সনিয়া গাঁধী ও রাহুল গাঁধী। —ফাইল চিত্র
কংগ্রেসের সঙ্কট কাটতে পারে, এমন কোনও উপসর্গই দেখা যাচ্ছে না। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার নেতৃত্বে মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেসে বিরাট ভাঙন প্রায় থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়েছে গোটা দলকে। কিন্তু এখানেই যে সঙ্কটের শেষ, দ্রুত ঘর গুছিয়ে কংগ্রেস যে এ বার বাঁচিয়ে নেবে অবশিষ্ট দুর্গটুকু, সে আশাও দেখা যাচ্ছে না। বরং আশঙ্কার মেঘ দেখা যাচ্ছে। সিন্ধিয়ার রাজ্যেরই উত্তর পশ্চিমে সেই মেঘ তৈরি হচ্ছে সচিন পায়লটকে ঘিরে।
বছর দেড়েক আগেও কিন্তু পরিস্থিতিটা এই রকম ছিল না কংগ্রেসের জন্য। বরং কংগ্রেসের পুনরুত্থানের একটা আশা তৈরি হয়েছিল, কর্মী-সমর্থকরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। কারণ বছর দেড়েক আগেই বিজেপির হাত থেকে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ় একসঙ্গে ছিনিয়ে নিয়েছিল কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানে খুব বড় জয় হয়নি। বড় এবং স্পষ্ট জয় শুধু ছত্তীসগঢ়েই হয়েছিল। তবু ওই জয় কংগ্রেসের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ প্রথমত, বহু বছর পরে মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ় বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিতে পেরেছিল কংগ্রেস। দ্বিতীয়ত, লোকসভা নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে হিন্দি বলয়ের বিরাট এলাকায় জয় পাওয়া রাজনৈতিক ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিজেপির আঁতুড়ঘরই ছিনিয়ে নিয়েছিল কংগ্রেস। সুতরাং অনেকেই ভেবেছিলেন যে, বছর পাঁচেক ধরে বিজেপির দাপটে নুয়ে পড়তে থাকা কংগ্রেস এ বার একটু ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু তা হল না। ক্রমশ আরও নুয়ে যেতে থাকল কংগ্রেস।
২০১৮-য় কংগ্রেসের সাফল্যের পরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ফের দেশজোড়া গেরুয়া ঝড় দেখা গেল। ছ’মাস আগেই যে রাজ্যগুলোয় জিতেছিল কংগ্রেস, সেগুলোও গেরুয়া রঙে ঢেকে গেল। কিন্তু লোকসভা আর বিধানসভার ভোট সব সময়ে এক হিসেবে হয় না। সুতরাং লোকসভায় বিজেপি জিতে গেল মানেই মধ্যপ্রদেশে, রাজস্থানে বা ছত্তীসগঢ়ে আবার সবাই বিজেপি হয়ে গেল, এমন ভাবার কোনও কারণ ছিল না। হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যের পাশাপাশি পঞ্জাব, পুদুচেরিও কংগ্রেসের হাতে ছিল। আজ অর্থাৎ ১০ মার্চ ২০২০-তেও রয়েছে। অর্থাৎ অন্তত পাঁচ জন মুখ্যমন্ত্রী দলের ঝুলিতে। মহারাষ্ট্রে জোট সরকারে কংগ্রেস, ঝাড়খন্ডেও জোট সরকারে কংগ্রেস। এ সবের আগে ২০১৭ সালে গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনেও বেশ ভাল ফল হয়েছিল দলের। এ বার হরিয়ানাতেও বিজেপি-কে বড়সড় ধাক্কা দেওয়া গেল। এত কিছু দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন যে, বিজেপির বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার একটা সুযোগ রয়েছে কংগ্রেসের সামনে। সুযোগ সত্যিই কিন্তু ছিল। কংগ্রেস সে সুযোগকে কাজে লাগাতেই পারল না।
আরও পড়ুন: হার্ভার্ডের অর্থনীতির স্নাতক, স্ট্যানফোর্ডের এমবিএ থেকে অন্যতম ধনী মন্ত্রী হন জ্যোতিরাদিত্য
মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের সরকার টিকিয়ে রাখা যে প্রায় অসম্ভব, সে কথা লোকসভার কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরীও মঙ্গলবার স্বীকার করে নিলেন। কিন্তু কংগ্রেস যে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারল না, সে কথা কিন্তু শুধুমাত্র এই মধ্যপ্রদেশের বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে বলছেন না বিশ্লেষকরা। কংগ্রেস নেতৃত্বের সামগ্রিক দিশাহীনতা এবং একটা প্রাচীন ঘরানার রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবণতা দেখেই বলছেন বরং। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঠেকানোর চেষ্টাই যেন করলেন না কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতারা। ফলে মধ্যপ্রদেশ তো গেলই। এ বার রাজস্থানও হাতছাড়া হওয়ার পথে। যে ভাবে মধ্যপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের সঙ্গে বিরোধের জেরে জ্যোতিরাদিত্য বিদ্রোহ করলেন, ঠিক সে ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌতের সঙ্গে তুমুল সঙ্ঘাতের জেরে রাজস্থানে সচিন পায়লটও বিদ্রোহের পথে। পরিস্থিতি এই মুহূর্তে যে রকম, তাতে মনে হচ্ছে সচিন পায়লটের দলত্যাগ এখন সময়ের অপেক্ষা। সে ক্ষেত্রে রাজস্থানের সরকারটাও কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: রাজমাতা থামিয়ে দিয়েছিলেন ইন্দিরা ঝড়, দেউটি নিভিয়ে দিলেন মহারাজা
কংগ্রেসের এই হতশ্রী দশার জন্য কিন্তু বিজেপি-কে দোষ দেওয়া যায় না। বড় দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হয়তো থাকে। কিন্তু সে দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে যাবে কেন যে, প্রতিপক্ষ যখন তখন তার সুযোগ নিতে পারে? বিজেপি-ও তো খুব বড় দল। দ্বন্দ্ব বিজেপির অন্দরেও রয়েছে। কিন্তু বিজেপি-কে তো এ ভাবে ভাঙতে পারে না। দলের সাংগঠনিক কাঠামোর কারানে হোক, সঙ্ঘের অনুশাসনের কারণে হোক, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার কারণে হোক, বিজেপি কিন্তু দলকে মোটের উপরে অটুট রাখতে পারে। কংগ্রেস এত দিনেও যেন সেই বাঁধনটা তৈরি করতেই পারল না।
কংগ্রেসের নেতারা সম্ভবত ভুলে যাচ্ছেন যে, ওঁরা আর আগের মতো অত বড় দলের নেতা নন। এখন যে কংগ্রেসটা রয়েছে, সেটা আগের কংগ্রেসের একটা হালকা ছায়া মাত্র। এখন ঘুরে দাঁড়াতে হলে গোটা দলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপ্রাণ লড়তে হবে। কিন্তু কংগ্রেসের নেতারা সেই পুরনো অভ্যাস থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারছেন না।
একটা সময় ছিল, যখন দেশে কংগ্রেসের সমান প্রভাবশালী দল একটাও ছিল না। তাই সে সময়ে অনেক ক্ষেত্রে শাসকও কংগ্রেস ছিল, বিরোধীও কংগ্রেস ছিল। কোথাও দেখা যাচ্ছে ব্রাহ্মণ আর ঠাকুরদের মধ্যে টানাপড়েন, কোথাও দেখা যাচ্ছে ভূমিহার আর দলিতের মধ্যে টানাপড়েন। কিন্তু সবাই কংগ্রেস। সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তখনকার কংগ্রেস নেতৃত্ব একটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা হয়তো করতেন। সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করতেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রুখতে কোনও কঠোর পদক্ষেপের রাস্তায় হাঁটতেন না।
কিন্তু এখন যে আর সে যুগ নেই, তা কংগ্রেস নেতৃত্ব বুঝতেই পারছেন না। এখন গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব জিইয়ে থাকতে দেওয়া বা সে বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা কংগ্রেসের জন্য বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আরও পডু়ন: পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ? সিন্ধিয়া দিয়ে শুরু, এর পর কি আরও অনেকে
মধ্যপ্রদেশে যা ঘটল, রাজস্থানে যা চলছে, উত্তরাখণ্ডে ক্ষমতায় থাকাকালীন দলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে যে প্রকাশ্য কাদা ছোড়াছুড়ি চলছিল, পঞ্জাবে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে যে অসীম তিক্ততা রয়েছে, সে সব ঠেকানোর কোনও চেষ্টা কি ১০ জনপথের তরফে হয়েছে? কংগ্রেসের নেতাদের এই কোন্দল দেখে মনেই হয় না যে, দেশের জন্য বা নাগরিকদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা তাঁদের রয়েছে। তাঁদের খেয়োখেয়ি দেখে মনে হয়, শুধু নিজেদের স্বার্থে রাজনীতিতে রয়েছেন। নিজেরা কে কী পাবেন, তা নিয়েই কংগ্রেস নেতারা লড়ে যাচ্ছেন সারা বছর— এই রকম একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
মাঝে একটা সময় এসেছিল, যখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটা প্রত্যাখ্যানের হাওয়া তৈরি হয়েছিল। সেই হাওয়াটা কেটে যাচ্ছিল। কংগ্রেসকে আবার দেশের মানুষ গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। কারণ তাঁরা বিজেপির বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছিলেন এবং কংগ্রেসই বিকল্প হতে পারে বলে মনে করছিলেন। কিন্তু সেই নাগরিকদের কংগ্রেস হতাশ করল। বিজেপির বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা দরকার, কংগ্রেস নেতৃত্ব তার ধারেপাশে গেলেন না।
অনেকে বলেন, কংগ্রেসের কোনও নির্দিষ্ট আদর্শ নেই। আদর্শ যে নেই, তা কিন্তু নয়। কংগ্রেসের আদর্শ আসলে ভারতের সংবিধানটার খুব কাছাকাছি। ভারতীয় সংবিধান যে আদর্শের উপরে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে, সেই ধর্মনিরপেক্ষতা, সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, কিছুটা নরমপন্থা, কিছুটা উদারবাদ— এটাই কংগ্রেস। আপাতদৃষ্টিতে অনেক সময়ে মনে হয় যে, কংগ্রেসের ভাবধারার রূপরেখা খুব নির্দিষ্ট নয়। এ সমস্যা আজকের নয়। বহু বছরের। স্বাধীনতার পরে কয়েকটা দশক পর্যন্ত দেশের বিরাট অংশ কংগ্রেসের প্রতি আবেগে আপ্লুত ছিল। কিন্তু ১৯৬০ বা ১৯৭০-এর দশকগুলোয় পৌঁছে যাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই কিন্তু আর আবেগে বা আদর্শে যুক্ত হচ্ছিলেন না। কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল বলে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিলেন। ফলে পরবর্তী কালে কংগ্রেসের হার শুরু হতেই হু হু করে জনভিত্তিও কমতে শুরু করেছিল। ক্ষয়ে যেতে যেতে সেই জনভিত্তি এখন কতটা সঙ্কুচিত, গাঁধী পরিবার যদি এখনও তা মাপতে না পারে, তা হলে ভবিষ্যৎ আরও কঠিন হবে।
ভারতের ধারণাটাকেই বিজেপি ধ্বংস করতে চাইছে, ভারতীয় সংবিধানের কাঠামোটাকে বিজেপি ভেঙে দিতে চাইছে— এই সব কথা কংগ্রেস নেতারা খালি বলেই যান, বলেই যান। মিথ্যা বলেন, এমন হয়তো নয়। কংগ্রেসি ধারণার ভারত এবং সঙ্ঘীয় ধারণার ভারতে পার্থক্য বিস্তর। কিন্তু সে কথা শুধু মুখে বললেই তো হবে না। প্রায় দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো একটা কিছু কংগ্রেসকে শুরু করতে হবে। বিজেপির বিকল্প যাঁরা খুঁজছেন, তাঁরা কংগ্রেসকে সেই ভূমিকাতেই দেখতে চান। কিন্তু গোটা দেশে সেই রকম তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যে নেতৃত্ব দরকার, কংগ্রেসের এখন আর তা নেই। নামী কংগ্রেস নেতাদের সে রকম প্রবল আন্দোলনে নামার মতো ইচ্ছাশক্তিও আর নেই।
টুইটারের রাজনীতিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। কিছু হলেই একটা টুইট করে নেতারা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিচ্ছেন। তাতেই যেন সব দায় শেষ। পদযাত্রা হোক, অবস্থান হোক, ধর্না হোক, বড় কোনও কর্মসূচি নেওয়া হোক— সে সব না থাকলে একটা রাজনৈতিক দলকে জীবন্ত বলে মনেই হয় না। কংগ্রেস নেতারা তা জানেন না, এমন তো নয়। কিন্তু কোথাও কোনও বড় বা ধারাবাহিক কর্মসূচি কংগ্রেসের নেই।
নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ কিন্তু ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্রটাই বদলে দিচ্ছেন। একে একে অনেক কিছু বদলেছেন তাঁরা। আরও অনেক কিছু বদলে দেবেন। তাঁদের হাতে সময়ও অনেকটাই রয়েছে এখনও। কিন্তু সেই সময়টাকে মোদী-শাহ কাজে লাগাতে পারুন, এমন সুযোগই দেওয়া উচিত হবে না বিরোধীদের। সাঙ্ঘাতিক বিরোধিতা এবং আন্দোলনে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে হবে এই সরকারকে। কিন্তু কংগ্রেসের সে ইচ্ছা রয়েছে বলেই মনে হয় না। দলের হাতে যেখানে যেটুকু আসছে, সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের নিজের ভাগ বুঝে নিতেই যেন ব্যস্ত সবাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy