রায় শোনার পর আদালত থেকে বেরোচ্ছেন সলমন। ছবি: এএফপি।
রায় শুনে ডুকরে উঠেছিলেন সে দিন। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছলেন আজও। সাত মাসের ব্যবধানে বদলাল শুধু কান্নার কারণটা!
গত ক’দিন ধরে বম্বে হাইকোর্টের সওয়াল-জবাব যে দিকে এগোচ্ছিল, তাতে বিলক্ষণ আশা দেখছিলেন তাঁর প্রিয়জনেরা। শেষ পর্যন্ত তাঁদের স্বস্তি দিয়েই মামলায় যবনিকা নামল আজ। ২০০২ সালে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চাপা দিয়ে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলায় সলমন খানকে রেহাই দিল বম্বে হাইকোর্ট। আদালতের বক্তব্য, সেই রাতে সলমনের মদ খাওয়া বা গাড়ি চালানো— কোনওটাই অকাট্য ভাবে প্রমাণিত হয়নি। রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি এ আর জোশী বলেছেন, ‘‘শুধুমাত্র সন্দেহই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়।’’ তবে মহারাষ্ট্র সরকার জানিয়েছে, তারা সুপ্রিম কোর্টে যাবে।
অনিচ্ছাকৃত খুন-সহ নয় নয় করে আটটা অভিযোগে মামলা হয়েছিল সলমনের বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগেই দোষী সাব্যস্ত করে গত ৬ মে তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল মুম্বইয়ের নগর দায়রা আদালত। সাজা শুনে সে দিনও কেঁদেছিলেন সলমন। তবে অন্তর্বর্তী জামিনও পেয়েছিলেন। আর তারও দু’দিন পর ফের জামিন পেয়েছিলেন হাইকোর্টে। আজ নিম্ন আদালতের রায় খারিজ করতে গিয়ে সলমনের বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারপতি বলেছেন, অভিযোগ প্রমাণে সরকারি আইনজীবীর ‘ব্যর্থ’। গত বার হাইকোর্টে জামিন পাওয়ার সময়ে পাসপোর্ট থানায় জমা দিতে হয়েছিল সলমনকে। আজ সেই পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিতেও পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি।
আক্ষরিক অর্থেই ‘নিরঙ্কুশ’ জয়। স্বাভাবিক ভাবেই রায় ঘোষণা মাত্র উৎসব শুরু করে দিয়েছেন ‘চুলবুল পাণ্ডের’ ভক্তরা। মুম্বই বিস্ফোরণ মামলায় সঞ্জয় দত্তের বিচারপর্ব বাদ দিলে আর কোনও নায়কের আইনি জটিলতা নিয়ে এত দীর্ঘ টানাপড়েন দেখেনি বলিউড। যার প্রথম দৃশ্যটা ছিল তেরো বছর আগেকার এক গভীর রাতে।
২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। রাত ২টো নাগাদ জুহুর ‘রেন বার’ থেকে বেরিয়ে নিজের সাদা ল্যান্ড ক্রুজারে উঠে রওনা হন সলমন। অভিযোগ, ‘রেন বার’-এ বেশ কয়েক পেগ হোয়াইট রাম খেয়েছিলেন তিনি। গাড়িতে সলমনের সঙ্গে ছিলেন দেহরক্ষী রবীন্দ্র পাটিল, দূর সম্পর্কের আত্মীয় তথা গায়ক কামাল খান। প্রথমে তাঁরা যান জুহুর পাঁচতারা জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট হোটেলে। সেখানে কিছুক্ষণ কাটানোর পর গাড়ি এগোয় বান্দ্রার দিকে। হঠাৎই গাড়ি উঠে যায় ফুটপাথে। সেখানে তখন শুয়ে বেশ কয়েক জন ফুটপাথবাসী। অভিযোগ, সলমনের এসইউভি-র তলায় চাপা পড়ে মারা যান এক জন। জখম হন আরও ৪ জন। ঘটনার রাতেই সলমন গ্রেফতার হন। তবে তিনি জামিনও পেয়ে যান। এর ন’দিন পর নিজেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন সলমন। ১৭ দিন পর ফের জামিন।
মামলা চলতে থাকে। সলমনের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা করে পুলিশ। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪-২ ধারায় সেই মামলা দেওয়া নিয়ে টানাপড়েন চলে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। সর্বোচ্চ আদালত সেই সিদ্ধান্ত ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের উপরে ছেড়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত এই ধারা বজায় থাকে। ইতিমধ্যে আর একটা ঘটনা ঘটে। ঘটনার অন্যতম সাক্ষী, সলমনের দেহরক্ষী রবীন্দ্র পাটিল হঠাৎ উধাও হয়ে যান। বহু দিন পর যখন তাঁর খোঁজ মেলে, তখন তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত। আর বেশিদিন বাঁচেননি পাটিল। আইনজ্ঞদের মতে, পাটিলের মৃত্যুর ফলেই নড়বড়ে হয়ে পড়ে সরকার পক্ষের অবস্থান। কারণ, কামাল খান পাকাপাকি ভাবে বিদেশে থেকে যান। আর সাক্ষী বলতে ছিলেন সলমনের বিশ্বস্ত গাড়িচালক অশোক সিংহ। চলতি মাসের ৭ তারিখ থেকে বম্বে হাইকোর্টে শুরু হওয়ায় রায়দান প্রক্রিয়ায় এঁদের প্রত্যেকের বয়ান ও ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠছিল। আজ ছিল চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পালা।
আজ সলমনকে হাজির থাকতে বলেছিলেন বিচারপতি। সেই নির্দেশ অমান্য করেননি সলমন। একরাশ উদ্বেগ চোখেমুখে নিয়েই দুপুর দেড়টা নাগাদ হাইকোর্টের ৪৩ নম্বর আদালত কক্ষে ঢোকেন। গালভরা দাড়ি, পরনে সাদা-কালো শার্ট, নীল ডেনিম। সঙ্গে দেহরক্ষী শেরা, বোন অলভিরা, ছোট বোন অর্পিতার স্বামী আয়ুষ ও ম্যানেজার। আদালত চত্বরে ভক্তদের ভিড়। বিশাল পুলিশবাহিনীও তাঁদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
তার পর এজলাসে আসেন বিচারপতি জোশী। শুরু হয় রায় ঘোষণা। বিচারপতি জানান, সলমনের বিরুদ্ধে শুধু যে সরকার পক্ষের আইনজীবীর পেশ করা তথ্য-প্রমাণ দুর্বল তা-ই নয়, জখম প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানেও মতবিরোধ রয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানই রেকর্ড করা হয়নি। এমনকী সলমনের প্রয়াত দেহরক্ষীর বয়ান প্রসঙ্গেও বিচারপতি বলেছেন, ‘‘রবীন্দ্র পাটিল একেবারেই নির্ভরযোগ্য সাক্ষী নন। তাঁর দেওয়া তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আবেদনকারীকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।’’ কেন? বিচারপতির বক্তব্য, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বারবার বয়ান বদল করেছিলেন পাটিল। দুর্ঘটনার রাতে যে এফআইআর হয়েছিল, তাতে সলমনের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি পাটিল। অথচ আদালতে পরে দাবি করেন, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন সলমন।
উঠে আসে সলমনের গাড়িচালক অশোক সিংহের কথাও। অশোক মাঝে দাবি করেছিলেন, সলমন নন, ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে স্টিয়ারিং ছিল তাঁরই হাতে। ঘটনার পর পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন তিনি। তবে তাঁর বয়ান রেকর্ড হয়নি। সেই প্রসঙ্গ তুলে বিচারপতি আজ বলেন, ‘‘অশোক গাড়ি চালাচ্ছিলেন কি না তা কামাল খানই বলতে পারতেন। তাঁর বক্তব্যও জানা হয়নি।’’ এমনকী সলমনের মদ খাওয়া নিয়ে সরকার পক্ষের পেশ করা প্রমাণও মানতে চায়নি হাইকোর্ট। বিচারপতি জানিয়ে দেন, বারের যে বিলগুলি পেশ করা হয়েছে, সেগুলি ভুয়ো। বস্তুত, সলমনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে তদন্তের বহু ক্ষেত্রেই তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে ফাঁক থেকে গিয়েছে বলে জানান বিচারপতি। এবং এই সমস্ত কারণেই যে সলমন ‘বেনিফিট অব ডাউট’ পাচ্ছেন, সেটাও স্পষ্ট করে দেন।
রায় শুনে মাথা নিচু করেন সলমন। খানিক পর ছলছলে চোখে হাঁফ ছেড়ে বিচারপতির মুখের দিকে তাকান। বিচারপতি এজলাস ছেড়ে বেরিয়ে যেতে কাঠগড়া থেকে নেমে আসেন। ঘিরে ধরেন পরিজনরা। একগাল হেসে সাংবাদিকদের ‘থাম্বস আপ’ দেখান বোন অলভিরা। তখন দেওয়ালে হেলান দিয়ে আপনমনে গুনগুন করছিলেন সলমন। হঠাৎ আবার জলে ভরে ওঠে চোখ দু’টো। দেহরক্ষী শেরা পাশে এসে দাঁড়ান। নিচু গলায় কী একটা বলেন। মুখ ঘুরিয়ে নেন সলমন। কান্না ঢাকলেন কি?
পরে টুইটারে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, ভক্তদের পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ জানান সলমন। সোশ্যাল মিডিয়া তত ক্ষণে দু’ভাগ। প্রভাবশালী বলেই সলমন ছাড়া পেলেন কি না, সেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন অনেকে। ঘটনা হল, রায় দেওয়ার সময়ে এই প্রসঙ্গটাও ছুঁয়ে যান বিচারপতি জোশী। বলেন, সংবাদমাধ্যমে কোনও ঘটনা বারবার দেখানো হলে তা কার্যত ‘সত্যের’ চেহারা নেয়। একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেন, ‘‘আদালতকে তথ্য-প্রমাণ বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। জনতার চাপের মুখেও তার প্রভাবিত হওয়া চলে না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy