(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়রাম রমেশ। —ফাইল চিত্র।
কথায় বলে, সকালটা দেখলেই বোঝা যায় দিন কেমন যাবে। সেই আপ্তবাক্য মেনে নিতে হলে ‘ইন্ডিয়া’র অন্দরে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন থেকেই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছে সোমবার। সে দিন বিরোধী শিবিরে ‘ঐক্য’ই দেখা গিয়েছিল। তবে মঙ্গল এবং বুধবার ধারাবাহিক ভাবে দেখা গেল, কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে কখনও সংঘাত, কখনও সমন্বয় হচ্ছে। লোকসভার শুরুতেই যে ঘাত-প্রতিঘাত তৈরি হয়েছে দু’পক্ষের মধ্যে, তাতে অভিজ্ঞেরা এখনই বলে দিচ্ছেন যে, এই সম্পর্ক ভাঙবে না। তবে হোঁচট খেতে খেতে চলবে।
কেন, তার কারণও খুব স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস-তৃণমূলের সম্পর্ক বরাবরই ‘ব্যস্তানুপাতিক’। অর্থাৎ, তৃণমূলের বাড়বৃদ্ধি হবে কংগ্রেসের ক্ষতিবৃদ্ধি হলে। আবার একই রকম ভাবে কংগ্রেসের উন্নতি হবে তৃণমূলের অবনতিতে। একই সঙ্গে, সর্বভারতীয় স্তরেও তৃণমূল তাদের উপস্থিতি জানান দিতে চাইবে। সেই মর্মেই রাজনৈতিক কৌশলও সাজাবে তারা। ফলে আপাতদৃষ্টিতে কংগ্রেস এবং তৃণমূলকে ‘স্বাভাবিক মিত্র’ বলে মনে হলেও বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি তা নয়। সে কারণেই পদে পদে দু’দলের সম্পর্কে ‘হোঁচট’ আসবে বলে মনে করেন উভয় শিবিরের নেতারা।
‘ইন্ডিয়া’র অন্দরে কংগ্রেস-তৃণমূল সম্পর্কে প্রথম হোঁচট এসেছিল গত ডিসেম্বরে পাঁচ রাজ্যে ভোটের সময়। গত বছর পুজোর আগে থেকে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে তৃণমূল লোকসভার জন্য রাজ্যওয়াড়ি আসন সমঝোতার কথা বলতে শুরু করেছিল। কংগ্রেসের অনেকে সেই ‘অতি সক্রিয়তা’ ভাল ভাবে নেননি। যদিও মুখে কেউই কিছু বলেননি। জয়রাম রমেশের মতো কংগ্রেস নেতারা ধারাবাহিক ভাবে বলে এসেছেন, ‘‘বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম শরিক তৃণমূল। জোটের গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ কিন্তু তৃণমূলের নেতারা একান্ত আলোচনায় বলতে শুরু করেছিলেন, কংগ্রেস আসন সমঝোতা নিয়ে অযথা বিলম্ব করছে। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা তখনই বলেছিলেন, কংগ্রেস পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের জন্য অপেক্ষা করছে। যাতে সেখানে ভাল ফল করলে ওরা বাংলায় আসন নিয়ে দর কষাকষি করতে পারে। বাস্তবে তা হয়নি। কংগ্রেস পাঁচ রাজ্যে ভাল ফল করেনি। ফলে ‘অ্যাডভান্টেজ’ পেয়ে যান মমতা। তিনি ঘোষণা করে দেন, বাংলায় কোনও জোট নেই। বাংলায় তৃণমূল একাই লড়বে। তবে জাতীয় স্তরে তাঁরা ‘ইন্ডিয়া’র শরিক।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল বিরোধিতাকে ‘পুঁজি’ করেই বামেদের সঙ্গে জোট করে ভোটে লড়েছিল কংগ্রেস। যার পুরোধা ছিলেন অধীর চৌধুরী। পক্ষান্তরে, তৃণমূল মরিয়া ছিল অধীরকে হারাতে। তাদের সেই পরিকল্পনা সফল হয়েছে। কারণ, অধীর বরাবর বলে এসেছেন, ‘‘মমতা কংগ্রেস ভাঙছেন। এ ভাবে বাংলায় আর কংগ্রেস থাকবে না।’’
অধীরের পরাজয়ের পরে অনেকে মনে করেছিলেন, সংসদে কংগ্রেস-তৃণমূলের কক্ষ সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ‘কাঁটা’ সরে গিয়েছে। এ বার সব ঠিকঠাক চলবে। অধিবেশনের শুরুর দিনে সেই প্রত্যাশিত ‘ঐক্য’ দেখাও গিয়েছিল। কিন্তু তাল কাটে মঙ্গলবার। যখন তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেন, ‘ইন্ডিয়া’র মধ্যে কোনও আলোচনা ছাড়াই স্পিকার নির্বাচনে ‘একতরফা’ ভাবে প্রার্থী দিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। দ্রুত আসরে নামতে হয় রাহুল গান্ধীকে। প্রথমে অভিষেক এবং পরে মমতার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তখনকার মতো বিষয়টি মেটে। রাতে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের বাসভবনে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে যোগ দেন তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাত পোহাতেই আবার হোঁচট! স্পিকার নির্বাচনে ভোটাভুটি নিয়ে অভিষেকের মন্তব্যের উল্টো কথা বলেন কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা জয়রাম। ধ্বনিভোটের মাধ্যমে ওম বিড়লার নাম নির্বাচন নিয়ে অভিষেক বলেন, ‘‘যা হয়েছে, তা নিয়মবিরুদ্ধ। বিরোধী শিবিরের বহু সাংসদ চেয়েছিলেন ভোটাভুটির মাধ্যমে স্পিকার নির্বাচন হোক। কিন্তু প্রোটেম স্পিকার সেই আবেদন গ্রাহ্য করেননি।’’ কিন্তু জয়রাম বলেন, ‘‘বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র শরিকেরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে লোকসভা স্পিকার হিসাব কেরলের সাংসদ সুরেশকে সমর্থনের প্রস্তাব এনেছিল। ‘ইন্ডিয়া’ ভোটাভুটির প্রস্তাব দিতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। কারণ, ‘ইন্ডিয়া’ চেয়েছিল লোকসভায় ঐকমত্য এবং সহযোগিতার পরিবেশ বজায় থাক।’’
তৃণমূল সূত্রের খবর, জোটের মধ্যে কংগ্রেস তাদের ‘অভ্যাসবশত’ লাগাতার ‘দাদাগিরি’ করে চলেছে। কিন্তু লোকসভা ভোটে তৃণমূল যে ভাবে বাংলায় বিজেপিকে রুখে দিয়েছে, তাতে তারা কারও ‘বশ্যতা’ স্বীকার করে চলবে না। ফলে পদে পদে কংগ্রেসকে সেই ‘বার্তা’ দেওয়া উচিত। যদিও দলের একাংশ মনে করছে, কারণ থাকলে ‘বিরোধিতা’ করা উচিত। কিন্তু কখনও যেন মনে না হয়, তৃণমূল পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করার মনোভাব নিয়ে চলছে। তা হলে সামগ্রিক ভাবে বিজেপি-বিরোধী পরিসরে ‘ভুল বার্তা’ যাবে। বিজেপিও সেই মতানৈক্যের ‘সুযোগ’ নেবে। পক্ষান্তরে, কংগ্রেসের অনেকের বক্তব্য, সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপট থেকে তাদের দল কোনও বিষয়কে যে ভাবে দেখবে, তৃণমূলের ক্ষেত্রে তার ‘সীমাবদ্ধতা’ রয়েছে। তবে কংগ্রেসের নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করে নিচ্ছেন, বাংলায় যা-ই সম্পর্ক থাক, এখন সংসদে বিরোধী শিবিরে সংখ্যার যে সমীকরণ, তাতে ২৯ আসন জয়ী তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে চলা ছাড়া উপায় নেই। এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতার কথায়, ‘‘এটাকে শুধু কংগ্রেস-তৃণমূলের সম্পর্কের সমীকরণে দেখলে হবে না। মমতার সঙ্গে শরদ পওয়ার, উদ্ধব ঠাকরে, অখিলেশ যাদব, এমকে স্ট্যালিনের মতো নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্কের কথাও কংগ্রেসকে মাথায় রাখতে হবে।’’
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে নবান্নে মমতার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছিলেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম। সেই বৈঠক নিয়ে মমতা বা চিদম্বরম প্রকাশ্যে কেউই কিছু বলেননি। তবে বিবিধ সূত্র জানিয়েছিল, কেরলের ওয়েনাড়ে প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর সমর্থনে মমতাকে প্রচারে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন চিদম্বরম। মমতা যাবেন কি না, সে ব্যাপারে তাঁর বা তৃণমূলের তরফে এখনও কিছু বলা হয়নি। তৃণমূলের অন্দরমহলের বক্তব্য, কংগ্রেস-তৃণমূল সম্পর্কের উপর নির্ভর করবে মমতার সিদ্ধান্ত। ঘটনাচক্রে, মমতাই বলেছিলেন, প্রিয়ঙ্কার বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়া উচিত। তখন তা শোনেনি কংগ্রেস। কিন্তু দেখা গিয়েছে, নিজের কেন্দ্রে মোদীর ব্যবধান কমেছে ৩ লক্ষ ২৬ হাজার। প্রিয়ঙ্কা লড়লে সেই ব্যবধান আরও কমার একটা সম্ভাবনা ছিল।
সকাল মেঘাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু রোদ্দুর উঠতে পারে মমতা ওয়েনাড়ে যেতে রাজি হয়ে গেলে। সেই ‘সূচক’-এর দিকেই আপাতত তাকিয়ে দু’দলের রথী-মহারথীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy