ভোট গণনার ব্যালান্সশিট বলছে, খুব বেশি ব্যবধানে হারেননি তিনি। কিন্তু হার তো হারই। ১ রানে হোক বা ১০০ রানে।
তবে কি না, পঞ্জাবে বিধানসভা ভোটের আগেই হেরে গিয়েছিলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার নভজ্যোৎ সিংহ সিধু! অমৃতসর-পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটারদের জনাদেশে নয়। কংগ্রেস হাইকমান্ডের ‘দরবারে’! কারণ, পঞ্জাবে আপাতত তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া হবে না বলে ভোটের আগেই কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব ঘোষণা করে দিয়েছিল। জানিয়েছিল, সে রাজ্যে টানা দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এলে জাঠ শিখ সিধু নন, দলিত রামদসিয়া জনগোষ্ঠীর চরণজিৎ সিংহ চন্নীই ফের চণ্ডীগড়ের কুর্সিতে বসবেন।
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আম আদমি পার্টি (আপ) মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসেবে বেছে নিয়েছিল ভগবন্ত মানকে। ফলে বিধানসভা নির্বাচনে লড়ার জন্য মনোনয়ন জমা দিলেও ভোটের আগেই প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটারের সমর্থকেরা বুঝে গিয়েছিলেন, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদটুকুই যা অবলম্বন। বড় জোর তার সঙ্গে ‘সান্ত্বনা’ হতে পারে বিধায়ক পদ।
মনের অগোচরে আক্ষেপ থাকতেই পারে সিধুর। কারণ, ২০১৬ সালে বিজেপি ছাড়ার পরে তাঁকে ‘আপ’-এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান অরবিন্দ কেজরীবাল। ২০১৭-র বিধানসভা ভোটেই ‘মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী’ হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসে যোগ দেন সিধু। অমৃতসর-পূর্ব বিধানসভা আসন থেকে ভোটে জিতে অমরেন্দ্র সিংহের সরকারের মন্ত্রীও হন। কিন্তু ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আড়াই বছরের মাথাতেই মন্ত্রিত্ব ছাড়েন।
‘ক্যাপ্টেনের’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অবশ্য সিধুর আড়াই দশকের পুরনো অভ্যাস! ১৯৯৬ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফরের সময় মহম্মদ আজহারউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মাঝপথেই দেশে ফিরে এসেছিলেন তিনি। পরিণামে সিধুর ক্রিকেট কেরিয়ারে অধোগতি শুরু হয়েছিল। আর ভারতীয় ক্রিকেট টিমে উদয় হয়েছিল এক নতুন তারকার— সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
ক্রিকেট ছাড়ার পরে প্রাথমিক ভাবে ধারাভাষ্য আর টিভি-শোতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন সিধু। ২০০৪-এর লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-তে যোগ দিয়ে অমৃতসর থেকে জেতেন তিনি। একটি ফৌজদারি মামলার জেরে সাংসদ পদে ইস্তফা দিলেও ফের ২০০৭-এ উপনির্বাচনের জিতে আসেন। বিজেপি-র টিকিটে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটেও অমৃতসরে জয়ের ধারা বজায় রেখেছিলেন সিধু।
কিন্তু সেই সম্পর্কে প্রথম ফাটল ধরে ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে। সিধুকে সরিয়ে অরুণ জেটলিকে অমৃতসরের টিকিট দেন বিজেপি শীর্ষনেতৃত্ব। তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন সিধু। সে বার অমৃতসরে কংগ্রেসের প্রার্থী অমরেন্দ্র সিংহের কাছে হেরে যান জেটলিও।
২০১৬-র সেপ্টেম্বরে বিজেপি ছাড়েন সিধু। অবশ্য তার আগে তাঁকে ধরে রাখতে চেষ্টার কসুর করেনি বিজেপি। অমৃতসর থেকে টিকিট না দেওয়ার ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে সিধুকে রাজ্যসভার মনোনীত সাংসদ করেছিল বিজেপি। কিন্তু বিজেপি ছাড়ার পাশাপাশি সিধু সেই সাংসদ পদও ছেড়ে দেন। গড়েন নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ ‘আওয়াজ-ই পঞ্জাব’।
এক সময় শোনা গিয়েছিল, সিধু আপ-এ যোগ দেবেন। তার পর সে সম্ভাবনা ভেস্তে যায়। সম্প্রতি সিধু জানিয়েছেন, ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর সে সময় তাঁকে কংগ্রেসে আনার জন্য অন্তত ৭০ বার বৈঠক করেছিলেন।
এ বার গোড়া থেকেই অমৃতসর-পূর্ব আসন ছিল সিধুর কাছে ‘কঠিন পিচ’। যদিও জয়ী আপ প্রার্থী তথা পঞ্জাবের ‘প্যাড উওম্যান’ জীবনজ্যোত কৌর নন, সেখানে সিধুর মাথাব্যথার কারণ ছিলেন অকালি দলের বিক্রম মঝিথিয়া। প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিংহ বাদলের শ্যালক বিক্রম পঞ্জাব রাজনীতিতে একাধারে প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত। প্রকাশ সিংহ বাদল সরকারের মন্ত্রী থাকাকালীনই তাঁর বিরুদ্ধে মাদক চোরাচালান চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। এ বার সিধু প্রতিটি জনসভায় নিয়ম করে প্রকাশ-পুত্র সুখবীর আর তাঁর শ্যালক বিক্রমকে এ নিয়ে আক্রমণ করেছেন। অমৃতসরবাসীকে সতর্ক করে স্লোগান দিয়েছেন, ‘‘কোঠে পে তোতা বইঠেন না দেনা, জিজা-শালা রহনে না দেনা।’’
পঞ্জাবে ফের কংগ্রেস সরকার গড়লে ‘মাদক কারবারি মঝেথিয়া’কে জেলে ভরার অঙ্গীকারও করেছিলেন সিধু। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দুর্নীতিমুক্ত সরকারের। যদিও সে সরকারের কর্ণধার যে তিনি হবেন না, তা আগেই পঞ্জাববাসীর স্পষ্ট করে দিয়েছিল কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে এ বার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারেও যেতে হয়েছে সিধুকে। তাঁর অনুপস্থিতিতে অমৃতসর-পূর্বের দায়িত্ব সামলেছেন স্ত্রী তথা প্রাক্তন বিধায়ক নভজ্যোৎ কৌর এবং ফ্যাশন ডিজাইনার কন্যা রাবিয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রথম নির্বাচনী পরাজয় এড়াতে পারলেন না সিধু।