেশের রুদ্রপুরে চলে যায় সপরিবার।
কিন্তু দিল্লিকে এত সহজে রেহাই দেয়নি সুনীল। শিকারের খোঁজে বার বার ফিরে এসেছে তার পুরনো আস্তানায়। প্রতিবার চেপে বসেছে সেই এক ট্রেন, সম্পর্ক কান্তি এক্সপ্রেসে। গায়ে লাল জ্যাকেট, নীল জিন্স। পুলিশকে সুনীল জানিয়েছে, শুধুমাত্র বিজোড় সংখ্যার তারিখেই ‘অপারেশন’ চালাত সে। মন্ত্র জপতে জপতে নামত ট্রেন থেকে। বিশ্বাস ছিল, সেই মন্ত্র আর লাল জ্যাকেটই বাঁচিয়ে দেবে তাকে। গ্রেফতার হওয়ার পরেও তাই বলেছে, ‘‘ধরা পড়ব ভাবিইনি কোনও দিন।’’
সুনীলের গ্রেফতারিতে ফের উঠে আসছে নিঠারি মামলার স্মৃতি। ২০০৬ সালে নয়ডার কাছে নিঠারি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় অন্তত ২০ জন শিশুর কঙ্কাল। তদন্তে উঠে আসে ব্যবসায়ী মণীন্দ্র সিংহ পান্ধের ও তাঁর পরিচারক সুরেন্দ্র কোলির নাম। খুন করার আগে ওই শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছিল বলে ওই মামলায় অভিযোগ এনেছিল পুলিশ।
প্রশ্ন উঠছে, অপরাধের পর অপরাধ করেও কী ভাবে এত বেপরোয়া ছিল সুনীল রাস্তোগি? পুলিশ মনে করছে, কুকর্ম করেও বার বার ছাড় পেয়ে সাহস বেড়ে গিয়েছিল তার। ২০০৬ সালে উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুরে ছ’মাসের জন্য জেল খাটতে হয় তাকে। কিন্তু সেই এক বারই।
সুনীল স্বীকার করেছে, দিল্লিই ছিল তার প্রিয় জায়গা। ক্যালেন্ডারে দাগানো থাকত বিজোড় সংখ্যার তারিখ। সেই ‘শুভ দিন’ দেখেই দিল্লিতে আসত সে। স্ত্রী জানতেন, ব্যবসার কাজে দিল্লি যাচ্ছে স্বামী। সাত থেকে এগারো— এই ছিল তার পছন্দের বয়স। পকেটে থাকত সব স্কুলের নাম-ঠিকানা। ঠিক বেলা দু’টো থেকে চারটের মধ্যে রাস্তায় নামত সুনীল। সেই সময়েই স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে মেয়েরা। একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কেউ পিছিয়ে পড়লেই এগিয়ে যেত সুনীল। বলত, সে তার বাবার বন্ধু। তাকে জামা ও পোশাক দিতে এসেছে। প্রতি বার প্রত্যেকের জন্য নতুন নতুন জামা বানিয়ে আনত সে। ভুলিয়েভালিয়ে বাচ্চাদের সরিয়ে নিয়ে যেত অন্যত্র। কখনও নিউ অশোক নগরের একটি পরিত্যক্ত সিঁড়ির কোণে। কখনও কোনও ঘুপচি গুদাম বা অন্ধকার গলিতে।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরের পর নড়েচড়ে বসে দিল্লি পুলিশ। কয়েক দিনের ফারাকে নিউ অশোকনগর থানায় দুই কিশোরীর উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ জমা পড়ে। দু’ক্ষেত্রেই নির্যাতনের ধরন এক। এক অভিযুক্তের পোশাকও। লাল জ্যাকেট, নীল জিন্স। দু’জনকেই নতুন জামার লোভ দেখানো হয়। দু’জনই জানায়, ছেড়ে দেওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলে হাসতে থাকে হেনস্থাকারী। ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে কিছু তথ্য হাতে পায় পুলিশ। কিন্তু সুনীলকে ধরার জন্য সে সব যথেষ্ট ছিল না। তখন এলাকার বাসিন্দা, দোকানদার, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা— সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তদন্তকারীরা। তাঁদের থেকেও জানা যায় লাল জ্যাকেট পরা একটি লোকের কথা। তাঁদের দেওয়া বিবরণ এবং দুই কিশোরীর বর্ণনা জুড়ে আঁকানো হয় ছবি। এ বার সেই ছবি দেখিয়ে শুরু হয় তল্লাশি। কিন্তু গোটা পূর্ব দিল্লিতে তল্লাশি চালিয়েও সন্দেহভাজন কাউকে পাওয়া যায়নি সে সময়। এর পর গোটা উত্তর ভারতে গত ১২ বছরের অপরাধ সংক্রান্ত নথি ঘাঁটতে শুরু করে পুলিশ। এক বার জেলে যাওয়ায় পুলিশের খাতায় নাম ছিল সুনীলের। ফটো ও স্কেচ মিলিয়ে তৈরি করা হয় একশো জনের তালিকা। তা থেকে আলাদা করা হয় তিন জনকে। সেই তিন জনের তালিকা থেকেই চিহ্নিত করা হয় সুনীলকে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই তক্কে তক্কে ছিল পুলিশ। এর মধ্যেই তারা খবর পায়, শনিবার অর্থাৎ ১৪ তারিখ দিল্লিতে আসবে সুনীল। তাকে ধরার জাল পাতা হয় তখন। সে রাতে পূর্ব দিল্লির কোন্ডলির গোপন ডেরা থেকে গ্রেফতার করা হয় সুনীলকে। আজ নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী মেনকা গাঁধী জানান, সারা দেশে যৌন হেনস্থার একটি রেকর্ড তৈরির প্রস্তাব বছর দু’য়েক আগেই দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তা আজও হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy