পঞ্জাবের বিধানসভা ভোটে এ বার স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক সমীকরণ ভেঙে যেতে পারে বলে অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস ছিল। শিরোমণি অকালি দল বনাম কংগ্রেস রাজনীতিতে বিভক্ত পঞ্চনদের তীরে এ বার কেজরীবালের আপ সরকার গঠনের লড়াইয়ে এগিয়ে বলে ওই সমীক্ষাগুলিতে দাবি করা হয়েছিল। বাস্তবেও তা-ই ঘটল।
অরবিন্দ কেজরীবাল এবং ভগবন্ত মান। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পঞ্জাবে অরবিন্দ কেজরীবালের ঝাড়ুর বাতাসে উড়ে গেল কংগ্রেস। ১১৭ আসনের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ‘জাদু সংখ্যা’ ৫৯ টপকে অনেক দূর গিয়ে তারা ১০০-র কাছাকাছি সংখ্যার পৌঁছে গিয়েছে। অধিকাংশ আসনেই অরবিন্দের দলের সঙ্গে টক্কর ছিল কংগ্রেসের। শতাব্দীপ্রাচীন দলকে জমি ধরিয়ে দিয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী।
পঞ্জাবে তৃতীয় স্থানে রয়েছে প্রকাশ সিংহ বাদল পরিবারের নেতৃত্বাধীন শিরোমণি অকালি দল। অনেকটাই পিছিয়ে কংগ্রেস-ত্যাগী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিংহের ‘পঞ্জাব লোক কংগ্রেস’ এবং বিজেপি-র জোট। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কয়েকটি কৃষক সংগঠন এ বার নয়া দল ‘সংযুক্ত সমাজ মোর্চা’ গড়ে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিল। তবে ভোটে তারা তেমন ছাপ ফেলতে পারেনি।
পঞ্জাবের বিধানসভা ভোটে এ বার স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক সমীকরণ ভেঙে যেতে পারে বলে অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস ছিল। শিরোমণি অকালি দল বনাম কংগ্রেস রাজনীতিতে বিভক্ত পঞ্চনদের তীরে এ বার কেজরীবালের আপ সরকার গঠনের লড়াইয়ে এগিয়ে বলে ওই সমীক্ষাগুলিতে দাবি করা হয়েছিল। বাস্তবেও তা-ই ঘটল।
ভোটের ফল বলছে, পঞ্জাব জুড়ে আপ ঝড়ে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা চরণজিৎ সিংহ চন্নী দু’টি আসনেই (ভদৌর এবং চমকৌর সাহিব) হেরেছেন। আপ প্রার্থীরা হারিয়েছেন, উপমুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ সোনি (অমৃত সেন্ট্রাল), প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নভজ্যোৎ সিংহ সিধু (অমৃতসর পূর্ব)-কেও। শিরোমণি অকালি দলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদ (লাম্বি) এবং তাঁর ছেলে সুখবীরও (জালালাবাদ) আপ প্রার্থীদের কাছে হেরেছেন। অন্য দিকে, আপ-এর মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ভগবন্ত মান (ধুরি) এবং বিদায়ী বিরোধী দলনেতা হরপাল সিংহ চিমা (দিরবা) বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন।
‘চ্যাম্পিয়ন’ না হলেও অতীতে দু’বার পঞ্জাবের ভোটযুদ্ধে ‘রানার আপ’ হওয়ার উদাহরণ রয়েছে কেজরীবালের দলের। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে ওই রাজ্যের ১৩ আসনের মধ্যে অকালি-বিজেপি জোট ৬টি এবং আপ ৪টিতে জিতেছিল। কংগ্রেস জিতেছিল ৩টিতে। আবার ২০১৭-র বিধানসভা ভোটে ১১৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭৭টিতে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায় কংগ্রেস। আপ ২০টিতে জিতে হয় দ্বিতীয়। তাদের সহযোগী লোক ইনসাফ পার্টি ২টিতে জয় পায়। অকালি দল ১৫টিতে জেতে। অকালি দলের সঙ্গে জোট করে লড়ে বিজেপি পেয়েছিল ৩টি আসন।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে অবশ্য আপ-এর আসন ১-এ নেমে আসে। ১৩টি কেন্দ্রের মধ্যে কংগ্রেস একাই জেতে ৮টিতে। ২টি করে আসনে জেতে বিজেপি এবং তার তৎকালীন সহযোগী অকালি দল। মোদী সরকারের বিতর্কিত তিন কৃষি আইনের প্রতিবাদ জানিয়ে ২০২০ সালে এনডিএ জোট ছেড়েছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদল এবং তাঁর ছেলে সুখবীরের (প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী) দল। এ বারের ভোটে তাঁরা জোট গড়েছিলেন মায়াবতীর বিএসপি-র সঙ্গে।
শতাংশের হিসেবে দেশের সবচেয়ে বেশি দলিত জনগোষ্ঠীর বাস পঞ্জাবে। ৩২ শতাংশেরও বেশি। বিএসপি-র প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত কাঁসিরামও পঞ্জাবের রূপনগর (পূর্বতন রোপার) জেলার বাসিন্দা ছিলেন। ১৯৯৬ সালের লোকসভা ভোটে অকালিদের সঙ্গে সমঝোতা করেই পঞ্জাবে ৩টি আসনে জিতেছিল বিএসপি। যদিও কখনওই সে রাজ্যে দলিতদের একচেটিয়া ভোট পায়নি কাঁসিরামের দল। এ বার দলিত নেতা চরণজিৎ সিংহ চন্নীকে মুখ্যমন্ত্রী করেও কংগ্রেস দলিত সমর্থন সে ভাবে পেতে ব্যর্থ। চন্নী দাঁড়িয়েছিলেন দু’টি আসনে। দু’টিতেই হেরেছেন তিনি।
২০১৭-র বিধানসভা ভোটে পঞ্জাবের তিনটি অঞ্চলেই (মালওয়া, মাঝা এবং দোয়াব) ভাল ফল করেছিল কংগ্রেস। রাজধানী চণ্ডীগড় এবং পটিয়ালা, সঙ্গরুর, ভটিন্দা, ফরিদকোট-সহ দক্ষিণের কয়েকটি জেলা নিয়ে গঠিত মালওয়ায় বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৬৯। সেখানে ৪০ আসনে কংগ্রেস, ১৮ আসনে আপ, ৮টি আসনে অকালি দল এবং ১টিতে তার তৎকালীন সহযোগী বিজেপি জিতেছিল। অন্যেরা জিতেছিল ২টিতে।
অমৃতসর, পঠানকোট, গুরদাসপুর, তরণ তারণের মতো উত্তর-পশ্চিম পঞ্জাবের জেলাগুলি নিয়ে গঠিত মাঝা অঞ্চলের ২৫টি আসনের মধ্যে ২০১৭-য় কংগ্রেস ২২টিতে জেতে। অকালি দল ২ এবং বিজেপি ১টিতে। অন্য দিকে উত্তর-পূর্বের হোসিয়ারপুর, জালন্ধর, কপূরথালার মতো জেলাগুলি নিয়ে গঠিত দোয়াব অঞ্চলের ২৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৫, অকালি দল ৫, বিজেপি ১ এবং আপ ২টিতে জিতেছিল।
এ বার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহের দলত্যাগ এবং মুখ্যমন্ত্রী চন্নীর সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নভজ্যোৎ সিংহ সিধুর বিবাদের জেরে কংগ্রেস বিপাকে ছিল। কৃষিবিলের বিরোধিতা অকালি দল এনডিএ জোট ছাড়ার পরে বিজেপি সেখানে অমরেন্দ্রের নয়া দল পঞ্জাব লোক কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেও সুবিধা করতে পারেনি।
গত আট বছরে দক্ষিণ পঞ্জাবের মালওয়া অঞ্চলে আপ-এর সাংগঠনিক সক্রিয়তা অনেকটাই বেড়েছিল। এই অঞ্চলের ৬৯টি আসনের বড় অংশ এ বার কেজরীবালের ঝুলিতে যেতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। ভোটের ফল বলছে, সবগুলি অঞ্চলেই ভাল ফল করেছে আপ। দিল্রির বাইরে পদক্ষেপের জন্য তাদের প্রথম সোপানে নাম লেখা থাকবে পঞ্জাবের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy