‘স্বদেশ’-প্রেম: সিনেমার মতো। গ্রামে বিদ্যুৎ আনার লড়াই নাসার বিজ্ঞানীর (অভিনয়ে শাহরুখ খান)। বাস্তবে মহারাষ্ট্রের গ্রাম হলগরায় জল বাঁচাতে লড়ছেন ইয়াহু-কর্তা দত্তা পাটিলও (ডান দিকে)।
একটা যুদ্ধ গুগ্লের সঙ্গে। আর একটা জল বাঁচাতে। লড়ছেন বছর সাঁইত্রিশের দত্তা পাটিল। ক্যালিফর্নিয়ায় ইয়াহু-র অফিসে বসে পরিকল্পনা করছেন জিমেল-কে টেক্কা দেওয়ার। আর সুযোগ পেলেই বছরে অন্তত এক বার করে মহারাষ্ট্রের লাতুরে ঢুঁ মারছেন ‘গ্রামের ছেলে’। বৃষ্টির জল ধরার কাজ বিস্তর বাকি যে!
গ্রামের নাম হলগরা। ২০১৭-য় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস নিজে গিয়ে গ্রামটি দত্তক নিয়েছিলেন। তত দিনে অবশ্য বছরখানেক ‘ছেলে মানুষ’ করে ফেলেছেন পাটিল। ২০১৬-র জানুয়ারিতে ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি গিয়ে পাটিল দেখেছিলেন, চার পাশ শুকনো। ছেলেবেলার সেই সবুজ, ঢেকে গিয়েছে ফুটিফাটা খয়েরি-কালো রঙে। তিন বছর পরে অবশ্য এখন আবার সোনা ফলাতে তৈরি মাটি। হাজার দশেক গাছ, আর ২০০ কোটি লিটারের জলাধার নিয়ে এখন শুধু বড় বৃষ্টির অপেক্ষায় মহারাষ্ট্র-কর্নাটক সীমানা থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম।
কী ভাবে হল এই ম্যাজিক? ক্যালিফর্নিয়া থেকে ইয়াহু-র ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিরেক্টর পাটিল ফোনে বললেন, “পুরোটাই অ্যাক্সিডেন্টাল বলতে পারেন। কাগজে দেখতাম, ট্রেনে করে খাবার জল পৌঁছে দিতে হচ্ছে লাতুরের গ্রামে-গ্রামে। খেতে না-পেয়ে আত্মহত্যা করছেন চাষিরা। কিন্তু নিজের চোখে সেই খরার চেহারা না-দেখলে বোধ হয় টনক নড়ত না।”
তাই সে-বার কর্মস্থলে ফিরেই ইন্টারনেটে ডুব দেন পাটিল। দেখলেন, সে-বছরে হলগরার অর্ধেক বৃষ্টি হয়েছে ক্যালিফর্নিয়ার সান্টা ক্লারায়—টেনেটুনে ৪০০ মিলিমিটার। টানা পাঁচ বছর খরাও দেখেছে শহর। কিন্তু দশ বছরের প্রবাসজীবনে কই তাঁকে তো কখনও জলের ট্যাঙ্ক ভাড়া করতে হয়নি! দিনের শেষে দিব্যি বাথটাবেই ক্লান্তি মিটিয়েছেন। তা হলে?
অন্ধকারেই ‘মাটি খোঁড়া’ শুরু করেছিলেন পাটিল। এবং দেখলেন, ক্যালিফর্নিয়ায় ভৌম জলের স্তর যেখানে মাত্র ৭০ ফুট নীচে, লাতুরে সেখানে ৮০০ ফুট মাটি কোপালে তবে জল মেলে।
তাই বৃষ্টির জল ধরা ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে চাষেও লাগবে, আবার তেষ্টা মিটবে মাটিরও। প্রথমে ঠিক হল, গ্রামের মাঝামাঝি অন্তত দু’টো পুকুর খুঁড়তে হবে। আর প্রায় ২০ কিলোমিটারের পাঁচটা মরা নালাকে নতুন জীবন দিতে হবে। কৃষ্ণ মৃত্তিকার এলাকা লাতুর। তাই বৃষ্টি হলেও জল থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মাটি এসে আবার পুরু স্তর তৈরি করেছে নদীখাতেও।
তাই খুঁড়তে খুঁড়তে বালির স্তর পর্যন্ত যেতেই হবে। কোথাও এক তো, কোথাও দেড় মিটার পর্যন্ত খনন প্রয়োজন। তার পরে বর্ষার জল ধরতে পারলে বাজিমাত। রাতারাতি না-হোক, জলাধার থেকে জল চুঁইয়ে-চুঁইয়ে এক দিন ভৌম জলের স্তর ঠিক বাড়বেই। কিন্তু অর্থ কই? লোকবল? ক্লাস ফোরের স্কুলছুট মাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ‘পাঠশালা’ খুললেন পাটিল। বোঝাতে শুরু করলেন, কেন জল ধরে ভরে রাখা প্রয়োজন। নিজের পকেট থেকে গোড়াতেই ঢাললেন তিন লাখ। গ্রামের এক জন দিলেন আরও তিন। ভিড়ে ঠাসা গ্রামসভা থেকে বার্তা এল— ‘‘তিন-চার মাসের মধ্যে আমরাও দেব পাঁচ লাখ।’’ সঙ্গে টানা ছ’মাস রোজ দু’ঘণ্টা করে শ্রমদানের অঙ্গীকার।
ক্লাস টেন পর্যন্ত এই গ্রামের স্কুলেই পড়েছেন পাটিল। একাদশ-দ্বাদশ শহরের স্কুলে। তার পরে ইঞ্জিনিয়ারিং। বাবা-মা মোট আট একর জমির অর্ধেক বিক্রি করে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। বেশ কিছু দিন মাইক্রোসফটের চাকরি করে বছর দশেক হল এখন ইয়াহু-তে। ২০১৬-য় জল গড়াল সেখানেও। পাওয়ার-পয়েন্ট প্রজেক্ট বানিয়ে অনুদানের জন্য দরবার করলেন। পেয়েও গেলেন— তিন বছরের জন্য পুরো এক কোটি।
এই জলযুদ্ধের গোড়াতেই পাটিল পাশে পেয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে জল সংরক্ষণ নিয়ে কর্মরত আমির খান, কিরণ রাওদের অলাভজনক সংস্থাকে। না, অর্থসাহায্য নয়। এই সংস্থার ‘ওয়াটার কাপ’ প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে যে অনেক কিছু শিখেছিলেন, মানলেন পাটিলের সহযোদ্ধা হলগরারই অমিত দেশমুখ। ফোনে বললেন, ‘‘সেই শিক্ষা কাজে লাগাতে পেরেছি বলেই আজ জল নিয়ে মারামারি নেই আমার গ্রামে। অনেকেই ১৫০ ফুট কুয়ো খুঁড়েই জলের খোঁজ পেয়েছেন।’’
আর সরকারি সাহায্য? পাটিল বললেন, স্বচ্ছ ভারত অভিযানে গ্রামের জন্য শ’তিনেক শৌচালয় ছাড়া আর কানাকড়িও মেলেনি। খোদ মুখ্যমন্ত্রী দত্তক নেওয়ার পরেও হলগরা ‘দুয়োরানির ছেলে’। তবে স্থানীয় প্রশাসন আগাগোড়া পাশেই ছিল বলে দাবি পাটিলের। এই তিন বছরে দুই একর জমিতে পেল্লায় দু’টো পুকুর, তিনটে নতুন চেক-বাঁধ, ১০টা পুরনো চেক-বাঁধ মেরামত এবং ১৫০০ হেক্টরের কৃত্রিম জলাশয় তৈরি হয়েছে গ্রামে। পাটিল জানালেন, তাঁর আর্জিতে সাড়া দিয়ে সুদূর আমেরিকা থেকে রাজস্থান, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাড়ুর ৫০টি গ্রামে এমনই কর্মকাণ্ড শুরু করতে চলেছে ‘ওভারসিজ় ভলান্টিয়ার্স ফর বেটার ইন্ডিয়া’।
কিন্তু এ বছর বৃষ্টি কই! মুম্বই দু’দফায় বানভাসি হলেও, লাতুরের জেলাশাসক বলছেন, গত বছর ৬০ শতাংশ বৃষ্টিপাত হলেও জেলার বিস্তীর্ণ অংশে এখনও ১৭ শতাংশও বৃষ্টি হয়নি। ১ জুন থেকে অগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত লাতুরে প্রায় ৪০০ মিমি বৃষ্টি হওয়ার কথা। হয়েছে মাত্র ২৫০ মিমি। পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে সব চেয়ে খারাপ হাল পাশের জেলা ওসমানাবাদও। তবু জলাধার তৈরি বলেই আশায় বুক বাঁধছে হলগরা।
ক্যালিফর্নিয়া থেকে তরুণ ইয়াহু-কর্তা ফেসবুকে শেখাচ্ছেন— কী ভাবে আপনি ইয়াহু থেকেই আপনার জিমেল খুলবেন! আর ফাঁকে ফাঁকে ভিডিয়ো পোস্ট করছেন গ্রামের পুকুরে ‘ব্যাঙবাজি’র। ফের ছুটির ফিকির খুঁজছেন পাটিল। তাঁর বছর পাঁচেকের ছেলে বলেছে, ভরা পুকুরে এ বার ঠিক চার লাফ দেবে তার ঢিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy